ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বাঁচায় নদী, বাঁচাও নদী-৫২

দখলদার চিহ্নিত এবার চাই উচ্ছেদ!

ড. তুহিন ওয়াদুদ
🕐 ৮:৫৩ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৮, ২০১৯

বাংলাদেশে এই প্রথম নদীর দখলদারদের তালিকা প্রণয়ন করা হচ্ছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন জেলা প্রশাসনকে বারবার তাগিদ দিয়ে দখলদারদের নামের তালিকা প্রকাশ করেছে। এটি আশাব্যঞ্জক। বাংলাদেশের ইতিহাসে নদী নিয়ে এ রকম কাজ আগে কখনোই হয়নি। তালিকা অসম্পূর্ণ হোক, সীমাবদ্ধতা থাকুক কিন্তু যে কাজের সূচনা হয়েছে সেটির মাধ্যমে আমরা মনে করি নদী রক্ষায় সরকার আরও একধাপ এগিয়ে গেল।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান বলেন-‘এখন পর্যন্ত ৬০টি জেলায় ৪৫ হাজার ১৪৮ জন দখলদারের নাম আমরা পেয়েছি। জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে এখন নদী উদ্ধার করানো হবে। আগামী এক বছরের মধ্যে ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেওয়া হচ্ছে। ভূমি মন্ত্রণালয় অর্থ সংস্থান করবে। মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভিপ্রায়ে এ কাজ করা সম্ভব হচ্ছে। জেলা প্রশাসকরা ধন্যবাদ পাওয়ার মতো কাজ করেছেন।’

প্রস্তুতকৃত তালিকা খুবই অসম্পূর্ণ বলে মনে করি। এর অনেক কারণ আছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন জেলা প্রশাসনের কাছে নদীর দখলদারদের নামের তালিকা চেয়েছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য, সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের একজন জেলা প্রশাসকও ওই জেলায় কতটি নদী আছে তা বলতে পারবে কিনা আমার সন্দেহ আছে। হতে পারে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন সংশ্লিষ্ট জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে দখলদারদের নামের তালিকা প্রস্তুত করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে কি নদীর প্রকৃত সংখ্যা আছে? বাংলাদেশে কতটি নদী আছে এই পরিসংখ্যান তো কারও কাছেই নেই। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউিট, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন কারও কাছেই এই পরিসংখ্যান নেই। তাহলে নদীর সংখ্যা জানা না থাকলে নদীর প্রকৃত দখলদারদের সংখ্যা জানা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়।
আমি দীর্ঘ ১০ বছর ধরে মাঠ পর্যায়ে নদী নিয়ে কাজ করছি। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০০৫ সালের পূর্বে তাদের তালিকায় ২৩০টি নদ-নদীর সংখ্যা উল্লেখ করেছিল। তখন সরকারের কাছে নদ-নদীর সংখ্যা ছিল ২৩০টি। সে কারণে এখনো কেউ কেউ নদ-নদীর সংখ্যা ২৩০টি উল্লেখ করে। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে নদ-নদীর সংখ্যা ৫০৪টি। তারপর থেকে নদ-নদীর সংখ্যা সরকারিভাবে ৫০৪টি উল্লেখ করা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড যদি দখলদারদের তালিকা করে তাহলে এই নদীগুলোর দখলদারদের কথাই উল্লেখ করার কথা।

সরকারি তালিকাভুক্ত নদীগুলোরও দখলের ধরন বিভিন্ন রকম আছে। যেমন শহরকেন্দ্রিক দখল সবার চোখে পড়ে। গ্রামেও যে নদীর দখল আছে সেই প্রসঙ্গটি অনেকেই আমলে নিতে চান না। রংপুরের দখলদার প্রসঙ্গে যতটুকু জানি এখান থেকে যে তালিকা পাঠানো হয়েছে তা অসম্পূর্ণ। ২০০৭-২০০৮ সালে শ্যামাসুন্দরী দখলদারদের তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছিল। সে সময় দখলদার ছিল চারশ বিরাশি জন। ২০১৯ সালে এসে পাওয়া যায় মাত্র ১৮৩ জন। ১১-১২ বছরে দখলদারদের সংখ্যা কমার কোনো সুযোগ নেই। অথচ দেখা যাচ্ছে সেই সংখ্যা কমেছে।

নদীর সীমানা নির্ধারণের জন্য ১৯৪০ সালের সিএস ম্যাপ অনুসরণ করতে হবে। সারা দেশে যে ৪২ হাজার দখলদারকে পাওয়া গেছে তা সর্বত্র ১৯৪০ সালের ম্যাপ অনুযায়ী হয়নি। ১৯৬২ সালের আরএস ম্যাপ অনুযায়ী অনেক স্থানে সীমানা চিহ্নিত করার কাজ করা হয়েছে।

প্রথমত, নদীর সংখ্যা চিহ্নিত না হলে প্রকৃত দখলদারদের পাওয়া যাবে না। যতটুকু জানা যায় বাংলাদেশে এখনো প্রায় দুই হাজার নদ-নদী আছে। ছোট-বড় মিলিয়ে এই সংখ্যা। রংপুর বিভাগে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকা অনুযায়ী নদীর সংখ্যা ৮৪টি। বাস্তবে এই সংখ্যা ২ শতাধিক। ফলে নদীর সংখ্যা চিহ্নিত করা ছাড়া যে দখলদারদের আমরা পেয়েছি তা খুবই ত্রুটিপূর্ণ। তবুও এটি আশার সংবাদ। আগামীতে অবিশষ্ট নদীর দখলদারদের চিহ্নিত করা যাবে।

দেশের এখনো সবজেলার দখলদারদের সংখ্যা জানা যায়নি। নিশ্চয়ই জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন অবশিষ্ট জেলার দখলদারদের সংখ্যাও পাবে। প্রথমবার দখলদারদের সংখ্যা যতই ত্রুটিপূর্ণ হোক না কেন সেটি আশা জাগানিয়া। কিন্তু এই সংখ্যা খুঁজে বের করাই কি যথেষ্ট! জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে দেশের সব নদীর অভিভাবক ঘোষণা করেছে। কিন্তু জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তো নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করার জন্য অইনগত কোনো ভিত্তিও নেই, সেই জনবলও নেই। তাহলে এই সংখ্যক দখলদারদের উচ্ছেদ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ কে গ্রহণ করবে? আমরা আশা করব সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকরা এ কাজ করবেন।

জেলা প্রশাসক সংশ্লিষ্ট জেলার অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে পারেন। সরকার দেশের কোনো জেলা প্রশাসকই নদীর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে নিষেধ করেনি। বরং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার নদীর পানি প্রবাহ বাধাহীন করার কথা বলছেন। নদীর দখলদারদের উচ্ছেদ করার কথা বলছেন। যে ৪৫ হাজার ১৪৮ জন দখলদারের তালিকা পাওয়া গেছে সেগুলো দেশের ৬০ জেলার। এই ৬০ জেলার জেলা প্রশাসকের এখন দায়িত্ব হচ্ছে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা। কমিশনের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন খুব শিগগিরই অবশিষ্ট চার জেলার দখলদারদের নামের তালিকা পাওয়া যাবে।

নদীর দখলকে হাইকোর্ট ফৌজদারি অপরাধ বলে ঘোষণা করেছে। দেশের সব নদীকে জীবন্ত সত্তাও ঘোষণা করেছে। সুতরাং জীবন্ত সত্তার ওপর যারা নির্যাতন করছে তারা সবাই ফৌজদারি অপরাধী। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন দুঃসাহসী একটি কাজ করতে পেরেছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ইতোমধ্যে এই তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। কোন জেলার কোন এলাকায় কোন দখলদার আছে তাদের নাম জেলা, উপজেলা ইউনিয়ন প্রকাশ করেছে। ওয়েবসাইটে তাদের জাতীয় পরিচিতি নম্বরসহ প্রকাশ করতে হবে। নদীর দখলদার শুধু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না তা নয়, সামাজিকভাবেও তারা খুবই হেয় প্রতিপন্ন হবেন। সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হলে আর কেউ সহজে নদী দখল করতে চাইবে না। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে ধন্যবাদ জানাই। তাদের এই নতুন চেষ্টা বাংলাদেশের নদীগুলো দখলদার থেকে নদী রক্ষায় একটি যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে।

ড. তুহিন ওয়াদুদ : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর ও পরিচালক রিভারাইন পিপল
[email protected]

 

 
Electronic Paper