বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন
আব্দুল হাই রঞ্জু
🕐 ৯:৩৪ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ০৬, ২০১৯
সবাই জানি ‘আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’। অর্থাৎ শিশুরাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। সেই প্রজন্মের বাসউপযোগী পৃথিবী দিনে দিনে ভয়ংকর হয়ে উঠছে। যা ওদের আর বুঝতে বাকি নেই। ফলে গোটা দুনিয়ার লাখ লাখ স্কুলপড়ুয়া শিশু প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। গত ২০ সেপ্টেম্বর ছিল বিশ্ব শিশু দিবস। এ দিবসে বিশ্বের ১৬০টি দেশের ২ হাজার ৬০০ শহরে পরিবেশ বাঁচানোর দাবিতে স্কুল ছেড়ে লাখ লাখ শিক্ষার্থী রাস্তায় নামে। শুধু তাই নয়, স্কুলের শিক্ষার্থীদের এই পরিবেশ বাঁচানোর আন্দোলনে জার্মানির দুই শতাধিক পরিবেশ, সামাজিক, শ্রমিকসহ নানা সংগঠন একাত্মতা প্রকাশ করে ওদের আন্দোলনে সমর্থন জানায়।
যার অংশ হিসেবে বিশ্বের অন্যান্য শহরের সঙ্গে মিল রেখে বিশ্ব শিশু দিবসে জাতীয় সংসদের পাশে মানিক মিয়া এভিনিউয়ে রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব প্রতিরোধে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিতে নানা স্লোগানে ভরা প্ল্যাকার্ড হাতে প্রতিবাদ সমাবেশ করে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধের প্রতিবাদে র্যালি, আলোচনা পর্ব ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। এমনকি র্যালি শেষে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পৃথিবীকে রক্ষায় শপথ নেয় শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের তরফে বলা হয়, পৃথিবী ও জলবায়ুর ক্ষতি হয় এমন কোনো কর্মসূচি যাতে আমাদের সংসদ থেকে না আসে সে বার্তা দিতে আমরা এখানে সমবেত হয়েছি।
উক্ত সমাবেশে স্থাপতি ইকবাল হাবিব তার বক্তব্যে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি নিয়ে বাংলাদেশের শিশুরাও সোচ্চার হয়েছে। আগামীর পৃথিবী এই শিশুদের জন্য। তাই এই বাসউপযোগী পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে বলার অধিকার অবশ্যই শিশুদের রয়েছে মর্মেও তিনি মন্তব্য করেন। উক্ত সমাবেশে মিরপুর আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষার্থী সায়েম হাসান সত্য তার বক্তব্যে বলেন, ছুটির দিনে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে মানুষকে সচেতন করতে গুরুত্বপূর্ণ এই কর্মসূচিতে আমরা শামিল হয়েছি। পরিবেশকর্মী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঔপন্যাসিক সাদাত হোসাইনসহ অধিকারকর্মীরা ওই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।
শিশু-কিশোর নেটওয়ার্ক-ন্যাশনাল চিলড্রেন টাস্কফোর্স, গার্ল-গাইডস এবং রোভার স্কাউটের নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনায় শিশুদের এই কর্মসূচি পালনে সহযোগিতা করেছে সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ এবং গ্রিন সেভার্স। উক্ত প্রতিবাদ সমাবেশে পরিবেশ নেত্রী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ধনী দেশগুলোর বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে আজ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশগত নানাভবে বৈরী আচরণ দেখা যাচ্ছে। প্রকৃতির এই বৈরী আচরণ রোধ করতে হলে উষ্ণায়ন কর্মকাণ্ড রোধের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে মর্মে তিনি মন্তব্য করেন।
উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, যে মুহূর্তে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় উন্নত দেশগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির পথে হাঁটতে শুরু করেছে, সে মুহূর্তে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা হচ্ছে। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে বহু লেখালেখি হয়েছে, কথাও হয়েছে অনেক, কিন্তু আমরা পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের বদলে পরিবেশ-বিধ্বংসী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথেই হাঁটছি।
যদিও সরকারের তরফে দাবি করা হচ্ছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলেও এতে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না। এমনকি কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পরিবেশবান্ধব হবে বলেও মন্তব্য করা হচ্ছে। বাস্তবে কতটুকু পরিবেশবান্ধব হতে পারে, যা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু করার পর হয়তো বোঝা যাবে। তবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য বিপুল পরিমাণ কয়লা বিদেশ থেকে আমদানি করা শুরু হয়েছে, এতে যে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটবে, যা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
উল্লেখ্য, পরিবেশ রক্ষার দাবিতে ব্যতিক্রমী এক প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু করেন ১৬ বছর বয়সী এক সুইডিশ শিশু গ্রেটা থানবার্গ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিবাদ জানিয়ে ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে সুইডিশ পার্লামেন্টের বাইরে ‘স্কুল স্ট্রাইক ফর দ্য ক্লাইমেট’ লিখিত একটি প্ল্যাকার্ড হাতে প্রতি শুক্রবার অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। পরে এই আন্দোলন গিয়ে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে কথা বলতে শুরু করেন গ্রেটা থানবার্গ।
তিনি এর নামকরণ করেন ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’। এখন সারা বিশ্বের শিশুদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে এই আন্দোলন। এখন বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ২০ সেপ্টেম্বর থেকে পরবর্তী এক সপ্তাহ পর্যন্ত শিশুদের প্রতিবাদ কর্মসূচি গোটা দুনিয়ায় পালিত হচ্ছে। ফলে এখন জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর নীতিনির্ধারক পর্যায়েও এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।
২০১৮ সালে সুইডেনের শিশু গ্রেটা থানবার্গ যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, তা আজ গোটা দুনিয়ার লাখো লাখো শিশু পালন করছে। শিশুদের আন্দোলনের মূলনীতি হলো, ‘স্কুলের আগে পরিবেশ’। ভবিষ্যৎ শিশুদের বাসউপযোগী পৃথিবী গড়তে গত ২০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশসহ গোটা দুনিয়ার লাখো লাখো শিশু রাজপথে নেমে দাবি তুলেছে। এ কর্মসূচিতে ওয়েলিংটন, সিডনি, টোকিও, হংহং, ব্যাঙ্গালুরু, কিয়েভ, এথেন্স, মাদ্রিদ, রোম, বার্লিন, প্যারিস, লন্ডন হয়ে আটলান্টিকের অপর পাশের যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শহরে তা ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন শহরের প্রশাসন এ দিনের বিক্ষোভকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য নানাভাবে সহায়তা করেছে।
অতিসম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এক অর্থনৈতিক মূল্যায়ন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশেষ স্পর্শকাতর দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার কারণে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে মর্মে প্রকাশিত মূল্যায়নে উল্লেখ করা হয়।
আইএমএফ জানিয়েছে, কয়েকটি সূচকে দেখা গেছে, ১৯৯৮-২০১৭ সাল মেয়াদে গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সে আক্রান্ত শীর্ষ দশ দেশের একটি বাংলাদেশ। উল্লেখ্য, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাবে ১৯৯০-২০০৮ সালের মেয়াদে সম্ভাব্য বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ জিডিপির ১ দশমিক ৮ শতাংশ মর্মেও অর্থনৈতিক মূল্যায়নে বলা হয়।
জাতিসংঘের জলবায়ু-সংক্রান্ত আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্যানেলের বিশেষজ্ঞদের মতে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উপকূলে ভাঙনের কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ জমির পরিমাণ ১৭ শতাংশ এবং খাদ্য উৎপাদন ৩০ শতাংশ কমে যেতে পারে।
পরিশেষে শুধু এটুকুই বলতে চাই, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত প্রতিরোধে সুইডিশ শিক্ষার্থী গ্রেটা থানবার্গের ‘ফ্রাইডেক্স ফর ফিউচার’ নামীয় আন্দোলন যৌক্তিক ও সময়োপযোগী। সে আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শুধু নিউইয়র্ক শহরেই দশ লাখেরও বেশি শিশুকে স্কুল বাদ দিয়ে বিশ্ব শিশু দিবসে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। গ্রেটা থানবার্গ নিজেও নিউইয়র্কের সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন। শিশু-শিক্ষার্থীদের ‘ফ্রাইডেক্স ফর ফিউচার’ মানবিক এ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাসউপযোগী বিশ্ব গড়তে অবদান রাখতে সক্ষম হবে বলে আমাদেরও বিশ্বাস।
আব্দুল হাই রঞ্জু
ব্যবসায়ী ও কলাম লেখক