ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পত্রিকা শুধু এক টুকরো কাগজ নয়

এহসানুল মাহবুব লাব্বী
🕐 ৯:৪৬ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৯

নিউজপেপার অলিম্পিয়াডের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এহসানুল মাহবুব লাব্বী। উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়েন রংপুর সরকারি কলেজে। অল্প বয়সে জাতীয় পর্যায়ে সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন প্রথম নিউজপেপার অলিম্পিয়াড। যুক্ত করেছেন দেশের ৩৯টি জেলার প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থীকে। নিউজপেপার অলিম্পিয়াড ও তার স্বপ্ন নিয়ে কথা বলেছেন এহসানুল। সঙ্গে ছিলেন ছাইফুল ইসলাম মাছুম

নিউজপেপার অলিম্পিয়াডের শুরুর গল্পটা জানতে চাই?
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক অলিম্পিয়াড আছে, অথচ সংবাদপত্র নিয়ে কোনো অলিম্পিয়াড নেই। তখন ভাবলাম, আমরাই শুরু করতে পারি নিউজ পেপার অলিম্পিয়াড। অলিম্পিয়াডকে বাস্তবে রূপ দিতে কাজ শুরু করি। প্রথমে মাত্র ১২০ টাকা দিয়ে নিউজ পেপার অলিম্পিয়াডের যাত্রা শুরু করি। সেই টাকা দিয়ে পরিচিত এক প্রেস থেকে কিছু ফরম ছাপিয়ে নিই। আর ফেসবুকে অলিম্পিয়াডের ঘোষণা দিই, ভালো সাড়াও পাই। দুদিনের মধ্যে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৮ জন আগ্রহ দেখিয়ে অনলাইনে ফরম ফিলাপ করেছে। এটা ২০১৮ সালের নভেম্বরের ঘটনা। অবশ্যই আমি ইংলিশ অলিম্পিয়াড, গণিত অলিম্পিয়াডসহ অন্য অলিম্পিয়াডের সঙ্গে যুক্ত থাকায় অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগাই।

৩৯ জেলার ১১ অঞ্চলে অলিম্পিয়াডের কর্মসূচি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কীভাবে এটা সম্ভব হলো?
প্রথমে আমরা কাজ করেছি টিম করে। পরে সাব কমিটি করে দয়িত্ব ভাগ করে দিই। অলিম্পিয়াড পরিচালনার জন্য একটা গঠনতন্ত্র তৈরি করি। অলিম্পিয়াডের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করি। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ছাত্রছাত্রীরা সব কাজ করবে, আমরা একটা শিডিউল করলাম, কোন অঞ্চলে কখন প্রোগ্রাম করব।

প্রথমে আগ্রহী ৭৮ জনকে নিয়ে ফেসবুকে গ্রুপ খুলেছি। সিনিয়র অভিজ্ঞ অনেককে যুক্ত করেছি। ১০ নভেম্বর রংপুরে আমরা রেজিস্ট্রেশন শুরু করি। ১১ নভেম্বর গাইবান্ধা থেকে ফোন পাই, তারা একটা সিলেকশন রাউন্ড করার আগ্রহ প্রকাশ করে। ১২ নভেম্বর গাইবান্ধাতেও রেজিস্ট্রেশন শুরু করি। পালাশবাড়ী নামক জায়গায় আমরা অলিম্পিয়াডের উদ্বোধন করি। উদ্বোধনে ২৫০ শিক্ষার্থী অংশ নেয়। ঢাকাতে অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে আমাদের ৯৮ জন ক্যাম্পাস অ্যাম্বাসেডর যুক্ত করি। এরাই আবার বিভিন্ন জেলার সঙ্গে যোগাযোগে সহযোগিতা করে। এভাবে ধীরে ধীরে সারা দেশের ৩৯টি জেলায় নিউজপেপার অলিম্পিয়াডের কর্মসূচি নিয়ে যাই। তবে এই যোগাযোগের ক্ষেত্রে ফেসবুক অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। রংপুর থেকে অলিম্পিয়াড শুরু করে, ওই অলিম্পিয়াড জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া অনেকটা অসম্ভবই ছিল। তবুও সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় অসম্ভবকে সম্ভব করেছি। অলিম্পিয়াডের কার্যক্রম চলছে প্রায় এক বছর ধরে।

চ্যালেঞ্জগুলো কী কী ছিল?
প্রথমে সবার প্রশ্ন ছিল, ন্যাশনাল অলিম্পিয়াড আসলে কি। এটা বোঝানোই অনেক কষ্ট ছিল। এমনকি আমাদের ক্যাম্পাস অ্যাম্বাসেডর, বিভাগীয় সমন্বয়করা অনেক বিষয়ে জানত না। অর্থায়ন নিয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, আমাদের কোনো স্পন্সর ছিল না, ফলে খরচ জোগাতে আমরা প্রতিযোগীদের কাছ থেকে ১৫০ টাকা করে রেজিস্ট্রেশন ফি নিই, এত বড় আয়োজনে রেজিস্ট্রেশন ফি নিয়ে কোনো জটিলতা হয় কিনা, সেই আশঙ্কা ছিল। যেসব শিক্ষার্থী রেজিস্ট্রেশন করছে তাদের আমরা চিনি না, যারা করাচ্ছে তাদের অনেককেও চিনি না। এখানে বিশ্বাসটা বড় বিষয় ছিল। তবে শুকরিয়া, কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি।
এ ছাড়া শিডিউল ঠিক রাখাটা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।

দেখা গেছে, ১২ ডিসেম্বর গাইবান্ধায় প্রোগ্রাম, আবার ১৪ ডিসেম্বর দিনাজপুরে। একদিনের ব্যবধানে আরেকটা প্রোগ্রাম। আমাদের টার্গেট ছিল ২০১৯ সালের মার্চের মধ্যে সারা দেশের প্রোগ্রাম শেষ করব। এবং মার্চেই ন্যাশনাল রাউন্ড করব। কিন্তু সারা দেশে ব্যাপক সাড়া পাওয়ায় চারটি সিলেকশন অঞ্চল থেকে বেড়ে ১১টি সিলেকশন অঞ্চল হয়ে যায়। ফলে অলিম্পিয়াড শেষ করতে বিলম্ব হয়।

কাজ করতে গিয়ে মজার কিংবা তিক্ত কোনো অভিজ্ঞতা?
আমাদের টিমে এখন ৮৪৩ জন কর্মী আছে। অন্য অলিম্পিয়াডগুলোতে দেখি প্রধান দায়িত্বে যারা থাকেন, তারা কোনো চাপ নেন না কিন্তু আমি চেয়েছি আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে প্রোগ্রামগুলো পারফেক্ট করার জন্য। আমি সব সময় পারফেক্ট চাই। অলিম্পিয়াডের কাজে অনেক সময় আমাকে রাত ১২টা পর্যন্ত প্রেসে কাটাতে হয়েছে। তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে রয়েছে, কেন্দ্রীয় টিমের অধিকাংশ রংপুরে থাকায়, রংপুর থেকে সারা দেশে জিনিসপত্র পাঠাতে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। অনেক জায়গায় প্রোগ্রাম শেষ হয়ে গেছে, অথচ ক্রেস্ট কিংবা মেডেল পৌঁছাতে পারিনি। এমনটা বরিশালে হয়েছে, ফেনীতেও হয়েছে।

আবার মজার অভিজ্ঞতাও আছে। আমি সব সময় সাধারণ পোশাক পরতে পছন্দ করি। চট্টগ্রাম অঞ্চলের সিলেকশন রাউন্ডের প্রোগ্রামে পোশাকের কারণে প্রথমে আমাকে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়েছিল। পরে বিভাগীয় সমন্বয়ক এসে আমাকে ভিতরে নিয়ে গেছে। আরেকটা মজার বিষয় আছে রংপুরে, মা ছেলে প্রতিযোগী হিসেবে একসঙ্গে অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়েছিল।

অলিম্পিয়াড নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা?
অন্য অলিম্পিয়াডগুলো ঢাকা থেকে শুরু হয়। আমাদের অলিম্পিয়াড বাংলাদেশের একমাত্র, যেটা ঢাকার বাইরের কোনো অঞ্চল থেকে শুরু হয়েছে। উদ্বোধন হয়েছিল গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর মতো প্রত্যন্ত উপজেলায়। পরের বছর ইচ্ছে আছে নিউজপেপার অলিম্পিয়াড চরাচঞ্চল বা ইউনিয়ন লেভেল থেকে শুরু করার। প্রথম বার ৩৯ জেলার প্রতিযোগীরা অংশ নিয়েছে, আমরা চেষ্টা করব দ্বিতীয়বার ৬৪ জেলায় আমাদের কার্যক্রম ছড়িয়ে দিতে। আমাদের পরিকল্পনা আছে ৫টা দেশের প্রতিযোগীদের যুক্ত করে একটা আন্তর্জাতিক সিলেকশন রাউন্ড করা।

আপনি কলেজে পড়ছেন, পড়াশোনার পাশাপাশি অলিম্পিয়াডের কারণে বেগ পেতে হচ্ছে না?
পড়ালেখার তো চাপ তো আছেই। আমার বন্ধুরা যখন আড্ডা দিয়ে কিংবা অন্য খারাপ কাজ করে সময় কাটায় তখন আমি এসবে সময় দিই। সাধারণত আমি পুরো দিনের সময়কে ভাগ করে নিই। অন্য শিক্ষার্থীরা রাত ১০টা পযর্ন্ত পড়লে, আমি ১২টা পর্যন্ত পড়ে ওই সময়টা কাভার করে নিই। আর ভাগ করে নিই পড়ালেখার নির্দিষ্ট সময়, সামাজিক সাংগঠনিক কাজের জন্য নির্দিষ্ট সময়। কলেজের স্যাররা প্রথম দিকে সহযোগিতা না করলেও, এখন খুব সাপোর্ট দিচ্ছেন, ফলে সব কিছু সমান তালে চালিয়ে গেলেও কোনো সমস্যা হয় না।

অনেক সামাজিক সংগঠনের সঙ্গেও আপনি যুক্ত আছেন...
জাতিসংঘের ইউনিসেফে তৃণমূল পর্যায়ে কাজের সুযোগ পেয়েছি। বিডি নিউজের হ্যালো সেকশনে কাজ করেছি। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, ধ্রুবতারা সংগঠন, পরিচয় পত্রিকাসহ রংপুরের স্থানীয় অনেক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। এ ছাড়া রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছি। এগুলো আমাকে উদ্যোক্তা হতে সাহসী করে তুলেছে।

পরিবারের সাপোর্ট কেমন পাচ্ছেন?
আমার বাবা রোম্মান হোসাইন পুলিশ অফিসার আর মা মুনমুন আক্তার গৃহিণী। মা আমাকে খুব সাপোর্ট করেন। বাবা জবের কারণে খুব বেশি সময় দিতে পারেন না, তবে আমি জানি, আমি যখন কোনো পুরস্কার পাই, সফল হই, তখন বাবা খুব খুশি হন। অনেক সময় বেশি করে ফেলি তো, তখন মা একটু বকে।

আপনার অর্জনের গল্প শুনতে চাই...
বাংলাদেশ মহাকাশ বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে রানার্স আপ হয়েছিলাম ২০১৬ সালে। বাংলাবিদ প্রতিযোগিতায় রংপুর বিভাগে প্রথম হয়েছিলাম। জাতীয় পাট দিবসের প্রতিযোগিতায় জেলা পর্যায়ে প্রথম হয়েছিলাম।

প্রতি বছর বিভাগীয় রচনা প্রতিযোগিতায় প্রথম অথবা দ্বিতীয় হই। ইউনিসেফের সিলড্রেন সায়েন্স কংগ্রেসে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে ভারতের চন্ডিগড়ে গিয়েছিলাম।

নিউজপেপার অলিম্পিয়াডে অনেক কর্মী আছে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। সিনিয়রদের নেতৃত্ব দিতে সমস্যা হয় না?
মোটা দাগে কোন সমস্যা হয়নি। কেউ কেউ অস্বস্তিতে ভুগেছিল। তবে আমরা আন্তরিকতার মাধ্যমে বিষয়গুলো অতিক্রম করেছি। আমি সিনিয়রদের বলেছি, আমি বস নই, আপনারা আমাকে ছোটভাই মনে করবেন। কোনো ভুল-ত্রুটি হলে দেখিয়ে দেবেন।

১০ হাজার প্রতিযোগীর মধ্যে দেশসেরা পত্রিকা বিশারদের গৌরব অর্জন করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদিয়া শান্তা। এ বিষয়ে বলুন...
১০ হাজার জনের মধ্যে থেকে সেরা পত্রিকাবিশারদকে খুঁজে বের করা সহজ ছিল না কখনোই। যেহেতু পত্রিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়, তাই আমাদের কাজ করতে হয়েছে সাবধানে। আমার একাডেমিক টিমকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। তারা প্রশ্নগুলো বানানোর জন্য রাত জেগে পত্রিকা পড়েছে ও তথ্য সংগ্রহ করেছে। সবচেয়ে মানসম্মত প্রশ্ন যাতে করা যায় এজন্য প্রতি সিলেকশন রাউন্ডের প্রশ্ন বানাতে ১৫ দিনের বেশি সময় লাগত। আর জাতীয় রাউন্ডের প্রশ্নও প্রায় দুই মাস ধরে করা হয়েছে। যতটুকু নতুনত্ব রাখা যায় তার রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। জাতীয় রাউন্ডে এরপরও একজন ৪০ এ ৪০ পেয়েছে। তিনি রাজধানীর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদিয়া শান্তা। নিঃসন্দেহে তিনি দেশসেরা পত্রিকাবিশারদ। এ বাছাই সহজ ছিল না কখনোই, সাদিয়া শান্তা কঠিন পরিশ্রম করেছে বলেই বিজয়ের মুকুট তিনি অর্জন করতে পেরেছেন।

কর্মীদের উন্নয়নে কী পরিকল্পনা রয়েছে?
তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়াও এক্সেঞ্জ প্রোগ্রাম এবং তারা যেন ওয়েভার সুবিধা পায় সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।

নিউজপেপার অলিম্পিয়াড কীভাবে সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে?
অনেকের বাসায় সকাল বেলায় হকার পত্রিকা রেখে যায়। কিন্তু এ প্রজন্মের তরুণরা এতটা পত্রিকাবিমুখ, পত্রিকা সামনে থাকলেও উল্টেও দেখতে চায় না। আমি চাই, তরুণ প্রজন্ম পত্রিকা পড়ুক। আমরা প্রতিযোগীদের বোঝাতে চেয়েছি, নিউজপেপার শুধু এক টুকরো কাগজ নয়, এটা প্রকাশ করতে পেছনের মানুষগুলোর অনেক শ্রম যায়। আমরা চেয়েছি এই অলিম্পিয়াডের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে পত্রিকা পড়তে উৎসাহিত করতে। নিউজপেপার অলিম্পিয়াডের প্রথমবার বিভিন্ন ইভেন্টে ১০ হাজার শিক্ষার্থীকে আমরা যুক্ত করতে পেরেছি। প্রতিযোগীদের সংবাদপত্র পড়তে আগ্রহী করতে পেরেছি। এটাকে ইতিবাচক পরিবর্তন হিসেবেই আমরা ভাবছি। তবে আরও বেশি শিক্ষার্থীকে যুক্ত করতে পারলে পরিবর্তন আরও বেশি হবে।

আপনার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন নিয়ে বলুন...
মহাকাশ বিজ্ঞান আমার ভালো লাগে। আমার ইচ্ছা আছে, রকেট সায়েন্সে পড়া এবং এইচএসসি শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাওয়া।

 
Electronic Paper