ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সবজিতে তাক লাগানো সাফল্য

আবদুল হাই রঞ্জু
🕐 ৯:২৪ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১৯

বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশ। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশের কৃষকের প্রচেষ্টার শেষ নেই। ফলে কৃষিতে ব্যাপক সফলতা এসেছে সত্য, কিন্তু কৃষকের অবস্থা ভালো নেই। কারণ কৃষকের উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য কয়েক বছর ধরে নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। কৃষিপণ্যের উৎপাদন একটু বেশি হলেই কৃষকের কপাল পোড়ে। এভাবেই কপাল পুড়তে পুড়তে কৃষকের অবস্থা এখন শোচনীয়।

একসময় পাটই ছিল কৃষি চাষাবাদের অন্যতম পণ্য। শুধু পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হওয়ায় পাট চাষের ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে। এখন একমাত্র সেচভিত্তিক চাষাবাদের বদৌলতে ধানের ব্যাপক উৎপাদন হচ্ছে। ধান উৎপাদন করে যেভাবে কৃষককে লোকসান গুনতে হচ্ছে, এ অবস্থা চলতে থাকলে চাষিরা ধান চাষ ছেড়ে অন্য ফসল চাষের দিকেই ঝুঁকে পড়বে।

আর হচ্ছেও তাই। কারণ কৃষক যে পণ্য আবাদ করে লাভবান হবেন, যে পণ্য চাষের দিকেই ঝুঁকবেন, এটাই স্বাভাবিক। এখন সবজি চাষাবাদ করে চাষিরা যতটুকু লাভবান হতে পারেন, ধান চাষ করলে সে হারে লাভবান হতে পারেন না। উল্টো লোকসান গুনতে হয়। এ কারণে গোটা দেশেই এখন সবজির ব্যাপক চাষাবাদ হচ্ছে। সবজি চাষ করে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। প্রচলিত কৃষির বাইরে বিদেশি জাতের বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি, ফলমূল চাষ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ।

উল্লেখ্য, বগুড়া, জয়পুরহাটের কচুর লতি এখন বিদেশের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। শুধু কচুর লতিই নয়, আলুসহ নানা জাতের সবজি এখন রপ্তানি হচ্ছে। সবজি রপ্তানির জন্য এখন কার্গো বিমানও ভাড়া করা হচ্ছে। অতিসম্প্রতি শেরে বাংলা নগরের এনইসি সভাকক্ষে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ১৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কৃষি বিপণন অধিদফতর জোরদারকরণ’ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। উক্ত সভায় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, বাংলাদেশ সবজি উৎপাদনে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। এখন বাংলাদেশের উৎপাদিত সবজি স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে, মর্মেও তিনি মন্তব্য করেন।

উক্ত সভায় সবজি উৎপাদনে ব্যপক সাফল্যের কথা শোনেন প্রধান মন্ত্রী। কার্গো বিমান ভাড়া করে সবজি রপ্তানি করা হচ্ছে যা জানার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুটি কার্গো বিমান কেনার নির্দেশ দেন। অবশ্য অর্থসচিব আবদুর রউফ বলেন, বিমানের অবস্থা এখন ভালো। বিমান কর্তৃপক্ষ নিজেদের অর্থ দিয়েই দুটি কার্গো বিমান কিনতে পারবে মর্মে তিনি মন্তব্য করেন।

এখন উৎপাদিত সবজির তালিকায় আলুর অবস্থান অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে এখন দেশের নদ-নদীগুলো শুকিয়ে সুবিশাল চরাঞ্জলের সৃষ্টি হচ্ছে। আর বালু মিশ্রিত এসব দোঁ-আশ মাটিতে আলুর ব্যাপক চাষাবাদ হচ্ছে। কিন্তু আলু চাষিরা আলুর উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছেন না। যদি আলুর ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা যায়, তাহলে আলুচাষে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। এ কারণে আলুর রপ্তানির দিকে বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি। যদিও এখন স্বল্প পরিসরে আলু রপ্তানি হচ্ছে যা মোট উৎপাদনের যৎসামান্যই। উল্লেখ্য, এখন ২০ টাকার উপর দরে প্রতি কেজি আলু রপ্তানি হচ্ছে। যা কৃষক পর্যায়ে মাত্র ৭/৮ টাকায় বেচাকেনা হয়।

ফলে প্রকৃত অর্থে আলু চাষিরা উপযুক্ত দর থেকে বঞ্চিত হলেও লাভবান হচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। স্বস্তির বিষয়, বাস্তব এ অবস্থা দূরীকরণে সরকার আলুর চুক্তিভিত্তিক চাষ পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। এ পদ্ধতিতে কৃষক সরাসরি রপ্তানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আলু বিক্রি করতে পারবেন। আগামী অক্টোবর থেকে এ প্রক্রিয়া শুরু করে (সূত্র : দৈনিক আমাদের সময়, ২২/০৮/১৯)।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী নিজে একজন আলু সংরক্ষণ উপযোগী হিমাগারের মালিক। আলু চাষ এবং আলুর মূল্য সম্পর্কে তার বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকায় তিনি বলেছেন, আলু চাষিদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতে আলু রপ্তানি করা হবে। আমরাও আশাবাদী, আলু রপ্তানির পরিমাণ বাড়ানোর লক্ষ্যে চুক্তিভিত্তিক আলু চাষ পদ্ধতিকে সফল করতে পারলে আলুর উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তবে এটাও সত্য, বিদেশে আলু রপ্তানির পরিমাণ বাড়াতে হলে রোগমুক্ত আলু চাষকে নিশ্চিত করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে কৃষিবিদ সৈয়দ মনিরুল হক বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে গেলে যে কোন পণ্য কোন এলাকায় উৎপাদন হয়, সেখানে ওই পণ্যের জন্য ক্ষতিকারক পোকামাকড় ও রোগজীবাণু আছে কীনা, তার সব তথ্য উৎপাদন পর্যায় থেকে শুরু করে রপ্তানি করার আগ পর্যন্ত নিশ্চিত করতে হবে। যেন বিদেশে পণ্যটি পৌঁছার পর তা ভোক্তা পর্যায়ে সমাদৃত হয়। তা নিশ্চিত করতে না পারলে আন্তর্জাতিক বাজার ধরে রাখা সম্ভব হবে না।

দেশে আলুর বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৭০ লাখ টনের মতো। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে আলু উৎপাদন এক কোটি টনেরও বেশি হচ্ছে। অর্থাৎ প্রায় ৩০ লাখ টন বাড়তি আলুর উৎপাদন হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ বাড়তি আলু বিদেশে রপ্তানি করতে না পারলে চাষি পর্যায়ে আলুর যে দাম থাকে, তা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত দর নয়। ফলে প্রান্তিক আলু চাষিরা রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আলু চাষ করে সত্য, কিন্তু উপযুক্ত মূল্যের অভাবে লাভবান হতে পারেন না। আর যে পরিমাণ আলু বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে, তা উৎপাদনের তুলনায় অনেক কম।

সূত্রমতে, গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, বাহারাইন, ব্রুনাই, বেনিন ও ভিয়েতনামে অন্তত ৩২ হাজার ১০ টন আলু রপ্তানি হয়েছে। যেখানে আমাদের বছরে প্রায় ৩০ লাখ টন আলুর বাড়তি উৎপাদন হয়, সেখানে ৩০ হাজার টন আলু রপ্তানি যে যৎসামান্যই, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আলু রপ্তানির বাস্তব অবস্থা তুলে ধরে চট্টগ্রাম উদ্ভিদ সংগোনিরোধ অধিদফতরের (সমুদ্র বন্দর) উপ-পরিচালক আসাদুজ্জামান বুলবুল বলেন, কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় বিপুল পরিমাণ আলু রপ্তানি করা হতো। কিন্তু মাঝে আলুর মান নিয়ে সমস্যা হওয়ায় আলু রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। এখন ইউরোপসহ রাশিয়ায় আলু রপ্তানি করার লক্ষ্যে সরকার চুক্তিভিত্তিক চাষ পদ্ধতি চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে।

আমরা মনে করি, চুক্তিভিত্তিক চাষ পদ্ধতির সম্প্রসারণ এবং আলু রপ্তানির আগে চট্টগ্রাম উদ্ভিদ সংগোনিরোধ কেন্দ্রে ভালোভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ছাড়পত্র নিতে হয়। যেন কেউ মান-বহির্ভূত কোনো আলু বিদেশে রপ্তানি করতে না পারে। এজন্য উৎপাদন থেকে শুরু করে জাহাজীকরণ পর্যন্ত সমন্বিতভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারলে আলু চাষিরা একদিকে যেমন ন্যায্যমূল্য পাবেন, তেমনি দেশও প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে।

আব্দুল হাই রঞ্জু : ব্যবসায়ী ও কলাম লেখক
[email protected]

 
Electronic Paper