জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশ
মোতাহার হোসেন
🕐 ৯:৩৪ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৯
বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ হিসেবে পরিচিত। বালক বেলায় পাঠ্যবইতে বছরের ছয় ঋতুর পরিচয় পড়েছি। তখন বাস্তবেও ছয় ঋতুর উপস্থিতি ছিল। প্রতি দুই মাস পর পর ঋতুর পরিবর্তন হতো। কিন্তু হাল আমলে ছয় ঋতুর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না! শীত, বর্ষা আর বসন্ত ঋতু অনুভব করা যায় যৎকিঞ্চিত। বাদবাকি সময় ধরে চলে প্রকৃতির বৈরী, বিরূপ খেলা।
প্রকৃতির এই বৈরী খেলায় বিপন্ন হচ্ছে মানুষের জীবন, সংস্কৃতি, সভ্যতা এবং জীবনাচার। শুধু তাই নয়, এ জন্য মানুষকে চরম মূল্য দিতে হচ্ছে আর্থিক, মানসিক, সম্পদ ও জীবনের বিনিময়ে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আমাদের ঋতুচক্রে তথা ঋতু পরিক্রমায় পরিবর্তন ঘটেছে। তাদের ভাষ্য, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায়ও বাংলাদেশ শীর্ষে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, বায়ুমণ্ডল ক্রমাগত উত্তপ্ত হওয়ায় বরফাচ্ছাদিত হিমালয় গলে যাচ্ছে। বরফের চাদরে আচ্ছাদিত এন্টার্কটিকা মহাদেশের (মহাদেশটি ধারণ করছে প্রায় সাত মিলিয়ন ঘনমাইল আয়তনের বরফ যা কিনা পরিমাণে পৃথিবীর মোট বরফের ৯০ শতাংশ) বরফও গলছে খুব দ্রুত। একটু ভেবে দেখুন বিপুল পরিমাণ এই বরফ যদি গলে যায় তাহলে আমাদের বাসযোগ্য পৃথিবীর কী অবস্থা হতে পারে!
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৯ শতকের শেষভাগ থেকে এখন পর্যন্ত এন্টার্কটিকা মহাদেশের তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যার পেছনে কারণ হিসেবে দায়ী করা হয় বায়ুমণ্ডলে অধিক পরিমাণ কার্বন-ডাই অক্সাইড ও মনুষ্যসৃষ্ট নির্গমন গ্যাসের বা গ্রিন হাউস গ্যাসের উপস্থিতি। বিগত ৩৫ বছরে পৃথিবীতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ বলে দাবি করেন বিজ্ঞানীরা। তারা জানিয়েছেন, ২০০১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৬ বছরই বেশ উষ্ণ ছিল। এরই ফলশ্রুতিতে হিমালয় এবং এন্টার্কটিকার বরফ গলছে এবং সেই সঙ্গে বাড়ছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা।
বিগত শতাব্দীতে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা বেড়েছে প্রায় ৮ ইঞ্চি এবং গত ২০ বছরে উচ্চতা বৃদ্ধির হার গত শতাব্দীর দ্বিগুণ অর্থাৎ ১৬ ইঞ্চি। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি মূলত দুটি কারণের সঙ্গে সম্পৃক্ত- প্রথমত, বরফ গলে যাওয়া। শুধু বাংলাদেশে আগামী ৫০ বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূলে বসবাসরত প্রায় তিন কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে, এমন আশঙ্কা গবেষকদের। পাশাপাশি জোয়ার ভাটা, পানিতে লবণাক্ততা, নদী ভাঙনের তীব্রতাও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এমন অবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি ও ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে গঠন করেছে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড, প্রণয়ন করেছে ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্রাটিজিক অ্যাকশন প্ল্যান। এই অ্যাকশন প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে গত এক বছর ধরে। পাশাপাশি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্রাটেজিক অ্যাকশন প্ল্যান সংশোধন করার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। সরকারের এই কর্মসূচি ও উদ্যোগ বহির্বিশ্বে সমাদৃত ও প্রশংসিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইউএনইপি ‘চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ’ পুরস্কারে ভূষিত করে। একই কারণে বাংলাদেশকে জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় ‘রোল মডেল’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ।
আনন্দের আরও খবর আছে। সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রদত্ত ১৫ দফা দাবি তথা সুপারিশ জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। এর সুপারিশসমূহ নিয়ে জেনেভায় মানবাধিকার পরিষদের ৪১তম অধিবেশনের শেষ দিনে ভোটাভুটি পর্বে বাংলাদেশের প্রস্তাবটির ব্যাপারে কোনো দেশ আপত্তি জানায়নি। এরপর অধিবেশনের সভাপতি সবার সম্মতির ভিত্তিতে ভোট ছাড়াই প্রস্তাবটি গৃহীত হওয়ার ঘোষণা দেন।
এর আগে সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও জেনেভায় জাতিসংঘের দফতরগুলোতে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এম শামীম আহসান জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবাধিকার ইস্যুতে প্রস্তাবটির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তিনি জানান, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম প্রস্তাবটির পৃষ্ঠপোষক হয়েছে। এ ছাড়া ৪৩টি রাষ্ট্র প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। তিনি আরও জানান, এই প্রস্তাব ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কাজ করা আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, আগে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যে গতিতে পড়ার আশঙ্কা করা হয়েছিল বাস্তবে তারচেয়েও অনেক দ্রুত ঘটছে। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর দায় কম থাকলেও প্রভাব পড়ছে অনেক বেশি। জলবায়ু পরিবর্তন এই দেশগুলোর মানবাধিকার চর্চা ও উন্নয়নে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। পাকিস্তান ও ফিজির প্রতিনিধিরা তাদের বক্তব্যে বাংলাদেশের প্রস্তাবের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ও সাধুবাদ জানান।
ডেনমার্কের প্রতিনিধি আশা করেন, সব রাষ্ট্র নিজ নিজ অবস্থানে থেকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ভূমিকা রাখবে এবং মানবাধিকারের প্রতি সব রাষ্ট্রই সম্মান দেখাবে।
জেনেভা থেকে পাওয়া খবরের উদ্ধৃতি বাংলাদেশের পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, গৃহীত প্রস্তাবটিতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার উদ্যোগে প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবটিতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আকস্মিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ধীরে ধীরে সংঘটিত বিপর্যয় এবং সব ধরনের মানবাধিকার চর্চার ওপর এসব বিপর্যয়ের বিরূপ প্রভাবের ব্যাপারে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। বিশেষ করে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা উন্নয়নশীল দেশগুলো ও তাদের জনগণের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় দ্রুত উদ্যোগ নেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে প্রস্তাবে।
এর তৃতীয় দফায় জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের কাঠামোর আলোকে মানবাধিকারসহ অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করতে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান রয়েছে।
চতুর্থ দফায় ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিট’ আয়োজনে জাতিসংঘ মহাসচিবকে সহায়তা করতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দফতরকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্রকে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন ও প্রশমন নীতি প্রণয়নে ব্যাপক পরিসরে, সমন্বিত, জেন্ডার সংবেদনশীল ও প্রতিবন্ধীবান্ধব উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানানো হয়েছে পঞ্চম দফায়।
প্রস্তাবের ষষ্ঠ দফায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে এমন উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতে মানবাধিকার এবং প্রতিবন্ধীদের জীবিকা, খাদ্য ও পুষ্টি, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সেবা উৎসাহিত করতে আন্তর্জাতিক সাহায্য ও সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে আহ্বান জানানো হয়েছে। সপ্তম দফায় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে বলা হয়েছে।
মানবাধিকার পরিষদের ৪৪তম অধিবেশনে ‘জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবন্ধীদের অধিকার উৎসাহিতকরণ ও সুরক্ষা’ শীর্ষক আলোচনা ও কর্মসূচি নির্ধারণের আহ্বান জানানো হয়েছে প্রস্তাবের অষ্টম দফায়। ওই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মানবাধিকার পরিষদের ৪৬তম অধিবেশনে মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারকে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে প্রস্তাবের নবম দফায়। দশম দফায় জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও সুরক্ষার বিষয়ে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট বিশেষ দূতদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিবেদন তৈরি ও মানবাধিকার পরিষদে উপস্থাপন করতে মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক জাতিসংঘের প্যানেল আলোচনায় শিক্ষাবিদ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টদের আমন্ত্রণ জানাতে বলা হয়েছে একাদশ দফায়। প্রস্তাবের পরবর্তী দফাগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবাধিকার ইস্যুতে জাতিসংঘ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত থাকতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া জাতিসংঘ মহাসচিব ও মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারকে প্যানেল আলোচনা ও প্রতিবেদন তৈরিতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতেও অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বলা হয়েছে, এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে বাংলাদেশ অন্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। গৃহীত প্রস্তাবটি বাস্তবায়নে জাতিসংঘের বাড়তি ২ লাখ ৩০ হাজার ৪০০ মার্কিন ডলার খরচ হবে। আমাদের প্রত্যাশা, জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশের প্রস্তাবিত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে উন্নত দেশগুলো কারিগরি, প্রযুক্তিগত এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করবে। পাশাপাশি বিশ্ব দরবারে আবারও প্রমাণ হলো, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বাংলাদেশ এবং এই মহাক্ষতি পূরণে বাংলাদেশের দাবি, প্রস্তাব, সুপারিশসমূহ যৌক্তিক। অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় জাতিসংঘকে পাশে পাওয়া যাবে।
মোতাহার হোসেন : সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম (বিসিজেএফ)