সংকটে অবিচল কাণ্ডারি
ড. মিল্টন বিশ্বাস
🕐 ৯:১৩ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৯
২৮ সেপ্টেম্বর জন্মদিনের আগেই বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষণা সংস্থা দ্য স্ট্যাটিসটিক্স শেখ হাসিনাকে বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করেছে। জনগণের আস্থার কারণেই এ অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। তাছাড়া জাতিসংঘের উন্নয়নের সব সূচকে বাংলাদেশ তার লক্ষ্য পূরণ করে এগিয়ে আছে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশের অসামান্য সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
গ্লোবাল অ্যালায়েন্স নামে খ্যাত আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাক্সিনেশন অ্যান্ড ইমুনাইজেশন (জিএভিআই) ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সদর দফতরে তাকে এই পুরস্কার প্রদান করে। আমরা জানি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা নিয়ে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার অধীনে ইমুনাইজেশনে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয়ও রয়েছে তার। উল্লেখ্য, ৭ জানুয়ারি ২০১৯ এদেশের জন্য একটি ‘ঐতিহাসিক ক্ষণ’ বিস্ময় নিয়ে দেখা দিয়েছিল। ওইদিন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা হন হ্যাটট্রিকসহ চারবারের প্রধানমন্ত্রী। দীর্ঘ সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের রেকর্ড গড়েছেন তিনি।
২.
১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মহাকালের রথের আরোহী ও অমৃতের সন্তান শেখ হাসিনার জন্ম। বিশ্বের অন্যতম উন্নয়নশীল দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েও গত ১০ বছরে শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জনের ক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ সম্ভব। তিনি নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে চলেছেন জনমানুষের কল্যাণে। বিশ্বের সেরা প্রভাবশালী নারী নেতাদের তালিকায় রয়েছেন এবং অতীতে নিউইয়র্ক টাইমস সাময়িকীর অনলাইন জরিপে বিশ্বের সেরা দশ ক্ষমতাধর নারীর মধ্যে ষষ্ঠ স্থানে ছিলেন। ক্ষমতাধর এশীয় নারীদের তালিকায় তিনি শীর্ষে অবস্থান করছেন। ২০১৯ সালে তিনি বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রী। অতীতে বিএনপি-জামায়াত জোটের সন্ত্রাস মোকাবেলার সাফল্যেই শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থা বেড়ে যায়। যার ফল হলো ৩০ ডিসেম্বরের (২০১৮) নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হওয়া। এছাড়া অর্থনৈতিক অগ্রগতি, অবকাঠামো নির্মাণ, জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমন, ধর্মনিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বর্তমান সরকারের প্রতি সমর্থন বেড়েছে। এ পর্যন্ত কোনো হামলা-হুমকি ও বাধা শেখ হাসিনাকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি। অকুতোভয় সাহসী জননন্দিত শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ আজ সারাবিশ্বে উন্নয়নের মডেল হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। তার রাজনৈতিক ভূমিকার কারণেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বাপরিসরে নতুন মর্যাদায় অভিষিক্ত।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে শাসন ক্ষমতায় বিশেষত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংসদ বা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে অনেক নারী রাজনীতিক এসেছেন কিন্তু তারা কেউই কোনো দলের শীর্ষ নেতৃত্ব গ্রহণ করতে পারেননি বা ভিন্ন কোনো রাজনৈতিক দর্শন দাঁড় করাতে সক্ষম হননি। জাতীয় নারী নেতৃত্ব বলতে জোহরা তাজউদ্দীন, বেগম মতিয়া চৌধুরী, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, বেগম রওশন এরশাদ প্রমুখের নাম বারবার উচ্চারিত হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রিত্ব না থাকলেও শেখ হাসিনা সাহসী রাজনীতিক হিসেবেই জনগণের কাছে নমস্য। কারণ তিনি এদেশের রাজনীতির ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর যোগ্য তনয়া হয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন, কখনও বিরোধীদলীয় নেত্রী হয়ে সাংগঠনিক কর্মতৎপরতার মাধ্যমে দলীয় নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করেছেন; আবার কখনও বা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে মানুষের ভাত ও ভোটের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট হয়েছেন। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন প্রথমবারের মতো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৯৬-২০০১ পাঁচ বছর ছিল স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল সময়। এ সময়কালের মধ্যে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, ১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু (যমুনা) সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা, ১৯৯৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করাসহ অনেক খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়। এ সময় দ্রব্যমূল্য ছিল ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। কৃষকের জন্য ন্যায্যমূল্যে সার-বীজ সরবরাহ এবং সেচ সুবিধা সম্প্রসারণের ফলে দেশ প্রথমবারের মতো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। প্রায় ২৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। প্রথম মোবাইল ফোন প্রযুক্তির বাজার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং উল্লেখযোগ্য হারে কর সুবিধা প্রদান করা হয়। বেসরকারি খাতে টেলিভিশন চ্যানেল অপারেট করার অনুমতি প্রদান করে আকাশ সংস্কৃতিকে তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। পিতার সঙ্গে মাতার নাম লেখা বাধ্যতামূলক করা হয়। কম্পিউটার আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক হ্রাসকরণের দ্বারা সাধারণের জন্য তথ্যপ্রযুক্তির সুযোগ অবারিত করে দেওয়া হয়। ১৯৯৬-২০০১-এর মতো ২০০৯-২০১৮ সাল পর্যন্ত ব্যাপক উন্নয়নের ফিরিস্তি এখানে উপস্থাপন করা যায়। কিন্তু সেই প্রয়াস না করে কেবল শেখ হাসিনার ‘ধরিত্রী কন্যা’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া সম্পর্কে এখানে কিছু বলা হলো।
৩.
প্রকৃত অর্থে ‘আমার বাংলাদেশ, আমার ভালোবাসা’ এই অমৃতবাণী বাংলাদেশের একজনই উচ্চারণ করেছেন। তিনি নানা বিশেষণে বিশেষায়িত। সততা, নিষ্ঠা, রাজনৈতিক দৃঢ়তা; গণতন্ত্র, শান্তি, সম্প্রীতি ও বিশ^ভ্রাতৃত্বের অনন্য রূপকার আর মানবকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ- তার চেয়েও আরও অনেক কিছু তিনি। দরদী এই নেতা দুঃখী মানুষের আপনজন; নির্যাতিত জনগণের সহমর্মী তথা ঘরের লোক। তিনি বলেছেন, ‘বাবার মতো আমাকে যদি জীবন উৎসর্গ করতে হয়, আমি তা করতে প্রস্তুত।’
শান্তির অগ্রদূত শেখ হাসিনা দেশের মানুষের জন্য নিজের প্রাণকে তুচ্ছ করতে পারেন নির্দ্বিধায়। সাধারণ মানুষের আস্থা ও ভরসার কেন্দ্রবিন্দু তিনি। এজন্য তার অনুপস্থিতি কারও কাম্য হতে পারে না। ধৈর্য ও সাহসের প্রতিমূর্তি শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের মানসকন্যা, দেশরত্ন, কৃষকরত্ন, জননেত্রী- বহুমাত্রিক জ্যোতিষ্ক। তাকে কেন্দ্র করে, তার নেতৃত্বে আবর্তিত হচ্ছে বাংলাদেশের সবকিছু।
মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাস্তবতায় ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে আমেরিকার রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। এ ধরনের মন্তব্য করেই ক্ষান্ত হননি তারা, বিভিন্ন দেশ ও সংস্থাকে পরামর্শ দেন বাংলাদেশকে কোনো প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা না করার। তাদের বিরোধিতা ও ষড়যন্ত্রের পরও বাংলাদেশ আজ বিশেষ অবস্থানে পৌঁছেছে। এ কারণে শেখ হাসিনার শাসনামলেই কিসিঞ্জার-পরবর্তী নেতৃবর্গ ভিন্ন সুরে কথা বলছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশকে বিশে^র মডেল এবং বাংলাদেশস্থ সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মাজেনাসহ বিশ্বের অনেকেই ‘এশিয়ার টাইগার’ বলে মন্তব্য করেছেন। তারা উভয়ে এ ধরনের মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছেন বাংলাদেশের নানামুখী সাফল্য ও উন্নয়নের জন্য। আজকে বাংলাদেশ যে অবস্থানে দাঁড়িয়েছে এটা হিলারি ও মাজেনার পূর্ব-পুরুষরা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেননি। গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগের সাফল্যের কারণে মার্কিন কংগ্রেসের শুনানিতে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেক বলেছেন, বাংলাদেশ এশিয়ার একটি মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ শুনানিতে ডেমোক্রেটিক কংগ্রেসম্যানরা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেন।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূতরা বলেছেন- বাংলাদেশের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এদেশ হবে বিশ্বের অন্যতম রপ্তানিকারক দেশ, বিশেষ করে ওষুধ শিল্প, তৈরি পোশাক, তথ্যপ্রযুক্তি, হিমায়িত মাছ রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ হবে এশিয়ার টাইগার। তাদের মতে, কৃষি এবং শিক্ষা খাতে বাংলাদেশে বিপ্লব হবে। অন্যদিকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বাংলাদেশকে ‘নাম্বার ওয়ান উন্নয়নমুখী দেশ’ বলেছেন। এসব অর্জন সম্ভব হয়েছে জনগণের প্রতি শেখ হাসিনার অঙ্গীকারদীপ্ত নেতৃত্বের জন্য। ২০১৭ সালে ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে এদেশে আশ্রয় দেওয়ায় বিশ^বাসী এখন তার মানবিক আচরণে অভিভূত।
বর্তমান প্রজন্মের কাছে শেখ হাসিনা এক আশ্চর্য সাহসী রাজনীতিকের নাম; যার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় ভবিষ্যতের বাংলাদেশ উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে চলেছে। তাছাড়া শেখ হাসিনাবিহীন যুদ্ধাপরাধের বিচার ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। এজন্য তরুণ প্রজন্ম ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি-জামায়াত তথা ঐক্যফ্রন্টকে। আবার নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতার বীভৎস চিত্র গণমানুষকে আতঙ্কিত করে তোলায় তারা আওয়ামী লীগের ধারাবাহিকতায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে। এদিক থেকে ৩০ ডিসেম্বরের (২০১৮) নির্বাচন আরও বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
৪.
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে আগামী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে- এটা নিশ্চিত। তাই আওয়ামী পরিবারের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে সব অশুভ শক্তির মোকাবেলা করতে হবে। সামনে বাধা এলে তা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবেলায় সচেষ্ট থাকতে হবে। ’৭১-এর পরাজিত শক্তিরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে দেশের স্বাধীনতা ও স্বপ্নকে হত্যা করতে চেয়েছিল। শেখ হাসিনা জীবিত রয়েছেন। তিনিই তার পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ’৭১-এর পরাজিত শক্তিরা বসে নেই; ষড়যন্ত্রকারীরা নতুন নতুন ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে। তাই সবাইকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আর মহাকাল তার নেতৃত্বকে স্মরণ করবে শ্রদ্ধাভরে।
ড. মিল্টন বিশ্বাস : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দফতর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]