ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত মিড ডে মিল

শামীম সিকদার
🕐 ৯:১৪ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৩, ২০১৯

দেশের সরকারি প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধ, ক্লাসে ছাত্র ছাত্রী ধরে রাখা এবং শিক্ষার মান বাড়াতে শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবার দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। শিশুদের জন্য যুগান্তকারী এ সিদ্ধান্ত নেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে জাতীয় স্কুল মিল নীতি-২০১৯-এর খসড়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

এ নীতিমালা অনুমোদনের ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দারুণভাবে উপকৃত হবে। তাদের আর না খেয়ে সোয়া ৪টা পর্যন্ত স্কুলে থাকতে হবে না। তারা এখন দুপুরে রান্না করা খাবার খেতে পারবে।

দুপুরে খাবার দেওয়ার ফলে শিক্ষার্থীরা পাঠ গ্রহণে আরও মনোযোগী হবে। বর্তমানে দুপুরের পর ছাত্র ছাত্রীরা ক্লাস করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কারণ এক শিফটের স্কুলে সকাল সোয়া ৯টা থেকে সোয়া ৪টা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের স্কুলে থাকার মতো শক্তি থাকে না। একটানা সাড়ে ৩ ঘণ্টা ক্লাস করার পর দুপুর সোয়া ১টার সময় মাত্র ৩০ মিনিটের বিরতি দেওয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে বাড়ি গিয়ে খাবার খেয়ে ফিরে আসাটা দুরূহ। ধরে নিলাম বাড়ি গিয়ে খেয়ে আসা সম্ভব, কিন্তু দুপুর ১টার মধ্যে গ্রামের কতজন মা পারেন রান্নার কাজ শেষ করতে। অধিকাংশই পারেন না। তার মানে দুপুরে না খেয়ে বা সামান্য কিছু খেয়ে বিকাল সোয়া ৪টা পর্যন্ত শিশুদের ক্লাসে থাকতে হয়।

এ অবস্থায় বিকালের ক্লাসগুলো তেমন কার্যকর হয় না। পড়াশোনায় ঠিকমতো মন দিতে পারে না। স্কুলের বেঞ্চে বসে থাকে ঠিকই, শিক্ষক কি পড়াচ্ছেন সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। এ সময়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি অর্ধেকে নেমে আসে। শিক্ষকরা বিকালের ক্লাসে থাকতে বাধ্য করলেও শিক্ষার্থীদের মনোযোগ থাকে না। তাই প্রাথমিকের সব শিক্ষার্থীকে দুপুরের খাবার দেওয়ার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত কার্যকর ও সময়োপযোগী। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিদ্যমান এসব সমস্যা দূর হবে। শিশুরা স্কুল থেকে দুপুরের খাবার পেলে লেখাপড়ার প্রতি আরও উৎসাহী হবে। সকালের মতো বিকালের ক্লাসেও পুরোদমে মনোযোগী থাকবে-এমনটা আশা করা যায়।

শৈশবে যদি সুষম ও পুষ্টিকর খাবার থেকে কেউ বঞ্চিত হয়, তবে সারাজীবন এর বিরূপ প্রভাব তাকে বয়ে বেড়াতে হয়। উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য চাই সুস্থ প্রজন্ম-শারীরিক ও মানসিকভাবে যারা হবে স্বাস্থ্যবান। মিড ডে মিল চালু হলে শিশুরা শারীরিকভাবে সবল ও মানসিকভাবে উৎফুল্ল থাকবে, যা পড়াশোনার প্রতি তাদের আগ্রহ আরও বৃদ্ধি করবে, শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনে হবে অত্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ। পুষ্টি চাহিদা পূরণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারে মিড ডে মিল কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-এসডিজির ৪ নম্বর অভীষ্ট অর্জন করতে হলে প্রাথমিকে শতভাগ পাস নিশ্চিত করতে হবে। আর এ জন্য প্রয়োজন শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা। শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে হলে প্রয়োজন শিশুদের মেধার বিকাশ ঘটানো। মেধাবিকাশে শিশুকে খাওয়াতে হবে পুষ্টিকর খাবার। বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিশুদের মেধাবিকাশ ঘটিয়ে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে মিড ডে মিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সত্যিকারের শিক্ষায় শিক্ষিত হবে আগামীর ভবিষ্যৎ। দূর হবে শিশুর পুষ্টিহীনতা।

শিশুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের সূতিকাগার হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়। শিশুরা যেন সুস্থ দেহে ও মনে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে তার ব্যবস্থা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য দুপুরের খাবার বেশি প্রয়োজন। এক শিফটের স্কুলে তারা সকাল সোয়া ৯টায় স্কুলে আসে এবং দুই শিফটের স্কুলে তারা আসে ১২টায়। সবাইকেই বিকাল সোয়া ৪টা পর্যন্ত স্কুলে থাকতে হয়ে।

এসব শিক্ষার্থী দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকার কারণে পড়াশোনায় মন দিতে পারে না। এতে করে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। আবার যেসব ছেলে-মেয়ে মধ্যাহ্ন বিরতিতে বাড়ি যায়, তারা প্রায়ই বিদ্যালয়ে ফিরে আসে না। অনুপস্থিতির হার বৃদ্ধি এবং ঝরে পড়ার এটাও একটা উল্লেখযোগ্য কারণ। ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন হচ্ছে না।

মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের জানান, জাতীয় স্কুল মিল নীতি-২০১৯ এর আওতায় ৭ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সারা দেশে ৬৬ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১ কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থীর মিড ডে মিল চালু করা হবে। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার বৃদ্ধি ও ঝরে পড়া হ্রাস করতে সারা বছর পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার দিতে এ নীতিমালার অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এ নীতিমালা অনুসারে শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে পাঁচ দিন গরম খাবার ও এক দিন পুষ্টিকর বিস্কুট দেওয়া হবে।

২০২৩ সালের মধ্যে সারা দেশের স্কুলগুলো এ কর্মসূচির আওতায় আসবে। তবে শুরুতেই চর, হাওর, দুর্গম এলাকার স্কুলগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জাতীয় স্কুল মিল কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের উপ-পরিচালক, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার সহকারী উপ-পরিচালক ও উপজেলা শিক্ষা অফিসার সম্পৃক্ত থাকবেন। এছাড়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে পার্বত্য জেলা পরিষদ ও স্থানীয় প্রশাসনের অংশ হিসেবে কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত থাকবেন। কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় স্কুল মিল কর্মসূচি বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে।

কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি সেল বা ইউনিট কাজ করবে। প্রয়োজনবোধে প্রাথমিক মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি পৃথক জাতীয় স্কুল মিল কর্মসূচি কর্তৃপক্ষ গঠনের বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় আছে। সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে পরীক্ষামূলকভাবে ৪৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের ১০৪টি উপজেলার ১৫ হাজার ৩৪৯টি বিদ্যালয়ের ৩০ লাখ শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবার দেওয়া হচ্ছে।

এর মধ্যে তিনটি উপজেলায় রান্না করা খাবার এবং বাকি উপজেলায় বিস্কুট দেওয়া হচ্ছে। দুপুরের খাবার দেওয়ার ফলে ওইসব উপজেলায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বেড়েছে। এর মধ্যে রান্না করা খাবার দিলে ১১ শতাংশ এবং বিস্কুট দিলে ৬ শতাংশ উপস্থিতি বৃদ্ধি পেয়েছে। ঝরে পড়ার হার ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে এবং শারীরিক অবস্থারও অনুকূল পরিস্থিতি দেখতে পেয়েছি। রান্না করা খাবার দেয়া এলাকায় ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং বিস্কুট দেওয়া এলাকায় ৪ দশমিক ৭ শতাংশ রক্তস্বল্পতা কমেছে।

এ বিবেচনায় মন্ত্রিসভায় জাতীয় স্কুল মিল কর্মসূচি অনুমোদিত হয়েছে। সরকারি পরিকল্পনা হলো, যে এলাকায় যে ধরনের খাবারের প্রয়োজন সে ধরনের খাবার দেওয়া হবে। প্রতিদিন একই খাবার না দিয়ে খাবারে বৈচিত্র্য থাকবে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভোগে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের অপুষ্টির মাত্রা বেশি। গ্রামের শিশুরা সকালে না খেয়ে বা কোনোমতে খেয়ে স্কুলে যায়। ফলে তাদের দৈনিক ক্যালরি চাহিদা পূরণ হয় না। এসব ক্যালরি ঘাটতি শিশুরা ক্লাসে অমনোযোগী থাকে। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী লেখাপড়ায় পিছিয়ে থাকে। পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিতেই মিড ডে মিল চালু করা হচ্ছে।

জাতীয় স্কুল মিল কর্মসূচির নীতিমালায় বলা হয়েছে, একটি শিশুর প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় শক্তির চাহিদার ন্যূনতম ৩০ শতাংশ স্কুল মিল থেকে পূরণ নিশ্চিত করা হবে। যা প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিশুদের জন্য প্রযোজ্য হবে। অর্ধদিবস স্কুলের ক্ষেত্রে দৈনিক প্রয়োজন পুষ্টির চাহিদা ন্যূনতম ৫০ শতাংশ, জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা অনুযায়ী দৈনিক প্রয়োজনীয় শক্তির ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রোটিন থেকে এবং ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ চর্বি থেকে পূরণ নিশ্চিত করা হবে। প্রতিদিনের খাবারে বৈচিত্র্য আনতে পুষ্টিচাল, পুষ্টিতেল, ডাল, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বিভিন্ন মৌসুমি তাজা সবজি, ফল এবং সম্ভাব্য ক্ষেত্রে ডিম দিয়ে খাবার রান্না করা হবে। অভিভাবক ও স্থানীয় জনগণের সঙ্গে পরামর্শ করে খাবারের মেন্যু ঠিক করা হবে।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের দুপুরে রান্না করা খাবার দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেশের ইতিহাসে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিদিন দুপুরের খাবার পরিবেশন করা একটি সাহসী কর্মসূচি। বর্তমান সরকারের পক্ষেই এ ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা দুপুরের খাবার পেলে পড়ালেখায় অধিকতর মনোযোগী হবে। বৃদ্ধি পাবে এ স্তরের শিক্ষার মান। ক্লাসে উপস্থিতি বাড়বে। রোধ হবে ঝরে পড়া। প্রান্তিক জনপদে অনেক শিশু শিক্ষার্থী আছে যারা চাহিদামতো মানসম্পন্ন পুষ্টিকর খাবার খেতে পারে না।

এসব শিশু প্রতিদিন একবেলা ভালো মানের পুষ্টিকর খাবার খেতে পারবে। এদিক থেকে এটি একটি মানবিক কর্মসূচি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তাই এ কর্মসূচি যেন স্বচ্ছতা ও দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়ন হয়। এমন মানবিক ও শিশুতোষ কমসূচি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে প্রয়োজন সঠিক ব্যবস্থাপনা। নজরদারি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারলে শিশুরা কাক্সিক্ষত সুফল পাবে। এ কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত সব পর্যায়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্তরিকভাবে কাজ করার আহ্বান জানাই। প্রধানমন্ত্রীর এ কর্মসূচির শতভাগ সফলতা কামনা করি।

শামীম সিকদার : শিক্ষক ও কলামনিস্ট
[email protected]

 
Electronic Paper