ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আইন এবং নারী ও শিশুর অধিকার

জাহাঙ্গীর আলম সরকার
🕐 ৯:৩১ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৯

যে সমাজে নারী ও শিশুদের নির্যাতিত হতে হয়, সেখানে আইনের গতি স্থিতাবস্থায় থাকলে প্রভাবশালী অপরাধীরা দুর্বল নারী ও শিশুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। যথাযথ আইনের অভাবে মানবিক আত্মা ও দেবশিশুদের প্রতি অবিচার করা হয়। সঙ্গত কারণেই নারী ও শিশুদের অধিকার সংরক্ষণ ও ন্যায়বিচার সমুন্নত রাখার জন্য দেশটিতে একটি পৃথক ও নতুন বিশেষ আইনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। সংবিধানেই উল্লেখ রয়েছে-নারীর জন্য রাষ্ট্র বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারবে। সংবিধানের ১৯ (৩) নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, ‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবেন।’ সংবিধান ও আইন মান্য করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। সংবিধানের তৃতীয় ভাগের মৌলিক অধিকার অংশে ২৮(৪) অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, ‘নারী ও শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’

আইনের মধ্য দিয়ে নির্যাতিত নারী ও শিশুর অধিকার ও শৈশবের বিশেষ মর্যাদাকে স্বীকৃতিদানের একটি প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে এবং সময় যত এগিয়ে যায়, তত তা তাৎপর্যপূর্ণ গতি লাভ করে। চিরকালই নারী ও শিশুরা নির্যাতিত ও নিপীড়িতদের তালিকায় ছিল। কাজেই জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণ কখনো সফল হবে না, যদি না নারীদের সুরক্ষা প্রদান করা যায়।

কল্পনা করুন, একশ্রেণির মানুষকে নিয়মিত নিগ্রহ, ধর্ষণ, অপহরণ, যৌন নিপীড়ন, এমনকি হত্যারও শিকার হতে হয় শুধু এজন্য যে, তাদের জন্ম হয়েছিল একটি বিশেষ শ্রেণিতে। ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মানবাধিকারের ভিত্তিতে নারীর জীবন ও শৈশবের একটি নতুন সংজ্ঞা প্রতিফলিত হয়েছে। এ আইন প্রথম একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে, যা নারী ও শিশু সংশ্লিষ্ট সার্বজনীন এক অনন্য দলিলে একীভূত করেছে।

‘আইন না জানা কোনো অজুহাত নয়’-এটি একটি প্রচলিত প্রবাদ বাক্য। আইন সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করার অর্থ হলো অধিকার সম্পর্কে অবহিত হওয়া। নারীর ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদা সংরক্ষণে আইনের ভূমিকা ব্যাপক। সে কারণে দেশের সংবিধানসহ প্রচলিত আইনে নারীদের অধিকার সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা রয়েছে। নারীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তির সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে আইনের সংশোধন হয়েছে। এ ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন নীতিমালার মাধ্যমে নারীদের সুযোগ সম্প্রসারিত হয়েছে।

এই আইনের ক্ষেত্রে যে প্রত্যয় সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, নারী নির্যাতন ও সহিংসতামুক্তভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার অঙ্গীকার। সমাজ ও পারিবারিক পর্যায়ে প্রভাবশালী অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। কেউ যদি পরিবারের অভ্যন্তরে বা বাইরে নারী ও শিশুর ওপর নির্যাতন করে, তবে সাধারণ জ্ঞানে এটা স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির নিজস্ব ব্যাপার বলে মনে হতে পারে। এর মধ্যে থানা, পুলিশ, আইন, আদালত কিংবা রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন কী? অবশ্যই প্রয়োজন আছে, আইনেরও দরকার আছে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক রক্ষার জন্য কিংবা শিশুদের সুরক্ষার জন্য যদি আইন না থাকত এবং রাষ্ট্র যদি এই আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে এগিয়ে না আসত, তবে পরিবার ও সমাজে নিদারুণ বিপর্যয় নেমে আসত। যেখানে অধিকারের প্রশ্ন সেখানেই আইনের প্রসঙ্গ জড়িয়ে রয়েছে।

বাংলাদেশে নির্যাতনমুক্ত পরিবেশ ও উন্নততর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন একটি যুগান্তকারী আইন। এতে অভিন্ন মূল্যবোধের মাধ্যমে বাংলাদেশের সর্বাধিক দুর্বল অংশ অর্থাৎ নারী ও শিশুর সুরক্ষার জন্য দেশটির সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। এই আইনের মাধ্যমে আমাদের দেশের নারী ও শিশুদের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার পাওয়ার রাস্তা প্রসারিত হয়েছে। পাশাপাশি তাদের জীবনযাত্রার একটি সুন্দর মান নিশ্চিত হয়েছে। বিগত প্রায় দুই দশকে বাংলাদেশে নারী ও শিশুদের প্রতি দীর্ঘদিনের অপ্রতিরোধ্য নির্যাতনের মাত্রাও কমে আসতে শুরু করেছে।

আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ এমন একটি দেশ হবে, যেখানে নারী ও শিশুরা সুরক্ষিত থাকবে, ন্যায়বিচার সমুন্নত হবে এবং পরিবারের অভ্যন্তরে স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে অন্যরা তাদের ঘিরে রাখবে। শিশুদের ক্ষেত্রে প্রতিপালনকারী প্রাপ্তবয়স্করা শিশুদের পূর্ণ সম্ভাবনায় নির্যাতনমুক্তভাবে বেড়ে উঠতে ও বিকাশ লাভে সহায়তা করবেন। উপরের এসব সম্ভাবনাকে সামনে রেখেই ২০০০ সালে আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল।

এ পর্যায়ে এটি স্বীকার করতে হয় যে, প্রায় দুই দশক পর বাংলাদেশের নারী ও শিশুরা সাংঘাতিক অরক্ষিত অবস্থা থেকে সুরক্ষিত পরিস্থিতির দিকেই ধাবিত হচ্ছে। এটি একটি আশার কথা। ধর্ষণ, যৌতুক, অপহরণ ইত্যাদি অপরাধের জন্য অভিযুক্তদের বিচারের কাঠগড়ায় হাজির করার ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রাইব্যুনাল হিসেবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুন্যালের প্রতিষ্ঠা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিরাট গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। বাংলাদেশে এ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার পর নারী ও শিশুদের ওপর নির্যাতনের মতো বর্তমান সমাজের সাংঘাতিক অপরাধগুলো হ্রাস পেতে শুরু করেছে।

এত কিছুর পরও কিছু হতাশাজনক চিত্রও রয়েছে। ২০০০ সালের পর হতে অদ্যাবধি বাংলাদেশে আলোচ্য আইনের অধীনে প্রচুর মামলা দায়ের হলেও নিষ্পত্তির হার কম। আর যে সব মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, তন্মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা নগণ্য বৈকি। বিশাল মামলার মধ্য থেকে অল্পসংখ্যক অভিযুক্ত ব্যক্তির সাজা হওয়া এবং অধিকাংশ অভিযুক্ত ব্যক্তির খালাশ পাওয়ার ঘটনা আমাদের একটি নেতিবাচক বার্তা প্রেরণ করে। আর তা হচ্ছে মিথ্যা মামলা দায়ের কিংবা আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে কি না? বিষয়টি নিয়ে ভাববার অবকাশ রয়েছে।

সুরক্ষামূলক পরিবেশ সৃষ্টির অনেক দায়িত্ব সরকারের ওপর ন্যস্ত থাকলেও রাষ্ট্রের নাগরিকদেরও দায়িত্ব রয়েছে। নারী ও শিশুর উপযোগী পরিবশে গঠনের মূল চাবিকাঠি হচ্ছে দায়িত্ববোধ। সেই দায়িত্ববোধের সৃষ্টি হয় আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমেই শিশুদের সহিংসতা, নির্যাতন এবং শোষণ থেকে সুরক্ষার জন্য আইন বিষয়ে ধারণা অর্জনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের নাগরিকরাই অবদান রাখতে পারেন। ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন করার প্রয়োজন এই কারণে হয়েছিল, বাংলাদেশে নারী ও শিশুদের প্রতি নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছিল। কাজেই এই আইন একটি বিষয় সুস্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, আমরা যে আদর্শ প্রত্যাশা করি, দেশের সব নারী ও শিশুর প্রায় অর্ধেকের ক্ষেত্রে জীবন ও শৈশবের প্রকৃত পরিস্থিতি তা থেকে সম্পূর্ণরূপে ও নির্মমভাবে ভিন্ন।

নির্যাতন নারী ও শিশুদের তাদের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করে এবং তাদের সম্ভাবনা সীমিত করে দেয়। ঘরে-বাইরে নৈমিত্তিক নির্যাতন, সংঘাত এবং সহিংসতা তাদের কাছ থেকে নিরাপদ পারিবারিক জীবন ছিনিয়ে নিচ্ছে। তাদের আস্থা ও আকাক্সক্ষার সঙ্গে প্রতারণা করছে। ক্ষেত্র বিশেষে যৌতুকের দাবি, ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধমূলক কর্মকা-ের মাধ্যমে আমাদের দেশে নারী ও শিশুরাই অধিক জীবন দিচ্ছে।

বাংলাদেশে নারীর জীবন ও শিশুর শৈশব এত বেশি হুমকির মুখে থাকায় আমাদের সম্মিলিত ভবিষ্যৎ আপসের সম্মুখীন। কাজেই এ আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমেই নারী ও শিশুর সুরক্ষার বিষয়টিকে প্রাসঙ্গিক করা যেতে পারে। আইনের অপব্যবহার রোধ করতে না পারলে আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। শুধু তাই নয়; বরং আমরা এ আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে যখন সব নারী ও শিশুর অধিকার অর্জনের আরও কাছাকাছি এগিয়ে যাব, শুধু তখনই বাংলাদেশ উন্নয়ন ও শান্তির লক্ষ্যের আরও কাছাকাছি এগিয়ে যাবে।

নির্যাতন উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি বিশাল প্রতিবন্ধকতা, যার শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া আগামী প্রজন্ম ও সাধারণভাবে সমাজের ওপর পড়বে। দেশের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করা ও মানব নিরাপত্তার উদাহরণ রচনার জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে সব ধরনের নির্যাতন আর সহিংসতার অবসান ঘটানো অপরিহার্য। এর মধ্য দিয়ে ঘরে এবং বাহিরে-সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারী ও শিশুর জীবনকে নিরাপদ করা সম্ভব। আর এটা ছাড়া বাংলাদেশের অগ্রগতির ধারণা এক নিছক কল্পনা মাত্র।

অবশ্য নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের বিষয়ে দ্বার অর্গলমুক্ত করার ব্যাপারটি যেন এমন একটি বিশাল কালো প্রকোষ্ঠের চৌকাঠে দাঁড়ানো, যার ভেতরটা সম্মিলিত যন্ত্রণায় প্রকম্পিত হচ্ছে। যদিও প্রতিবাদের ধ্বনি রুদ্ধ হতে হতে একটি ছোট্ট গুঞ্জনে পরিণত হচ্ছে। যেখানে অসহনীয় স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ধিক্কার থাকা উচিত, সেখানে আসছে বরং অস্বীকৃতি এবং গতানুগতিক ধারাকে বহুলাংশে নিষ্ক্রিয়ভাবে মেনে নেওয়ার ব্যাপারটি।

নারী ও শিশুরা যেকোনো রাষ্ট্রের উন্নয়নের অপরিহার্য একটি শর্ত। তাদের ভালো থাকা ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার ওপর নির্ভর করে একটি দেশের উন্নতি ও অবনতি। সে কারণে এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যাতে নারী ও শিশুদের জন্য উপযুক্ত দেশ গড়ে তোলা সম্ভব হয়। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আরও একধাপ এগিয়ে নিতে হলে দরকার আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ও সমন্বিত উদ্যোগ। আমরা আজ যেখানে আছি, সেখান থেকে যাত্রা শুরু করে যদি নিয়মিত নারী ও শিশুদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করি, তথাপিও আইনের প্রয়োগ ব্যতীত সে রকম একটি বাংলাদেশে রাতারাতি পৌঁছে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই সার্বিক বিবেচনায় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।

জাহাঙ্গীর আলম সরকার : আইনজীবী ও প্রাবন্ধিক
[email protected]

 
Electronic Paper