ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বাংলাদেশে ব্লু-ইকোনমির ভবিষ্যৎ

মোশারফ হোসেন
🕐 ৯:২৭ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৯

সমুদ্রে সুনীল জলরাশির তলদেশে রয়েছে প্রাণ-প্রাচুর্যের অমিত সম্ভাবনাময় ভরপুর এক ভিন্নজগৎ। বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার বিষয়টি সর্বপ্রথম যিনি ধারণা দেন তিনি হচ্ছেন অধ্যাপক গুন্টার পাউলি। ২০১০ সালে জাতিসংঘের আমন্ত্রণে পরিবেশ-বান্ধব টেকসই সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক রূপরেখা প্রণয়নের সুদূরপ্রসারী ধারণাটি প্রকাশ পায় তার বক্তব্যে।

সমুদ্রের জলরাশি, সমুদ্রসম্পদ ও সমুদ্রকে ঘিরে গড়ে ওঠা অর্থনীতিকে বলা হয় ব্লু ইকোনমি। সমুদ্র অর্থনীতির মূল উপাদান হলো জ্বালানি সম্পদ ও খনিজ, খাদ্যসম্পদ, পানিসম্পদ, পর্যটন শিল্প, পরিবহন ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা। এগুলোর সঠিক ও কার্যকর পরিকল্পনা তথা টেকসই উপায় নিরূপণে সুবিশাল জলরাশির সস্পৃক্ততা অদূর ভবিষ্যতে সুফল বয়ে আনবে। বিশে^র অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও সমুদ্রকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক বুনিয়াদের ভীত মজবুত করতে পারে।

এক্ষেত্রে ঐতিহাসিক সমুদ্র বিজয় সম্পর্কিত কিছু কথা জেনে নেওয়াটা খুব বেশী প্রাসঙ্গিক। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের সীমানা নিয়ে বিরোধ চলে আসছিল প্রায় ৪০ বছর ধরে। ২০০৯ সালের অক্টোবরে জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত এটলাস এজলাসে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে হেগের স্থায়ী সালিশ আদালতের রায়ে ২০১২ সালের ১৪ মার্চ ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর ফলে ১,১৮,৮১৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকার সমুদ্রসীমায় নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশের। যেটি প্রায় আরেকটি বাংলাদেশের সমান। সমুদ্রের তলদেশের ২০০ নাটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সব ধরনের সম্পদের পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত হয়েছে।

আমাদের বঙ্গোপসাগরের তলদেশে যে খনিজ সম্পদ রয়েছে তা পৃথিবীর আর কোনো সাগর-উপসাগরে নেই বলে ধারণা করছে বিশেষজ্ঞ মহল। বলা হয়ে থাকে, বঙ্গোপসাগর যার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, দক্ষিণ এশিয়া তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এজন্য পরাশক্তিগুলো বঙ্গোপসাগর দখলে রাখতে নানা পরিকল্পনা করছে।

বাংলাদেশ আনবিক শক্তি কমিশনের মারফত জানা যায়, সমুদ্র সৈকতের বালিতে মোট খনিজের মজুদ ৪৪ লাখ টন এবং প্রকৃত সমৃদ্ধ খনিজের পরিমাণ প্রায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার টন।

বঙ্গোপসাগরের ১৩টি স্থানে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানা থেকে প্রায় ১০ লাখ টন খনিজ বালি উত্তোলনের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গভীর সমুদ্রের তলদেশে মলিবডেনাম, ম্যাঙ্গানিজ, ক্রাস্ট, তামা, সিসা, জিংক, সোনা, রুপা মিশ্রিত সালফাইডের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। আবার প্রায় ১৪০০ থেকে প্রায় ৩৭০০ মিটার গভীরে এবং ৩০ থেকে ৮০ মিটার গভীর সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল ক্লের সন্ধান পাওয়া গেছে।

এ ছাড়াও গভীর ও অগভীর সমুদ্রে মহামূল্যবান ধাতু ইউরেনিয়াম ও থেরিয়ামের সন্ধান মিলেছে। সমুদ্র উপকূলে এক উত্তম ব্যবসা এবং অর্থকরী সম্পদ হচ্ছে লবণ উৎপাদন। উন্নত প্রযুক্তির কল্যাণে প্রতি বছর প্রায় ১-৫ মেট্রিক টন লবণ রপ্তানি হবে বলে আশা করা যায়। বঙ্গোপসাগরে খনিজসম্পদ রয়েছে বিভিন্ন ধরনের।

এর মধ্যে বেশির ভাগ পাওয়া যায় ইনমেনাইট, গ্যানেট, ইভাপোরাইট গ্যাস হাইড্রেড, ম্যাগনেটাইট, রটাইল, সিলিমানাইট, নডিউল, ফসফরাস, পলিমেটালিক, সালফাইউ, জিবোজাইট, অ্যাডাপোরাইট ও ব্লেসারে। এ ছাড়াও লিকোক্সিন, মোনাজাইট মূল্যবান তেজস্ক্রিয় পদার্থ, যেটি পারমাণবিক বোমা এবং পারমাণবিক চুল্লিতে শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

উন্নয়নের দৃষ্টি উপকূল সমুদ্র সম্পদের ওপর। কক্সবাজার, মহেশখালী, টেকনাফ, নিঝুম দ্বীপ, কুয়াকাটায় ভারী খনিজ বা কালো সোনা পাওয়া যায়, যেটি আমাদের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জানা যায়, ২০০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাস সম্পদের হিসাব করা হচ্ছে, যেটি থেকে হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। সমুদ্র বাণিজ্যের প্রায় ২৬টি খাত চিহ্নিত হয়েছে। সমুদ্রের নবায়নযোগ্য জ্বালানি জাহাজ শিল্প, বন্দর, পর্যটন, সমুদ্র সম্পদ, খনিজ নির্ভরশীলতা ছাড়াও তেল গ্যাসের সমৃদ্ধশালী হয়ে উন্নত দেশ গঠন করা শুধু সময়ের ব্যাপার। জাহাজ তৈরি শিল্পে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ ৩য় অবস্থানে। এশিয়ার মধ্যে ১৩তম।

২০২০ সালের মধ্যে পৃথিবীব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা হবে ৯০ কোটি থেকে ১৬০ কোটি। বিশেষজ্ঞদের মতানুসারে এসব পর্যটকের প্রায় ৭৩ শতাংশ ভ্রমণ করবেন এশিয়ার দেশগুলোতে।

সাগর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাস্তুতন্ত্র। সাগর আবহাওয়া মণ্ডল থেকে ৫০ গুণ বেশি হারে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে। সাগর প্রায় পৃথিবীর ৯৭ শতাংশ পানি ধারণ করে। আমরা বেঁচে থাকার জন্য যে অক্সিজেন গ্রহণ করছি তার প্রায় অর্ধেকই সাগর থেকে পেয়ে থাকি। সাগর পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে থাকে। পৃথিবীতে মোট হাইড্রো কার্বনের প্রায় ৩২ শতাংশ সরবরাহ হয় সামুদ্রিক উৎস থেকে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জ গ্রহণে সমুদ্রসম্পদ বিশাণ ভূমিকা রাখবে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

ব্লু ইকোনমি কেবল সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনীতির উন্নতি ঘটায় তা নয়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি হ্রাসকরণের মধ্য দিয়ে পরিবেশ-বান্ধব অর্থনৈতিক নবদিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে। এ ছাড়াও দারিদ্র্য বিমোচন, পুঁজির প্রবাহ বৃদ্ধি, বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশ সহায়ক অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বেকারত্ব হ্রাস, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আঞ্চলিক ও লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ তথা টেকসই উন্নয়নে সাগরের ভূমিকা অপরিসীম। মানুষের খাবার ও জীবনযাত্রা এবং বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ সমুদ্র পরিবহনের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়।

সমুদ্র অর্থনীতির বিশাল ক্ষেত্র হচ্ছে সমুদ্রভিত্তিক পর্যটন। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে নানা প্রতিষ্ঠান। এটি আয় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী অন্যতম উৎস। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য সারা বছর ছুটে আসছে লক্ষ লক্ষ দেশি-বিদেশি পর্যটন।

বিশ্বব্যাংকের (২০১৮) এক জরিপ থেকে জানা যায়, পর্যটন ও বিনোদন খাতের অর্থনৈতিক অবদান ২৫ শতাংশ। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান পর্যটনের এই সুযোগকে কাজে লাগাতে এগিয়ে আসতে পারে। সমুদ্রকেন্দ্রিক বিনিয়োগ প্রমোদ জাহাজ ভ্রমণ, সমুদ্র তীরে গ্লাইডিংস, বাইচ, ক্রীড়া, সমুদ্রে অবকাশ যাপন- এসব ক্ষেত্রে হতে পারে বড় আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

বাংলাদেশের মিঠা পানিতে যেখানে ২৫০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় সেখানে বঙ্গোপসাগরে পাওয়া যায় প্রায় ৪৭৫ প্রজাতির মাছ। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, পূর্ণ ও খণ্ডকালীন মিলিয়ে ১৩ লক্ষ লোক সমুদ্রকেন্দ্রিক কর্মসংস্থানে নিয়োজিত। মৎস্যসম্পদ ছাড়াও সামুদ্রিক প্রাণী, সামুদ্রিক আগাছা, লতা-গুল্ম, কৃষি, মাছের তেল ইত্যাদি পাওয়া যায়। বলে নেওয়া ভালো, ইসপিরুলিনা নামক সামুদ্রিক আগাছা প্রক্রিয়াজাত করে ওষুধ তৈরি করা যায়।
আমরা যে প্রাণিজ আমিষ পাই তার অন্তত ছয় ভাগের একভাগ আমিষ পাই আমাদের সাগর থেকে। বিশ্বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পণ্য পরিবহনের প্রায় ৯০ শতাংশই পরিচালিত হয় সমুদ্র পথে।

আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি জাহাজ সমুদ্র পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় দেশে গড়ে উঠেছে শিপিং এজেন্সি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। সমুদ্রগামী জাহাজ পরিবহন, ব্যবস্থায় সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিক মানের জনবল তৈরিতে চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমির খ্যাতি জগৎজোড়া। বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি সর্বমোট ২২টি মেরিন একাডেমি রয়েছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি করছে।

জাহাজ তৈরিতে এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান ৩য়। পৃথিবীর মোট জাহাজ ভাঙা-তৈরির ২৮.৮ শতাংশ সম্পাদিত হয় চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলে। বঙ্গোপসাগরের অপার সম্ভাবনা ও সম্পদ চিহ্নিতকরণ, পরিমাণ নির্ধারণ ও জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথাযথভাবে ব্যবহারের জন্য সরকার ইতিমধ্যেই কক্সবাজার জেলায় ‘ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করেছে।

মোশারফ হোসেন : শিক্ষক ও কলামিস্ট
[email protected]

 
Electronic Paper