ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

‘আমাকে দেখে বুঝে নেও’

আবু বকর সিদ্দীক
🕐 ১০:০৫ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৩, ২০১৯

বাবা বুকে আগলে রেখে নিরাপত্তা দিয়েছে, অতন্দ্র প্রহরী হয়ে রক্ষা করেছে মেয়েকে। বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরুষ। সবাই আদর্শ স্বামী হতে পারে না, কিন্তু পিতা হিসেবে কেউ কখনো কন্যার কাছে হেরে যায়নি। অথচ নষ্ট রাজনীতি আর ক্ষমতার কালো চাঁদরে ঢাকা আইন ব্যবস্থার কাছে বাবার বিশাল হৃদয় ভেঙেচুরে চুরমার।

মধ্য বয়স্ক লোকটার মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। সমুদ্রের তীরের মানুষ বাতাসে আইলার গন্ধ বোঝে। ঘূর্ণিঝড়-টর্নেডোকে মোকাবেলা করেই তারা বেঁচে থাকে। প্রকৃতির সঙ্গে পারলেও কয়েকদিনের মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগে সে ধসে গেছে। ঘুমহীন চোখগুলো ঝাপসা, বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে দৃশ্য ও অদৃশ্য পাহাড়সম ক্ষমতার সঙ্গে সে লড়ছে পিতৃত্বের শক্তি নিয়ে। একা সামনে কলিজার টুকরো মেয়েটার করুণ মুখ। বাবারা হারে না। জীবন দেয়। মেয়ের জন্য বাবারা জীবন নিতেও দ্বিধা করে না।

প্রযুক্তির কল্যাণে সারা বিশ্ব যখন আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির স্বামী রিফাত শরীফকে কুপিয়ে খুন করতে দেখেছে, বরগুনা সরকারি কলেজের সামনের সে ঘটনায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মিন্নিও লড়েছে স্বামীকে বাঁচাতে। গত ২৬ জুন সকালের সে ঘটনা চিহ্নিত আসামিরা ক্ষমতার সুবিধাভোগী, ক্ষমতাসীনদের সিঁড়ি। ১৩ জুলাই শ্বশুরের অভিযোগের পর ১৪ জুলাই বরগুনার সর্বস্তরের জনগণের ব্যানারে প্রকাশ্যে আসে খুনি চক্রের পৃষ্ঠপোষকরা। তারা দাবি তোলে মিন্নিকে গ্রেফতার করার।

বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও আওয়ামী লীগ নেতা সুনাম দেবনাথ সে দাবির পক্ষে বক্তব্য রাখেন। চক্রটি খুনিদের গ্রেফতার বা রিফাত শরীফ হত্যার বিচার দাবিতে কোনো কর্মসূচি দেয়নি। লোক দেখানো শোক ও সান্ত্বনা দিলেও তারা খুনিদের রক্ষার জন্য মামলার প্রধান সাক্ষীকে আসামি বানাতে রগরগে গল্প ফেঁদেছেন, সাময়িক সাফল্যও পেয়েছেন।

নিহত রিফাত শরীফের বাবা দুলাল শরীফকে কব্জা করার ধোঁয়াশা বাতাসে ছিল। তাকে দিয়ে সংবাদ সম্মেলন ও মিন্নিকে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়ানোর চক্রান্ত সামনে এসেছে গত শনিবার রাতে। একটি অনলাইন মাধ্যমে সংবাদের তথ্যে দেখা গেছে, বরগুনার সদর রোডে অবস্থিত সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ব্যক্তিগত কার্যালয়ে রাত পৌনে ১০টার দিকে উপস্থিত ছিলেন দুলাল শরীফ। রাত ৯টা ৫৩ মিনিটে এমপির ছেলে সুনাম দেবনাথ এমপির কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে দুলাল শরীফের কানেকানে কথা বলেন। এর পরপরই সে দ্রুত চেম্বার থেকে বেরিয়ে যান। এ সময় চেম্বারে বরগুনা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আবদুর রহমান নান্টু ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল বারী আসলাম উপস্থিত ছিলেন।

শুরু থেকেই এ মামলার আসামিদের গডফাদার হিসেবে এমপি ও তার ছেলের নাম উচ্চারিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তারের খেলায় নয়ন বন্ডের বাহিনী ছিল এমপির ছেলের প্রধান হাতিয়ার। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের ভায়রার দুই ছেলে এ মামলার অন্যতম প্রধান আসামি, তারাও চাপাতি হাতে কুপিয়েছে এবং স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। মিন্নির বাবা প্রকাশ্যে আদালত চত্বরে বলেছিলেন, সব কিছুই করছেন শম্ভু বাবু। এত সবই তার খেলা। তার ছেলে মাদকের সম্রাট। আসামিরা সবাই তার ছত্রছায়ায় ছিল। ছেলেকে বাঁচানোর জন্য আমাদের বলি দিচ্ছে।

অন্য জায়গার মতো এখানেও মাদকই বন্ধু থেকে শত্রু ও হত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ক্রসফায়ার ও চাপাতিঘাতে দুনিয়া ছেড়ে যাওয়া নয়ন ও রিফাতের নামে একাধিক মাদক মামলা ছিল। তাদের বন্ধুত্বের মাঝে মিন্নিকে খলনায়িকা বানানোর চেষ্টা করে ক্ষমতা ও প্রশাসন মাদককে আড়াল করতে চাচ্ছে। এলাকায় আধিপত্য ও মাদকের ব্যবসা নিয়েই নয়ন-রিফাতের বিরোধের শুরু। গত ১১ মে রাতে ১০০টি ইয়াবাসহ গ্রেফতার হয় রিফাত। ১৯ দিন হাজত খেটে বেরিয়ে এসে এ ঘটনার জন্য দায়ী করে নয়নদের। প্রতিশোধ নিতে জুনে সে রিফাত ফরাজীকে হাতুড়িপেটা করে। চাপাতি হাতে ক্ষমতাধর পরিবারের দুই ফরাজীপুত্রকে সেদিন বেপরোয়া হতে দেখেছে সবাই। মাদকের কারবারের সঙ্গে ক্ষমতা ও প্রশাসন জড়িত। তাদের হাত অনেক লম্বা। নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে এবার তারা শোকাহত স্ত্রীচরিত্রে কালিমা লাগাতেও দ্বিধা করে না।

বরগুনার মাদক কারবারিদের দৌরাত্ম্যের চিত্র পাওয়া যায় ০০৭ গ্রুপের মাধ্যমে। তাদের অন্যতম কাজ ছিল মাদক সেবন ও বিক্রি। দামি মোবাইল ফোন ও লেটেস্ট মডেলের মোটরসাইকেল নিয়ে তারা শহর দাপিয়ে বেড়াত। ফেসবুকে তারা চাপাতির ছবি দিয়ে হামলায় আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এসব যারা দেখেও না দেখার ভান করেছে, তারা মিন্নির অনেক ব্যক্তিগত বিষয় দেখতে অতি উৎসুক্যের পরিচয় দিয়েছে। সোনাগাজীর নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে মারার পর সেখানেও ক্ষমতাসীনরা আদিম খেলায় মেতে উঠেছিল। নুসরাতকে নষ্ট মেয়ের অপবাদ থেকে বাঁচিয়েছেন রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তি।

সব নাটক গর্তে ঢুকেছে, ওসির ভিডিও বার্তা এডিট হওয়ার আগেই সে নিজেই এখন শ্রীঘরে। কিন্তু বরগুনার ঘটনাটি সারা দেশের মানুষের বুকে কাঁপন ধরালেও মিন্নি এখন নষ্টদের দখলে। রিমান্ডে যে অত্যাচার তার ওপর হয়েছে তার বর্ণনা দিয়েছেন বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর। মেয়ের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে তিনি আদালতে দাঁড়িয়ে এসপিকে বলেছিলেন, এসপি সাহেব আমাকে গ্রেফতার করুন। আমি এখানে গ্রেফতার হতে কিংবা মারা যাওয়ার জন্য এসেছি। এত নির্মমতার শিকার মানুষ কেন হবে? কি অন্যায় আমার মেয়ের? সে জীবনবাজি রেখে স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। সেই চেষ্টা করাই কি তার অপরাধ?

রিফাত খুন হওয়ার পর প্রধান আসামি নয়ন বন্ড ২ জুলাই ভোরে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। রিফাতের বাবা দুলাল শরীফের মামলায় আসামি ১২, পুলিশের হিসেবে এ মামলায় গ্রেফতার ১৩ আসামি (মিন্নিসহ) আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ তথ্যের অবতারণা এজন্য যে, নয়ন বন্ড নিহতের দুদিন পরেই অনলাইন মাধ্যমে একটি আপত্তিকর ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয়। নয়ন-মিন্নির সে ভিডিও যদি সত্যি হয় তাহলে তা নিহত নয়নের মোবাইল থেকেই ছড়ানো হয়েছে। বিষয়টি পরিষ্কার, সে ফোনটি নিশ্চয়ই পুলিশের জিম্মায় থাকার কথা। প্রযুক্তি অনেক এগিয়েছে, মুহূর্তেই বলে দেওয়া সম্ভব এ জঘন্য কাজটি কারা করেছে। কোনো উদ্দেশে করেছে তাও স্পষ্ট।

পুলিশের দেওয়া তথ্যে হামলা, ভাঙচুর, চাঁদাবাজি, ছিনতাই এবং মাদক ব্যবসাসহ ১২টি মামলার আসামি ছিল নয়ন বন্ড। তার সাঙ্গপাঙ্গরাও কম যায় না। জিরো টলারেন্সে মাদকের বিরুদ্ধে সারা দেশে প্রশাসন যখন যুদ্ধরত তখন বরগুনায় কিভাবে সংগঠিত একটি দল প্রকাশ্যে চাপাতি নিয়ে মাঠ দাপিয়ে বেড়ায়?

গত শনিবার যখন কারাগারে মিন্নির সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে চোখে পানি ধরে রাখতে পারেননি মোজাম্মেল হোসেন কিশোর। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না মিন্নি। এদিক-ওদিক ঢলে পড়ছেন। দুই পাশ থেকে পোশাকী কারারক্ষী তাকে ধরে রাখছেন। প্রকাশ্যে রাজপথে বেপরোয়া চাপাতির কোপে কদিন আগে স্বামীকে হারিয়েছেন। বিচার চেয়ে সে মামলায় প্রধান সাক্ষী ছিলেন তিনি। দ্রুত পাল্টে গেছে চিত্রপট। এখন সাক্ষী থেকে আসামি। আদালত তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। মিন্নিকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের চিহ্নও স্পষ্ট।

বাবার সামনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে আদরের মেয়েটি শুধু বলেছে ‘বাবা, আমায় দেখে বুঝে নেও কী নির্যাতন ওরা চালিয়েছে। আমি যদি পুলিশের শেখানো কথা আদালতে না বলি, তাহলে আরও ১০ দিন রিমান্ডে এনে ওরা আমার ওপর নির্যাতন চালাত। তাই নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেতে বলেছি খুনের ঘটনার পরিকল্পনার সঙ্গে আমি জড়িত।’

এখন এ ঘটনাকে ঘিরে হাজারটা প্রশ্ন। অনলাইন মাধ্যমে উন্মুক্ত আলোচনা-সমালোচনা, সরব পক্ষ-বিপক্ষ। পুলিশের তদন্তে মিন্নি এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রমাণ করতে তাকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করার কোনো দরকার পড়ে না। আধুনিক সময়ে নিশ্চয়ই বর্বরতা আমাদের কাম্য নয়। প্রকাশ্যে যারা কুপিয়েছে, তাদের নিয়ে উচ্চবাচ্য নেই, খুনিদের যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে বেপরোয়া করেছে তারা এখন ভাসুর। অথচ একটা কলেজপড়ুয়া সদ্য বিধবা একটি মেয়েকে নিয়ে হামলে পড়ছে সবাই। আপত্তি এখানেই, জোর আপত্তি। সে অপরাধী হলে তার বিচার হোক, একবার বা পাঁচ দিনের নয়, হাজার বার জিজ্ঞাসাবাদ করুন, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই ফাঁসানোর জন্য জঘন্য নির্যাতন আর নয়।

নারায়ণগঞ্জের ত্বকীর বাবা বিচার পাননি, বিশ্বজিতের চাপাতি কালো কাপড়ে ঢাকা পড়েছে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি, কুমিল্লার সোহাগী জাহান তনুসহ অসংখ্য হত্যার কূল-কিনারা হয়নি। বিচার চাইলেই সংকটে পড়েন বিচারপ্রার্থী। অধরা বিচার বাড়িয়ে দেয় শোকের বহর। সেখানে স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে রিমান্ডে থাকা মিন্নির এ যন্ত্রণা ধারাবাহিক বিচারহীনতার ফসল। কিন্তু মিন্নির বাবা, তার বুকে জমে থাকা বারুদ? পথে-ঘাটে প্রতিদিন হাজারটা শকুন, বিকৃত পৌরুষের মানুষদের পরাজিত করে যে মেয়েকে আগলে রেখেছে, আজ সে যেন কারও কাছে নতজানু না হয়।

আবু বকর সিদ্দীক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
[email protected]

 

 
Electronic Paper