এরশাদ অধ্যায়ের ব্যবচ্ছেদ
মোতাহার হোসেন
🕐 ৮:৫০ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৯, ২০১৯
স্বৈরাচার তকমাধারী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরশাদ অধ্যায়ের অবসান হলো। ১৯৯০’র গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানোর পরও বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন আলোচিত-সমালোচিত। একাধারে তিনি ছিলেন নিন্দিত-নন্দিত, গণধিকৃত এবং অস্থির প্রকৃতির, সন্দেহপ্রবণ একজন মানুষ, একজন নেতা, একজন শাসক, একজন সেনাপতি। ইতোমধ্যে তাকে মূল্যায়ন, তার কর্মকাল, রাজনীতি, ক্ষমতা, শাসনকাল, ব্যক্তি, পারিবারিক জীবন প্রভৃতি নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে।
ক্ষমতা থেকে পতনের পর তাকে নিয়ে সাংবাদিক (মরহুম) কামরুল হুদা এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, ‘একজন লম্পট ব্যক্তি থেকে ক্ষমতা, অর্থ ও নারীদের দূরে রাখতে হয়।’ কিন্তু এরশাদ অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসে ক্ষমতার অপব্যবহার যেমনি করেছেন, তেমনি অর্থ কেলেঙ্কারি, নারী কেলেঙ্কারিতেও সমানভাবে লিপ্ত ছিলেন। এমন কি ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পরও এসবে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন তিনি। এসব নিয়ে হুদা ভাইয়ের দুঃখবোধ ঝরে পড়েছিল তার নিবন্ধে। বাস্তবে এরশাদের কাজ-কথা, সিদ্ধান্ত মূল্যায়নে এটা পরিষ্কার-তিনি কখনো তার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেননি। সকাল, বিকালে, রাতে এক এক সময়ে এক এক সিদ্ধান্ত নিতেন আর পাল্টাতেন। এ কারণে এরশাদ পতনের পর দীর্ঘ ৩০ বছরেও শক্তি ও জনসমর্থন নিয়ে মাঠে দাঁড়াতে পারেননি তিনি ও তার দল। কিন্তু দেশে আওয়ামী লীগবিরোধী যে সেন্টিমেন্ট ছিল তার সুযোগ রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে পারতেন তিনি। তা শুধু সম্ভব হয়নি তার অস্থিরতার কারণে। বিশেষ করে বার বার দলের মহাসচিব বদল, রাজনৈতিক বিষয়ে বার বার সিদ্ধান্ত বদলের কারণে।
বাংলাদেশে ‘স্বৈরাচার’ তকমাটি কেবল তার সঙ্গেই এঁটে আছে। তারপরও গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আলোচনা-সমালোচনা-বিতর্কের মধ্যে তিনি টিকে ছিলেন রাজনীতিতে; তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতির একটি বিশেষ অধ্যায়ের অবসান ঘটল। রাজনীতিতে ছিলেন আনপ্রেডিক্টেবল একজন নেতা, একজন দলপতি। অবাক করা বিষয় হলো, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলসহ বাংলাদেশে নেতিবাচক অনেক ধারা সৃষ্টির জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত এবং ‘বিশ্ব বেহায়া’ হিসেবে শিল্পীর তুলিতে চিহ্নিত হলেও নিজের সমর্থকদের কাছে ‘নায়ক’ হিসেবে সমাদৃত, নমস্য ছিলেন এরশাদ। আর্থিক কেলেঙ্কারি, নারীদের নিয়ে কেলেঙ্কারি, রাজনীতিতে একের পর এক ‘ডিগবাজি’ ছাপিয়ে তাদের কাছে তিনি ছিলেন ‘পল্লীবন্ধু’।
১৯৭৫ সালে এরশাদ ভারতের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে প্রতিরক্ষা কোর্সে অংশ নিতে গিয়েছিলেন। ওই বছরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকা-ের সময় সেখানেই ছিলেন। ওই সময় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসা জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হওয়ার পর তার উদ্যোগে ভারত থেকে এনে এরশাদকে করা হয় সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান, মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে। পাকিস্তান প্রত্যাগত এরশাদকে জিয়ার এই পদোন্নতি দেওয়া তখন ভালো চোখে দেখেননি মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তারা।
জিয়ার এক সময়ের ঘনিষ্ঠ অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ হামিদ তার বইয়ে লিখে গেছেন, এরশাদকে নির্বিষ ভেবে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঠেকাতে তাকে নিজের পরের পদটিতে বসিয়েছিলেন জিয়া। জিয়া রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ১৯৭৮ সালে ‘নির্বিষ’ এরশাদকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান করেন; কিন্তু সেই এরশাদই তার জন্য ‘কাল’ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বলে বিএনপি নেতারা এখন বলছেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে যে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত হন, তার পেছনে এরশাদই কলকাঠি নেড়েছিলেন বলে জিয়ার স্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অভিযোগ। ওই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের নেতা মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরকে তখন হত্যা করা হয়েছিল, সেই হত্যার মামলা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বইতে হয়েছে এরশাদকে, যদিও রায় হয়নি।
জিয়া নিহত হওয়ার পর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন এরশাদ। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে উৎখাত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন এরশাদ। নিজেকে সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করে সামরিক শাসন জারি করেন, স্থগিত করেন সংবিধান। প্রথমে বিচারপতি এ এফ এম আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির পদে বসিয়েছিলেন এরশাদ। কিন্তু সব ক্ষমতা ছিল এরশাদেরই হাতে, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এরশাদের অনুমোদন ছাড়া কোনো ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ ছিল না আহসানউদ্দিনের। তার এক বছর পর আর রাখঢাক না রেখে আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে সরিয়ে নিজেই রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসেন এরশাদ; যার এই ক্ষমতারোহণ অবৈধ বলে পরে রায় আসে আদালতের।
ক্ষমতায় বসার পর ‘গুরু’ জিয়াউর রহমানকে অনুসরণ করে রাজনৈতিক চাল চালতে থাকেন তিনি। প্রথমে জনদল নামে একটি দল তার পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল, যা ছিল তার রাজনীতিতে নামার প্রথম ধাপ। এরপর বিএনপি ও আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে গড়ে তোলেন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় পার্টি’, মৃত্যু পর্যন্ত এই দলটির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতেই। এরশাদ বলতেন, এটা তার দল। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগে উপজেলা গঠন করেন এরশাদ, তাতে প্রথম নির্বাচনের পরীক্ষায় নামে জাতীয় পার্টি; আর তাতে প্রায় সব উপজেলায়ই এরশাদের দলের প্রার্থী চেয়ারম্যান হন। উপজেলা নির্বাচনের পর রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন দিয়ে নিজের ক্ষমতা দখলকে জায়েজ করেন এরশাদ। এরপর ১৯৮৬ সালে সংসদ নির্বাচন দেন, যাতে জাতীয় পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। তবে এরশাদের আমলের ওই নির্বাচন কেমন ছিল, তা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্য ‘হুন্ডা-গুণ্ডা দিয়ে’ ভোটের কথাতেই ফুটে ওঠে।
এদিকে এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। ১৯৮৩ সালে হয় প্রথম সরব প্রতিবাদ, ওই সময় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে গুলিতে প্রাণ হারান জাফর, জয়নাল, দীপালী সাহাসহ বেশ কয়েকজন। তারপরের বছরই ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ ট্রাক তুলে দিয়ে হত্যা করে সেলিম-দেলোয়ারকে। দমন আর নির্যাতনের মুখে ছাত্র আন্দোলন আরও বেগবান হতে থাকে, শ্রমিকসহ পেশাজীবীরাও নামে আন্দোলনে। আর তা দমন করতে গিয়ে নূর হোসেনসহ অনেকের রক্তে রঞ্জিত হয় এরশাদের হাত।
গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত এরশাদ বন্দি হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে করা হয় অনেকগুলো দুর্নীতির মামলা। কিন্তু তার মধ্যেই চমক দেখিয়ে ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে রংপুরের ৫টি আসন থেকে বিজয়ী হন তিনি। এরপর বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি অবস্থানে জনধিকৃত এরশাদই রাজনীতিতে অবস্থান পেয়ে গিয়েছিলেন। কখনো আওয়ামী লীগের দিকে, কখনোবা বিএনপির দিকে ঝুঁকে নিজের পথ মসৃণ করতে দেখা গিয়েছিল তাকে। ওই সময় ৪২টি মামলা হয়েছিল এরশাদের বিরুদ্ধে; তাকে বাগে আনতে ওসব মামলাগুলোর ব্যবহারও দেখা গেছে।
ক্ষমতায় থাকাকালে এরশাদ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী এনে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যুক্ত করেন, যা বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বদলে দেয় এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলে কুঠারাঘাত বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত। ঢাকার বাইরে হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থাপনসহ আরও নানা পদক্ষেপে বিতর্কিত ছিল এরশাদের ক্ষমতার যুগ। গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত থাকায় এরশাদবিরোধী আন্দোলনে অন্য পেশাজীবীদের সঙ্গে শামিল ছিলেন সাংবাদিকরাও। এর মধ্যেও এরশাদের সময়ে প্রণীত ওষুধনীতি, উপজেলা প্রথা প্রবর্তন, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, চিকিৎসকদের গ্রামে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রশংসা পায় সমালোচকদেরও; তার গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প ও পথশিশুদের জন্য পথকলি ট্রাস্টও ছিল আলোচিত। এরশাদের সময়েই ১৯৮৫ সালে গঠিত হয় দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক, তবে ভারত-পাকিস্তান টানাপড়েনে তা কখনো কার্যকর হয়ে উঠতে পারেনি।
ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এরশাদ গত সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় লিখেছিলেন, তার নগদ টাকার পরিমাণ ২৮ লাখের মতো। তার বার্ষিক আয় ১ কোটি ৭ লাখ টাকা। বিভিন্ন শেয়ারে তার অর্থের পরিমাণ ৪৪ কোটি ১০ হাজার টাকা। তার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ও এফডিআর ৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। গুলশান ও বারিধারায় দুটি ফ্ল্যাট এরশাদের; রয়েছে তিনটি গাড়ি। রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় সাইকেল চালিয়ে অফিসে যাওয়া, হুট করে কোনো মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়ার মতো চটকদারি দেখাতে চাইতেন এরশাদ; গলফ নিয়েও ছিল তার মাতামাতি। নিজেকে ‘ফাদার অব বাংলাদেশ ক্রিকেট’ বলতে মজা পেতেন তিনি।
এসব ছাপিয়ে এরশাদ প্রতিবারই নির্বাচন এলে হয়ে উঠে আসতেন আলোচনায়, বড় দলগুলোর কাছে কদর বাড়ত তার। আবার ভোটের সময়ে বার বার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন ঘটত তার, যাকে ‘রাজনীতির বিনোদন’ হিসেবে দেখত বাংলাদেশের মানুষ। এক্ষেত্রে তার অস্থির প্রকৃতি, সিদ্ধান্তহীন আর বার বার সিদ্ধান্ত বদলকে রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, বৃদ্ধিজীবীরা স্বাভাবিকভাবে নেননি। এমনকি ভেতরে ভেতরে তার দলের নেতাকর্মীও এ নিয়ে প্রায়শ অস্বস্তিতে থাকতেন।
এরশাদ বলতেন, মনে অনেক কষ্ট নিয়েই তাকে সিদ্ধান্ত বদলানোর কাজটি করতে হয়। বলতেন, ‘সময় হলে’ সব বলবেন তিনি। কিন্তু সেই সময় আসার আগেই পৃথিবীতে তার সময় শেষ হয়ে গেল। দোষে-গুণে একজন মানুষ, একজন নেতা, একজন এরশাদ-এই দৃষ্টিতে তার জীবন, কর্মকাল, শাসনকাল বিবেচিত, আলোচিত-সমালোচিত, মূল্যায়িত হবে, এটাই কাম্য।
মোতাহার হোসেন : লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]