মাংস রপ্তানির কথা ভাবুন
ড. এম এ হান্নান
🕐 ৯:০০ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১১, ২০১৯
কিছু দৈনিক খবরের কাগজ পড়ে জানতে পারলাম, ব্রাজিল থেকে গরুর হিমায়িত মাংস আমদানির শর্তে আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানি হবে। সত্যিই যদি তা বাস্তবায়ন হয়, এ দেশের প্রাণিসম্পদ খাত হুমকির সম্মুখীন হবে। অতীতে আমরা চাহিদার শতভাগ মাংস উৎপাদনে সক্ষম ছিলাম না। যার দরুণ, ভারত থেকে বৈধ ও অবৈধ পথের গরু অনুপ্রবেশ কখনোই বন্ধ করা যায়নি। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চেহারা অনেকটাই পাল্টেছে, ভারত থেকে গরু আসা কমছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মতে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জনপ্রতি মাংসের প্রাপ্যতা ছিল ২০.৬০ গ্রাম এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে বেড়ে ১২২. ১০ গ্রামে উন্নীত হয়েছে। যা জনপ্রতি চাহিদার (১২০.০ গ্রাম) চেয়ে সামান্য বেশি। গত এক দশকে মাংসের উৎপাদন বেড়েছে ৫.৭০ গুণ।
যুগ যুগ ধরে প্রান্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পশুপাখি পালনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিক্ষিত যুবকদের গরু মোটাতাজাকরণ ও ডেইরি খাতকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া, প্রাণিসম্পদ সেক্টরের সমৃদ্ধি অর্জনের পথে বিশাল ভূমিকা রাখছে। গত কয়েক বছর যাবৎ, গবাদি-পশুপাখি লালন-পালনে দেশব্যাপী ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হিসাবে, ২০১৭ সালে দেশে মোট খামারি ছিলেন ৩ লাখ ৭৭ হাজার। চলতি বছর তা বেড়ে হয়েছে ৫ লাখ ৭৭ হাজার। কাজেই, সেদিন সম্ভবত বেশি দূরে নয়-যখন আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের মাংস রপ্তানির বিশাল সম্ভাবনা তৈরি হবে।
যদিও আমাদের মাংস শিল্পের বাণিজ্যিক বিস্তার বড় পরিসরে গড়ে উঠেনি কিন্তু বেঙ্গল মিট, দেশি মিটসহ আরও কিছু কোম্পানি সুনামের সঙ্গে এ শিল্পে ব্যবসা করছে। বিদেশে মাংসের রপ্তানির বাজার পেতে নিশ্চিত করতে হবে নিরাপদ মাংস উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সরবরাহের পরিবেশ।
তা না করতে পারলে, বিদেশিরা আমাদের মাংস নেবে না। দুঃখজনক, বাংলাদেশে অবস্থিত অধিকাংশ বিদেশি দূতাবাস এবং ফাইভষ্টার হোটেলগুলোতে দেশীয় পশু-পাখির মাংস রান্না হয় না! তার মানে কি আমাদের মাংসের স্বাদ বা পুষ্টিমান কম। অবশ্যই না, বিষয়টা হলো আস্থার অভাব।
এ জন্য আমরাই বেশি দায়ী। আমরা এমন এক হতভাগা জাতি, যারা নিজেরাই নিজেদের খাদ্যে ভেজাল মিশাই এবং ভেজাল খাদ্য খেয়ে অসুস্থ হয়ে আবার নকল ওষুধ সেবন করি। আর শুধু একজন আরেকজনের দোষ খোঁজায় মগ্ন থাকি। সব খাদ্য উৎপাদনের প্রাথমিক পর্যায় থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছার আগের প্রতিটি স্তরে যদি গুণগত মান বজায় রাখা যায়, তবে এ দেশের হাসপাতালগুলোতে এমনিতেই রোগীর ভিড় কমে যাবে। পাশাপাশি, আমাদের অনেক রপ্তানিযোগ্য পণ্য সহজেই বিদেশি বন্দরে ঢোকার ছাড়পত্র পাবে।
মাংস রপ্তানির লক্ষ্যে, খামারিদের আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পশুপাখি পালনে উদ্বুদ্ধকরণ, প্রশিক্ষণ দেওয়া ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। দেশব্যাপী আধুনিক খামার স্থাপন ও মাঠপর্যায়ে আরও বেশি ভেটেরিনারি ডাক্তার নিয়োগ দিয়ে খামারিদের দোরগোড়ায় প্রাণি সেবা নিশ্চিত করাসহ সার্বিক বিষয়ের বাস্তবায়নে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি। মোদ্দাকথা, মাংস রপ্তানির বিষয়টি সরকারি পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
দুঃখের বিষয়, আমাদের গবাদিপশুর খামারিরা অবহেলিত, কারণ তারা সরকারি তেমন কোনো সুবিধা পান না। বরং তাদের উচ্চসুদে ঋণ নিয়ে খামার গড়তে হচ্ছে। ফলে গরু পালনে খরচ বেশি পড়ছে। বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স এসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) মতে, গোখাদ্যের শুল্কমুক্ত আমদানি, পতিত সরকারি জমি খামারিদের ফডার উৎপাদনে লিজ দেওয়া, খামার স্থাপনে ঋণ প্রদান, খামারের বিদ্যুৎ ও পানির বিল বাণিজ্যিক আওতামুক্ত করে কৃষির আওতায় আনলে, গরুর মাংস প্রতি কেজি সাড়ে তিনশ টাকায় পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশের অগ্রগতিতে যে ২টি সেক্টর অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির মেরুদণ্ডের ন্যায় ভূমিকা রাখছে তার একটি হলো প্রবাসী শ্রমিক ভাই-বোনদের কষ্টার্জিত পাঠানো রেমিট্যান্স, আর অন্যটি হলো তৈরি পোশাকের রপ্তানি খাত। পোশাক খাত আমাদের গর্বের জায়গা। একে বিকশিত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে, তবে সেটা অন্য খাতের উন্নয়নে ব্যাঘাত ঘটিয়ে নয়।
আমাদের তৈরি পোশাক বিশ্ববাসীর মন জয় করেছে। আমেরিকায় অবস্থানকালে বিপণিকেন্দ্রগুলোতে যেমন ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা পোশাক দেখেছি, ঠিক তেমনটি এখন জাপানে দেখছি। বর্তমানে আমেরিকায় তৃতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ।
প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে যথাক্রমে চীন এবং ভিয়েতনাম, ভারতের অবস্থান চতুর্থ। বাংলাদেশের মতো সস্তা মূল্যে শ্রমিক খুব কম দেশেই পাওয়া যায়। ফলে আমাদের তৈরি পোশাকের রপ্তানি বিকাশে বেগ পাওয়ার কথা নয়, যদি আমরা দক্ষতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে যোগসাজশ রাখি।
ক্যাটল ফ্যাটেনিং বা গরু মোটাতাজাকরণ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের কাছে দিন দিন আকর্ষণীয় হচ্ছে, আশা করা যায় সামনে বার্ষিক মাংস উৎপাদন আরও বাড়বে। সেক্ষেত্রে নিকট ভবিষ্যতে দেশীয় উদ্যোক্তাদের মাংস রপ্তানির দ্বার উন্মোচনের সুযোগ হবে। লাখ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে, আমাদের হালাল মাংসের মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো তথা অন্যান্য মাংস আমদানিকারক দেশে রপ্তানি বাজার পাওয়ার ভালো সুযোগ রয়েছে।
একটি দেশ তখনই উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরোহন করে, যখন তার প্রায় সব সেক্টর স্বনির্ভরতা অর্জন করে ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখে। কিন্তু মাংস আমদানির বিষয়টি এদেশের লাখো দরিদ্র কৃষককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং তরুণ বেকারদের গবাদিপশু-পাখি পালনে নিরুৎসাহিত করবে। ফলে ব্রাজিল থেকে গরুর মাংস আমদানির সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী।
বাংলাদেশ যদি সত্যিই উন্নত দেশে রূপান্তরিত হতে চায়, তবে পোশাক খাতের মতো আরও অনেকগুলো রপ্তানি খাত সৃষ্টি করতে হবে। সম্ভাবনাময় মাংসশিল্প হতে পারে সেগুলোর অন্যতম একটি।
কাজেই, ‘মাংস আমদানির বিনিময়ে পোশাক রপ্তানি’- এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসাই দেশের জন্য মঙ্গলজনক। বরং মাংস রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের লক্ষ্যে করণীয় বিষয়ে মনোনিবেশ দিতে হবে। উদীয়মান একটি শিল্পকে হুমকিতে ফেলে আরেকটি শিল্প বিকাশের চিন্তা- কখনোই সামষ্টিক অর্থনৈতিক মুক্তির পথ দেখাবে না।
ড. এম এ হান্নান : গবেষক, অবিহিরো ইউনিভার্সিটি
অব এগ্রিকালচার এন্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন, জাপান
[email protected]