আতঙ্ক থেকে আশার আলো
জাহাঙ্গীর আলম সরকার
🕐 ৯:০০ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ০৫, ২০১৯
সম্প্রতি বাংলাদেশে মশা নিয়ে একটি ভিতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। যে মশাকে নিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্ম হয় তার নাম এডিস মশা। এডিস মশাই ডেঙ্গু রোগের জীবাণু বহন করে। এ রোগের বিষয়ে এমন আতঙ্ক নিকট-অতীতে দেখা যায়নি। বাংলা ১২৭৯ সালে ডেঙ্গু জ্বরের পাঁচালী পাঠে আমরা ডেঙ্গু জ্বরের অতীত ইতিহাস জানতে পেরেছি।
মহেশচন্দ্র দাস-এর গীতে চমৎকারভাবে উঠে এসেছে ডেঙ্গু প্রসঙ্গটি। যথা-এবার পৃথিবী গেল রসাতলে। ধরণী কিবল ভাসছে জলে। ওগো অকস্মাৎ বিধি, দিলেন কি ব্যাধি, মরিতেছে ডেঙ্গু জ্বরানলে। কত মরে গরু ঘোড়া, ভাসছে সব যোড়া যোড়া, পশু পক্ষী আদি কোরে। ওগো শত শত নর, গেল যমঘর, মহেশচন্দ্র চন্দ্র দাসে বলে। ডেঙ্গু রোগ যে নতুন নয় সে বিষয়টি পরিষ্কার।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ডেঙ্গু জ্বর এতটাই ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করেনি; ইদানীং যতটা করেছিল। তবে সবকিছু সামলে নিয়ে ভয়াবহ আতঙ্ক থেকে আশার আলোর জন্ম হয়েছে।
ডেঙ্গু মশার বিষয়টি এতটাই স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সবাই বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। ইতোমধ্যে প্রায় ১০০ জন লোক মৃত্যুবরণ করেছেন। হাজার হাজার মানুষ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। হাসপাতালগুলো রোগী দিয়ে ঠাসা। দাঁড়ানোর জো নেই কোথাও।
এমন একটি পরিস্থিতেও রাজনৈতিক দলের নেতারা বিষয়টি নিয়ে পরস্পরকে দোষী সাব্যস্ত করে বক্তব্য দিতে ভুলে যাননি। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালিয়েছে। শুধু তাই নয় বরং সমাজকর্মীরা সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ডেঙ্গু সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। ফলে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মাত্রার আলোচনা অদ্যাবধি চলমান।
আলোচনার শুরুতেই সবাই কয়েকটা শব্দকে নিজেদের মনের ভেতরে নিয়েছিল। আর সেগুলো হলো-ভয়, সন্দেহ এবং মৃত্যু। আর আজ দেখা যাচ্ছে সেগুলো হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিকরণ, সমাজ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, মৃত্যুকে জয় এবং আশা।
আশা আমাদের প্রত্যেকের অন্তরে থাকে। আশাবাদী হয়ে এসব শক্তিশালী সম্পদকে আমরা সংগ্রহ করতে চাই।
সাধারণ মানুষ এক বুক আশা নিয়ে তাদের সম্পদ ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সাহায্য করলে বাংলাদেশকে বদলে দেওয়া যাবে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যখন কোনো অসংগতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়, তখন যেকোনো পরিস্থিতিও বদলে ফেলা যায়। এই নতুন শব্দগুলো সবার চিন্তাশক্তি ও আবেগকে প্রস্ফুটিত করতে সাহায্য করবে। এই ছোট্ট শব্দগুলো সমগ্র দেশে এডিস মশার প্রকোপ তথা উন্নয়নের ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলেছে, সে সম্পর্কে জানতে সাহায্য করবে। সমাজকর্মী, রাজনৈতিক কর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষরা শুধু দর্শক হিসেবে না থেকে কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়, সেই কাজে নেমে পড়ল।
এই রোগের ফলে সৃষ্ট দুর্ভোগ ও ক্ষতির বিরুদ্ধে তারা কাজ শুরু করল। এসব লোক শুধু অন্যের আশা নিয়েই ছিল না বরং তারা নিজেদের নিয়েও ভাবছিল। ফলে বাড়ি-ঘর, স্কুল-কলেজ, রাস্তা-ঘাট পরিষ্কার করে তারা।
নিজস্ব অধিকার বজায় রাখার জন্য ব্যক্তিগত পর্যায়ের কাজ শুরু হয়েছিল। এডিস মশা সম্পর্কে ভয়, আতঙ্ক কখনো দূর হবে না। কিন্তু প্রতিটি প্রয়োজনের মুহূর্তে অসহায়ত্ব ও সমস্যার বোঝা আরেকজনের কাঁধে চাপিয়ে দিলে চলবে না। গঠনমূলক সত্য তথ্য এডিস মশা সম্পর্কে সরবরাহ করা অপরিহার্য। ডেঙ্গু রোগের প্রকৃত ব্যবস্থাপনায় সবার মাধ্যমে দেখাশোনা, সচেতনতা ও নিয়ন্ত্রণ সমন্বয় করা প্রয়োজন। এটা একটা বহুবিষয়ক প্রকৌশল।
বহু সমস্যার সমাধান নানাবিধ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে করা সম্ভব। ডাক্তারি চিকিৎসা ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর জন্য প্রয়োজন। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই দরকার সহযোগিতা ও পরামর্শ, যখন একজন আক্রান্ত মানুষ তার পরিবারকে এ বিষয়ে জানাতে যাচ্ছে। তার পরিবর্তে একটা পরিবারকে জানাতে হবে ভবিষতে তাদের কী করা উচিত এবং সমস্যাকে কীভাবে নিজেদের ও সমাজের প্রয়োজনে সম্ভাবনায় রূপান্তরিত করা যায়। সচেতনতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। এডিস মশা সবার ওপর খারাপ প্রভাব ফেলে। তাই আমাদের প্রয়োজন সবাইকে এ বিষয়ে জ্ঞাত করে তাদের সঙ্গে সমঝোতায় আসা। এর মাধ্যমেই আমাদের ভবিষ্যতের সুফল পেতে পারি।
ভবিষ্যতের সুফল পেতে হলে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সবার ব্যবহার-বিধির পরিবর্তন আনতে হবে। শুধু তাই নয়; চিন্তার সচলতা বাড়াতে হবে। আর সেটা আনতে হবে প্রতি পরিবারে, সমাজে, এমনকী সম্পূর্ণ জাতিতে। আর তাই যেদিন এই ব্যবহারের পরিবর্তন আসবে, সেদিন থেকে উন্নয়নের একটি আলাদা মাত্রা যোগ হবে। এই উন্নয়নের প্রধান শর্ত-সচেতনতা ও বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাস অর্জন করতে হলে একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে প্রকৃত সেবা দিয়ে পরীক্ষা করা দরকার। সমাজের ব্যাপক পরিসরে এই অন্তর্ভুক্তীকরণ যতই ছড়াচ্ছে, ততই সাধারণ মানুষের মধ্যে এক প্রকার শক্তি বাড়ছে, বাঁচার প্রেরণা বাড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটছে।
বিশেষ করে এবারের ডেঙ্গু মশার কারণে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির জন্ম হয়েছিল, সেই পরিস্থিতিতে এই প্রক্রিয়া রাজনীতিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে, রাজনৈতিক নেতা যারা সত্যে বিশ্বাসী, তাদেরও তারা অন্তর্ভুক্ত করছে। এখানে অন্তর্ভুক্তীকরণ বলতে বোঝায়, এটা একটা অতি ব্যক্তিগত অংশীদারিত্ব। অর্থাৎ এর মাধ্যমে মানুষে মানুষে সম্পর্ক নষ্ট না হয়ে সেটা রক্ষা পায়। এর অর্থ হলো, একজনের ওপর সমস্ত বোঝা না রেখে সেটা বিভিন্ন মানুষের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া।
এডিস মশা সম্পর্কিত পরামর্শ বা উপদেশমালা তৈরি করার একটি প্রধান শর্ত হচ্ছে সামাজিক সচেতনতা। সামাজিক পর্যায়ে উপদেশ মানার প্রভাব মূলত নির্ভর করে উপদেশগুলো সমাজকেন্দ্রের কতটা কাছাকাছি পৌঁছেছে তার ওপর। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে একটি স্বার্থক উপদেশমালা তখনই তৈরি হবে, যখন এই উপদেশমালা তৈরির প্রক্রিয়াতে যাদের জন্য তৈরি করা হচ্ছে শুধু তারাই অংশগ্রহণ করবে। ডেঙ্গু রোগের প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য হতে হবে আশাকে নিরাশায় পর্যবসিত না করা।
আজ সময় এসেছে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে গ্রামে প্রচলিত স্বাস্থ্যসেবা এবং কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ক্ষমতাকে নিজেদের মধ্যে গ্রহণ করার। এটিই হচ্ছে স্বাবলম্বী হওয়ার সত্যিকারের পথ। কারণ কাজ করার ক্ষমতাকে তখনই সবাই বিশ্বাস করে, যখন আত্মবিশ্বাস জন্ম নেয় এবং অংশগ্রহণ শুরু করে।
আমরা যদি সৎ হই, তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, যে সব সমস্যা আমাদের জীবনের ওপর প্রভাব ফেলে, তাকে আমরা অস্বীকার করি অথবা এড়িয়ে চলি। এটা জাতির ক্ষেত্রে সত্য, যখন তারা ডেঙ্গু রোগের মুখোমুখি হয়। সৎ স্বাভাবিকীকরণের মধ্যে রয়েছে সম্মানজনক বাছাই করার ক্ষমতা, কষ্টকে মেনে নেওয়া। এর মধ্যে আছে গ্রহণ ও সামাজিকতার ক্ষমতা।
জীবন নির্মাণের মৌলিক উপাদান হচ্ছে আশা। একটি সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এর পরিমাপ করা সম্ভব। সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে উন্নয়নের জন্য এই কর্মসূচি। যেমন আছে তেমনিভাবে একে বাস্তবায়িত করতে হবে। অদৃশ্য ভবিষ্যতের জন্য শক্তির উৎপাদন হয় কর্মের মাধ্যমে। অদৃশ্যে বিশ্বাস আরেক ধরনের আশা। অনেক সময় আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনের দুঃখ-বেদনা মেনে নেওয়াকে বলা হয়ে থাকে নিয়তি-নির্ভরশীলতা। এটা সত্য নয়। এই মেনে নেওয়াটাই ভবিষ্যতে বিশ্বাসে রূপ নিতে পারে।
জীবন রহস্যময়-এ কথা বিশ্বাস করার মতো সাহসের মধ্যেই রয়েছে আশা। আশা হচ্ছে সেই জ্ঞান, যার দ্বারা আমরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারি। ভীতি থেকে আশাভিমুখী যাত্রাই হচ্ছে অচলতা থেকে কর্মাভিমুখী হওয়া। প্রকৃত কাজের সূত্রপাত হয় যখন সে বিশ্বাস করে, এর একটি সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য সমাধান রয়েছে। এ এক আশ্চর্য রহস্যময়তা! কোনো বিশেষ কারণে ডেঙ্গুর আগমন ঘটেনি। কিন্তু এর সহায়তায় আমরা বিদ্যমান সমস্যার একটি সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে পারি। আর এভাবেই বাংলাদেশ আতঙ্ক থেকে আশার আলো খুঁজে পাবে।
জাহাঙ্গীর আলম সরকার : আইনজীবী ও প্রাবন্ধিক
[email protected]