ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ধর্মের নামে জাত বিদ্বেষ অধর্ম

জামাল আস সাবেত
🕐 ১০:১২ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০১৯

ধর্ম মানে বিদ্বেষ নয়। জাতিগত হানা নয়। বাড়ি-ঘর পোড়ানো নয়। দেশ থেকে তাড়ানো নয়। ধর্ম মানে বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবকে সৌহার্দ্যরে দিকে ধাবিত করা। যারা ধর্মকে পুঁজি করে বিদ্বেষ, অশান্তি আর দেশছাড়া বোঝায় তারা কখনই ধার্মিক নয়। তারা শয়তানের লালিত পাণ্ডা।

আমাদের গোড়ায় সমস্যা। আমরা আমাদের ধর্ম পেয়েছি পারিবারিকভাবে। যার কারণে ধর্ম সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান নিতান্তই কম। আমাদের বুঝ আসার আগেই বাবা-মা, পরিবেশ আমাদের নির্দিষ্ট একটি রীতিনীতি শিখিয়েছেন। ফলে কোনো বাছবিচার ছাড়াই আমরা একটি পারিবারিক ধর্ম পালন করে আসছি। কখনো পড়াশোনা করে অথবা অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে ধর্মকে গ্রহণ করিনি। মানুষ কিশোর বয়সে যা লাভ করে তা তার মনের শেকড়ে গেঁথে যায়। ওই বয়সে গুরু, মুরব্বি, শিক্ষক, পরিবেশ আমাদের অন্য ধর্মের লোকজনকে ঘৃণা করতে শিখিয়েছে। নিজ ধর্মই শ্রেষ্ঠ এমন ধারণা মন-মস্তিষ্কে নানাভাবে গেড়ে দিয়েছে। যার বদৌলতে আমরা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সহ্য করতে পারি না। বিপরীত স্রোতে দেখলেই গা জ্বলে ওঠে।

ভিন্নদের সঙ্গে কথা বলতে, খেলতে, মিশতে অপারগ হয়ে পড়ি। এমনকি তাদের মানুষ হিসেবে দেখতেও পছন্দ করি না। অথচ আমরা নিজেরাই যদি বাছবিচার করে ধর্ম পালন করতাম তাহলে কে শ্রেষ্ঠ আর কে শ্রেষ্ঠ নয় তা মনে মনেই থাকত, কখনো কাউকে বা কোনো জাতিকে হেয় করে মুখ খুলতাম না। আমাদের সমাজ এখনো ভিন্ন ধর্মাবলম্বী কেউ মারা গেলে খুশি হয়! মনে মনে ভাবে ভালোই হয়েছে, ওদের আবার বেঁচে থাকার অধিকার কীসের?

যুগযুগ ধরে যেসব ধর্মযুদ্ধ হয়ে আসছে তার অধিকাংশই ধর্মীয় উন্মাদনার কারণে ঘটেছে। মসজিদ, মন্দির, কোরআন, গীতা, বাইবেল পাশাপাশি থাকতে পারলেও আমরা ধর্মানুসারীরা পাশাপাশি থাকতে পারি না। অথচ স্বয়ং ধর্মই বলছে, ‘তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কর না।’ মূলত আমরা ধর্মের আনুগত্য করি না বরং আমরা আনুগত্য করি ক্ষমতার। ক্ষমতা মানুষকে পশু করে তোলে, ভেতরের আগুন জ্বালিয়ে দেয়, আর ধর্ম মানুষকে ভেতরের আগুন নিভাতে শিখায়, আক্রোশ দূর করতে বলে, মানবসেবায় সদাপ্রস্তুত থাকতে বলে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে বলে। অথচ ধর্মের এসব শিক্ষা বাদ দিয়ে আমরা হানাহানি, রক্তারক্তি আর বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবকেই ধর্ম নামে চালিয়ে দিচ্ছি। যার প্রমাণ হচ্ছে, নিজ ধর্মানুসারীদের মাঝেই কোন্দল। ক্ষমতার আগুনে আমরা এতটাই জ্বলছি যে, ভিন্নমত সহ্য করতেই পারছি না। আমিই সর্বেসর্বা, জ্ঞানী, গুণী, হিতৈষী, সবকিছু আমার হাতেই থাকতে হবে এমন মনোভাবের ফলেই দেশ, জাতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মানুষে মানুষে রেষারেষি বাড়ছে। খুনোখুনি হচ্ছে সর্বত্র।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘একস্থানে দেখিলাম, ঊনপঞ্চাশ জন ভদ্র-অভদ্র হিন্দু মিলিয়া একজন শীর্ণকায় মুসলমান মজুরকে নির্মমভাবে প্রহার করিতেছে, আর একস্থানে দেখিলাম, প্রায় ওই সংখ্যক মুসলমান মিলিয়ে একজন দুর্বল হিন্দুকে পশুর মতো মারিতেছে। দুই পশুর হাতে মার খাইতেছে দুর্বল অসহায় মানুষ। ইহারা মানুষকে মারিতেছে যেমন করিয়া বুনো জংলী বর্বরেরা শূকরকে খোঁচাইয়া মারে। উহাদের মুখের দিকে তাকাইয়া দেখিলাম, উহাদের প্রত্যেকের মুখ শয়তানের চেয়েও বীভৎস, শূকরের চেয়েও কুৎসিত! হিংসায়, কদর্যতায় উহাদের গাত্রে অনন্ত নরকের দুর্গন্ধ!’

যারা ধর্মকে পুঁজি করে সমাজে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে, মানবে মানবে হিংসা তৈরি করে, খুনোখুনি বাধিয়ে দেয় সেসব ধার্মিক দাবিদারেরা শয়তানের প্রতিচ্ছবি। তাদের মাথায় টিকি-টুপি, মুখে দাড়ি-গোঁপ যাই থাকুক না কেন, তারা ভ-! তারা ধর্ম ব্যবসায়ী, মানুষের শত্রু।

এসব কট্টরপন্থি ধার্মিক দাবিদাররা কখনো জ্ঞান-গবেষণার জন্য মানুষকে উৎসাহিত করবে না। মানবিক চিন্তাও তাদের মাঝে থাকবে না। বরং নিজ ধর্মের প্রশংসা করবে আর অন্য ধর্মকে কটাক্ষ করে সেসব ধর্মানুসারীদের দেশছাড়া করতে, হত্যা করতে দ্বিধা করবে না।

চীন, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা কোথায় সংখ্যালঘুরা মার খায় না? সংখ্যালঘুরা কখনো রাজনীতির শিকার, কখনো ধর্মের শিকার, এ দুই আক্রোশের শিকারে যুগযুগ ধরে নির্যাতিত হয়ে আসছে এরা। কট্টরপন্থিদের মনোভাব কখনো এমন হয়নি, ‘ওরা আমাদের ভাই, ওরাও মানুষ, ওদেরকে কেন মারব।’ কট্টরপন্থিরা বরং এই মনোভাব তৈরি করেছে, কীভাবে তাদের উচ্ছেদ করা যায়, কীভাবে তাদের নিঃশেষ করা যায়, কীভাবে জাতিটাকে ধ্বংস করা যায়। এসব ফন্দিফিকির তাদের চিন্তাচেতনায় ঘুরপাক খায়।

যাদের ধর্ম পূজা-মণ্ডপে, মসজিদ-মন্দিরে আর প্রার্থনায় আবদ্ধ তারাই এমন বীভৎস হয়ে উঠতে পারে। এরা ধর্ম বলতে বুঝে, নিজেরাই সেরা! নিজেরাই স্বর্গবাসী বাদবাকি সব অমানুষ! তাই এ অমানুষদের মারলে কোনো দোষ নেই। এসব কট্টরদের ধর্ম শয়তানের বানানো। এদের কাছে মানুষের চেয়ে মন্দির বড়, মসজিদ বড়, নিজ ধর্ম বড়। এ লোকগুলো যখনই ক্ষমতায় বসে তখন দেশজুড়ে আতঙ্ক ছড়ায়। মানুষ হত্যা করে, গুম করে, ধর্মে ধর্মে বিদ্বেষ বিস্তার করে। যুগযুগ ধরে এ শত্রুরাই পৃথিবীকে অশান্তির দাবানলে পুড়িয়েছে। এখনো পোড়াচ্ছে।

এরা ধর্ম না বুঝে ধর্ম পালনের নামে অধর্ম চর্চা করে। অধর্ম পালন করতে করতে নরাধম হয়ে উঠে। এরা ধর্মগ্রন্থ পড়ে না, তথাকথিত ধর্মীয় গুরু, নানকের পূজা করে। এরা ধর্ম বলতে অতিপ্রাকৃত কিছু বোঝে; বাস্তব জীবন বুঝে না। তাই তো দেশে দেশে কেবল ধর্মীয় উন্মাদ দেখি, কোনো ধার্মিক দেখি না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘যে ধর্মের নামে বিদ্বেষ সঞ্চিত করে, ঈশ্বরের অর্ঘ্য হতে সে হয় বঞ্চিত।’ প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁর মতে, ‘মানুষের জন্য যা কল্যাণকর তাহাই ধর্ম। যে ধর্ম পালন করতে গিয়া মানুষের অকল্যাণ করিতে হয়, তাহা ধর্মের কুসংস্কার মাত্র। মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়।’

জামাল আস-সাবেত : লেখক ও কলামনিস্ট
[email protected]

 
Electronic Paper