বাঁচায় নদী, বাঁচাও নদী
নদীকেন্দ্রিক পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা
ড. তুহিন ওয়াদুদ
🕐 ৮:৫৬ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৫, ২০১৯
বাংলাদেশে শিরা উপশিরার মতো প্রায় ২ হাজার নদী এখনো বেঁচে আছে। এর কোনোটি ছোট, কোনোটি মাঝারি কোনোটি বড়। এগুলোর মধ্যে অনেক নদীতে বারো মাস পানি থাকে। অনেক নদী বর্ষার পানিতে প্রাণ লাভ করে। শুধু বর্ষায় প্রাণ লাভ করা এ রকম নদীকে মৌসুমি নদী বলা হয়। বাংলাদেশে যেসব এলাকায় বড় বড় নদী আছে সেসব এলাকায় নদীকেন্দ্রিক পর্যটন শিল্পের বিকাশ সাধন করা সম্ভব। আমাদের দেশে এই সম্ভাবনা অপার। কিন্তু আজ অব্দি আমাদের দেশে নদীকেন্দ্রিক পর্যটন শিল্প গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রীয় কিংবা বেসরকারি কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আমাদের দেশে সমুদ্র, পাহাড় এর পরপরই নদীকেন্দ্রিক পর্যটনশিল্প মানুষকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করার কথা। আমরা দীর্ঘদিন ধরে নদীবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপল নদী পর্যটনের পক্ষে এই প্রচারণার কাজ করে আসছি। কিন্তু প্রচারণা এখনো সরকার পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
কয়েকদিন আগে কুড়িগ্রাম জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জিলুফার ইয়াছমিন মুঠোফোনে নদীর কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, কুড়িগ্রামে নদীনির্ভর পর্যটন শিল্পের বিষয়ে সরকারের কাছে আবেদন করা যেতে পারে। সরকার আন্তরিক হবে এই কাজে এমনটাই তার বিশ্বাস। কুড়িগ্রাম বাংলাদেশের এমন একটি জেলা যার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে অর্ধশত নদী। প্রচলিত ধারণায় মনে করা হয়, কুড়িগ্রামে নদ-নদীর সংখ্যা মাত্র ১৬টি। আমি নিজেই সরেজমিন অনুসন্ধান করে ৫০টি নদীর সচিত্র পরিচিতি আমার নিজের লেখা ‘রংপুর অঞ্চলের নদ-নদী’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছি। ১৬টির অধিক শুধু আন্তঃসীমান্তীয় নদী রয়েছে কুড়িগ্রামে। কুড়িগ্রামের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং মেঘালয়ের সীমান্ত রয়েছে। বাংলাদেশের একক কোনো জেলা দিয়ে কুড়িগ্রামের চেয়ে বেশি পানি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে না। ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, গঙ্গাধর, কালজানির মতো বড় বড় নদীর পানি এ জেলা দিয়েই বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে। ভারত থেকে বাংলাদেশে যেসব নদীর পানি প্রবেশ করেছে তার চারভাগের প্রায় তিনভাগের বেশি পানি কুড়িগ্রাম দিয়ে প্রবেশ করেছে।
অপার সৌন্দর্য নিয়ে এই নদীগুলো প্রবাহিত হয়। একেক মৌসুমে এ নদীগুলো একেক সৌন্দর্য নিয়ে উপনীত হয়। ভরা বর্ষায় যখন নদীগুলোপূর্ণ যৌবন লাভ করে তখন প্রকৃতি যেন সৌন্দর্য উদার হস্তে ঢেলে দেয়। যারা একবার এই সৌন্দর্য দেখেন তারা আমৃত্যু এই সৌন্দর্য ভুলতে পারেন না। নদীর সকালের রূপের সঙ্গে দুপুরের রূপ এক হয় না। বিকালের সঙ্গে সন্ধ্যার রূপে আছে বৈচিত্র্য। রাতের নদী আসে আলাদা সৌন্দর্য নিয়ে। গ্রামের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা একটি ছোট কিংবা মাঝারি নদীর সঙ্গে ব্রহ্মপুত্রের কিংবা ধরলা, তিস্তা, দুধকুমারের সৌন্দর্য সমান হবে না। ব্রহ্মপুত্র প্রশস্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার। বিস্তৃত খোলা আকাশ সামুদ্রিক সৌন্দর্যের রূপ নিয়ে হাজির হয়। সমুদ্র সৈকত থেকে পর্যটকরা নৌকাযোগে অনেক পথ ভেতরে যেতে পারেন না। কিন্তু নদীর বুকে দীর্ঘ সময় ধরে ভেসে বেড়ানো সম্ভব। কুড়িগ্রামে চরের সংখ্যা পাঁচশতাধিক। পাঁচ শতাধিক চরের মধ্যে বড় বড় চরে গড়ে তোলা সম্ভব উপযোগী স্থাপনা। চারদিকে প্রবাহিত নদী। মাঝখানে রাত্রি যাপনের জন্য সব সুবিধার ব্যবস্থা করতে পারলে পর্যটকরা বারবার আসতে চাইবেন।
শুধু বাংলাদেশের পর্যটক নয়, সারাবিশ্বের পর্যটকদের আকৃষ্ট করা সম্ভব। নৌপথে ঢাকা থেকে অনায়াসে কুড়িগ্রামে আসা যায়। ভারতের সঙ্গে নৌ যোগাযোগ আজও বিদ্যমান। কুড়িগ্রামে চিলমারী একটি ঐতিহাসিক বন্দর। এই বন্দর সরকার পুনরায় সচল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বন্দর চালু হলে নৌপথে জলযানের ব্যস্ততা বাড়বে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব জেলা কুড়িগ্রাম। কুড়িগ্রামে নদীকেন্দ্রিক পর্যটনশিল্প গড়ে তোলা সম্ভব হলে নতুন এক কর্মক্ষেত্রের দিগন্ত উন্মোচিত হবে। চিলমারীর ব্রহ্মপুত্রের তীরে বেড়ে উঠেছেন অধ্যাপক তোফায়েল হোসেন। তিনি বলেন- দেশের অসংখ্য পর্যটন কেন্দ্রের চেয়ে নদীকেন্দ্রিক পর্যটন এলাকায় মানুষের আনাগোনা বাড়বে। নদীকেন্দ্রিক পর্যটনশিল্পের এক বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। কুড়িগ্রামের অর্থনীতির চেহারাই পাল্টে দেবে নদী পর্যটন। জন্মগতভাবে মানুষ নদী সমুদ্র-পাহাড়ের প্রতি আসক্ত। এই সৌন্দর্যের প্রতি মানুষ এক দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভব করে। পর্যটন হিসেবে তাই অত্যন্ত সম্ভাবনাময় আমাদের নদী।
চিলমারীতে গ্রামের বাড়ি ফারহান রাফিদের। যে কোনো ছুটিতে বাড়ি গেলেই ছুটে যায় নদীর পাড়ে। তার মতে- ‘নদীকেন্দ্রিক পর্যটনশিল্প গড়ে উঠলে সেটি অসাধারণ হবে। মানুষের ঢল নামবে নদীর পাড়ে।’ সদ্য লেখাপড়া শেষ করেছে মাসুমা খাতুন। তার ভাষ্য- ‘বিশেষ করে জোছনা দেখার জন্য প্রচুর মানুষ ভিড় করবে নদীর পাড়ে।’ তবে মাসুমা চায় নদীকে যেন কোনোভাবেই নোংরা করা না হয়। আমাদের দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে নদীর প্রতি রাষ্ট্রীয় পরিচর্যা খুবই কম। কয়েক বছর ধরে সরকার নদীর প্রতি কিছুটা দায়িত্বশীল হয়েছে। যদিও এই চেষ্টা পর্যাপ্ত নয়। তবে সরকারি এই চেষ্টা আমাদের আশাবাদী করে তুলেছে। সরকারি পর্যায়ে পরীক্ষামূলকভাবে ব্রহ্মপুত্রে একটি পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা যায়। সেখানে পর্যটকদের জন্য কয়েকশ স্পট গড়ে তুলতে হবে। পর্যটকরা যাতে নদীতে স্নান করতে পারে সে ব্যবস্থা রাখতে হবে। মাছ ধরে মাছ নিজেরা রান্না করে খেতে পারবে সেই ব্যবস্থাও রাখার প্রয়োজন আছে। রিভার ক্রুজ পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন শক্তিশালী। আমরা মনে করি এসব প্রজেক্ট গ্রহণ করার মতো যথেষ্ট সামর্থ্য এখন সরকারের আছে। সরকার নদীকেন্দ্রিক পর্যটনের দিকে মনোযোগী হলে মানুষের সুস্থ ধারার একটি বিনোদনের ব্যবস্থাও হবে। একবার এই উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব হলে আগামীতে অনেক নদীর পাড়ে পর্যটন গড়ে উঠবে, এমনটাই মনে হয়। দেশের সবচেয়ে বড় পর্যটনশিল্পের ক্ষেত্র হতে পারে নদী পর্যটন। কম খরচে মানুষ এই বিনোদন গ্রহণ করতে পারবে। নদী পর্যটনের মাধ্যমে দেশের অনেক নদীর প্রতিও সরকারের যথেষ্ট মনোযোগ বাড়বে।
ড. তুহিন ওয়াদুদ : সহযোগী অধ্যাপক বাংলাবিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর ও পরিচালক রিভারাইন পিপল
[email protected]