শ্রমবাজারে নতুন সম্ভাবনা
আবদুল হাই রঞ্জু
🕐 ৯:১৫ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৯
রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত পোশাক শিল্প। তার পরের খাতটিই হচ্ছে প্রবাসী আয়। মূলত এ দুই খাতের অর্জিত আয়ে আমাদের অর্থনীতি যে সমৃদ্ধ হচ্ছে, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঘন জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশ। দেশে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো না। প্রতি বছর কর্মক্ষম প্রায় ২০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যুক্ত হলেও কর্মসংস্থান সেভাবে হচ্ছে না। ফলে দিনে দিনে বেকারত্বের হার ক্রমান্বয়েই বাড়ছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, কেউই বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে বাঁচতে চান না। সবাই চান একটু কাজের নিশ্চয়তা। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, সে কাজ সহসাই জোটে না। ফলে বিদেশে পাড়ি দিয়ে হলেও কাজের সন্ধানে ছুটতে চান অনেকেই। কিন্তু সবার ভাগ্যে বিদেশ যাওয়া সম্ভব হয় না। অথচ বিপুলসংখ্যক জনশক্তিই আমাদের মানবসম্পদ। এই মানবসম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হলে নিশ্চিত দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, প্রবাসে গমনে জনশক্তির তুলনায় যেতে পারে অনেক কমসংখ্যক। এমনকি কাজের স্পৃহা পূরণে বৈধপথে বিদেশ যেতে না পেরে অনেকেই দালালের হাত ধরে অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি দিয়ে সাগরে ডুবে মৃত্যুবরণ করেন। আবার ভাগ্যগুণে কেউ কেউ সাগর পাড়ি দিলেও অবৈধ অভিবাসী হিসেবে অনেককেই জেল-জুলুম পর্যন্ত সহ্য করতে হয়।
যদিও সরকারের তরফে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে কিন্তু প্রচেষ্টার তুলনায় সফলতা অনেকাংশেই যে কম, যা বলাই বাহুল্য। তবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফরকালে প্রতিটি দেশে জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। ফলে সূর্যোদয়ের দেশ জাপান চলতি বছরের এপ্রিল থেকে বিদেশি শ্রমিকদের জন্য ভিয়েতনাম, চীন, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ডসহ আটটি দেশের দরজা খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু সে ঘোষণায় যে আটটি দেশের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের নাম ছিল না। অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এই সমঝোতা স্মারকের আওতায় দুই ক্যাটাগরিতে আগামী পাঁচ বছর দেশটির ১৪টি খাতে বিশেষভাবে দক্ষ এবং জাপানিজ ভাষায় পারদর্শী কর্মী বাংলাদেশ থেকে জাপানে যেতে পারবে।
প্রথম ক্যাটাগরিতে যারা জাপানিজ ভাষায় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে এবং নির্দিষ্ট কাজে দক্ষতা অর্জন করতে পারবে, কেবল তারাই পরিবার ছাড়া পাঁচ বছরের জন্য জাপানে কাজ করার সুযোগ পাবেন। আর দ্বিতীয় ক্যাটাগরির ক্ষেত্রে যারা জাপানিজ ভাষা ও নির্দিষ্ট কাজে প্রথম ক্যাটাগরির কর্মীদের তুলনায় বেশি দক্ষ তারা পরিবারসহ অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য জাপানে বসবাস এবং কাজের সুযোগ পাবেন।
উল্লেখ্য, দুই ক্যাটাগরিতে আগামী পাঁচ বছরের জন্য জাপান কর্মী নিয়োগ করবে তার মধ্যে রয়েছে কেয়ার ওয়ার্কার, বিল্ডিং ক্লিনিং ম্যানেজমেন্ট, মেশিন পার্টস ইন্ডাট্রিজ, ইলেকট্রিক, ইলেকট্রনিক্স, কন্সট্রাকশন, জাহাজ শিল্প, অটো মোবাইল, কৃষিসহ ১৪টি খাত।
এখন বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৬৫টি দেশে জনশক্তি রপ্তানি হচ্ছে। বর্তমানে এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি বিদেশে কর্মরত রয়েছেন। যাদের পরিশ্রম ও কষ্টের অর্থের ওপর ভর করে আমাদের অর্থনীতি দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে, যা আগেই বলেছি। বিপুলসংখ্যক জনশক্তি রপ্তানি করা সম্ভব না হলে, বেকারত্বের পরিমাণ আরও যে বাড়বে, যা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে বিদেশ সফরের সময় বাংলাদেশের কর্মক্ষম জনশক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য গুরুত্বারোপ করেন। সম্প্রতি তিনি বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের এক সম্মেলনে অর্থনৈতিক কূটনীতির ওপর যে গুরুত্বারোপ করে বক্তব্য রেখেছেন, তা অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। অবশ্য দেশের সমৃদ্ধির জন্য অর্থনৈতিক কূটনীতিরও বিকল্প নেই। ফলে প্রধানমন্ত্রী এখন অর্থনৈতিক কূটনীতিকে অধিকতর গুরুত্ব দিচ্ছেন।
এই মুহূর্তে জাপানের শ্রমবাজারে আমাদের কর্মী যাওয়ার সুযোগকে যুগান্তকারীই বলতে হবে। অবশ্য জাপানে কর্মী প্রেরণের উদ্দেশে আগে থেকেই প্রচেষ্টা যেমন অব্যাহত ছিল, তেমনি জাপানি ভাষার শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল। গত ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি সাল থেকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে সারা দেশে ২৬টি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের মাধ্যমে জাপানি ভাষার চার মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করেছিল। যে মুহূর্তে প্রশিক্ষণ শেষ করে এখন অনেকেই জাপান যাওয়ার জন্য সক্ষমতা অর্জন করেছেন, সে মুহূর্তে জাপানের বন্ধ দুয়ার খুলে দেওয়ায় নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সভাপতি বেনজির আহমেদ বলেন, ‘জাপানে যেতে ইচ্ছুক একজনকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে প্রায় আট মাস সময় লাগে।
আমি বিশ্বাস করি, জাপান যে ধরনের দক্ষ লোক চায়, আমরা তাদের সেটা পূরণ করতে পারব।’ অবশ্য গোটা বিশ্বের দেশে দেশে বাংলাদেশের কর্মীরা যেখানে কাজ করছেন, সেখানেই তারা সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশের কর্মীরা অনেক নৈপুণ্য, আন্তরিকতা আর দক্ষতা নিয়ে কাজ করেন। ফলে বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদা বিদেশে প্রচুর।
উল্লেখ্য, শুধু জাপানের শ্রমবাজারের দুয়ার খোলাই শেষ নয়, অচিরেই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারও উন্মুক্ত হবে-এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল বিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সভাপতি বেনজির আহমেদ।
তিনি বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুললে কোনো সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি থাকতে হবে না। বায়রার সব সদস্য জনশক্তি রপ্তানিতে সমান সুযোগ পাবেন। তবে তিনি এও মন্তব্য করেন, অবশ্যই তাদের বাধ্যতামূলকভাবে সরকার নির্ধারিত টাকায় জনশক্তি রপ্তানি করতে হবে। আমরাও মনে করি, যেন কোনোভাবেই বিদেশ গমেনচ্ছুদের কাছ থেকে নানা অজুহাতে বাড়তি টাকা আদায় করা যেন না হয়।
পরিশেষে শুধু এটুকুই বলতে চাই, যেহেতু বাংলাদেশের বিপুল জনশক্তিই আমাদের মানবসম্পদ, সেহেতু এই মানবসম্পদকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারলে বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশের শ্রমবাজারে কাজ করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এজন্য জাপানি ভাষায় প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের দক্ষ করে তুলতে পারলে এশিয়ার উন্নত ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশ জাপানে নতুন শ্রমবাজার আমাদের অর্থনীতিকে যেমন একদিকে সমৃদ্ধ করবে, অন্যদিকে দেশে বেকারত্ব কমিয়ে আনতে অনন্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
আবদুল হাই রঞ্জু : ব্যবসায়ী ও কলাম লেখক
[email protected]