ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পরিবেশ সুরক্ষায় জনসচেতনতা

উম্মে হানি রিয়া
🕐 ৯:৩৯ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৬, ২০১৯

পরিবেশ সুরক্ষার ক্ষেত্রে আমরা কতটুকু সচেতন? সম্প্রতি প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের ইপিআই সূচকে পরিবেশ রক্ষায় ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৯তম। এ তথ্যই ধারণা দেয় যে, পরিবেশ নিয়ে আমাদের সচেতনতার অভাব রয়েছে। বনভূমি কমে আসা, বায়ু, পানিদূষণ, পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যরে বিপদে থাকা শীর্ষে ১০ দেশের তালিকা থেকে এখনো বের হতে পারেনি বাংলাদেশ।

পরিবেশ দূষণের ফলে যেরূপ ক্ষতিসাধন ঘটে তার আর্থিক মূল্য হিসাব করলে সেটা বিপুল পরিমাণে হবে। কিন্তু সচেতনতার অভাবে অনেকেই ক্ষতির কারণগুলো চিহ্নিত করতে পারে না। অতঃপর নিজের অজান্তেই আমরা পরিবেশ দূষণ করে থাকি। পরিবেশ দূষিত হওয়ার ফলে অসুখ-বিসুখের ব্যাপক বিস্তার লাভ ঘটে। অসুস্থ হলে আমরা ডাক্তারের কাছে শরণাপন্ন হচ্ছি কিন্তু একবারও কী ভেবে দেখেছি, অসুখ-বিসুখের উৎপত্তি কোথা থেকে? মূল কারণ হলো অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। আর এই এমন পরিবেশ সৃষ্টির পেছনে দায়ী আমাদের জীবনাচরণ ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন।

পরিবেশ সুরক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক উদাসীনতা ও খামখেয়ালিপনা রয়েছে আমাদের। যেখানে সাইনবোর্ড টানিয়ে লিখে দেওয়া থাকে ‘এখানে ময়লা ফেলবেন না’, সেখানে আরও বেশি করে ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয়। আমরা যত শিক্ষিত ও সভ্য হচ্ছি, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষায় যেন তত অসচেতন হয়ে পড়ছি। অতিরিক্ত পরিমাণে গাছকাটা, বনউজাড় করে দেওয়াসহ শব্দদূষণ ও গাড়ির বিষাক্ত ধোঁয়া নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। জলাশয়গুলোকে বানিয়ে ফেলছি ময়লা-আবর্জনা ফেলার আদর্শ স্থান।

পরিবেশ দূষণে মানুষের জীবনাচরণ যেমন দায়ী তেমনি দায়ী মানুষের সীমাহীন লোভ-লালসা। এই লোভ-লালসার ফলে মানুষ দখল করছে নদী, ভরাট করছে খাল, কাটছে পাহাড়, ধ্বংস করছে জীববৈচিত্র্য। হাইকোর্ট রুল জারি করার পরও দখলদারদের কবল থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না ঢাকা শহরের চারপাশের নদীগুলোকে। বন্ধ হচ্ছে না বুড়িগঙ্গার দূষণ। রাজধানীর ভিতরের খালগুলো দখলের কারণে যেমন সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশের নদীগুলো দখল ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে স্বাভাবিক প্রবাহ হারাচ্ছে। অনেক নদী মরে গেছে, যা অবশিষ্ট আছে তাও হারিয়েছে নাব্যতা। ফলে সামান্য বৃষ্টি কিংবা পাহাড়ি ঢল নামলেই সৃষ্টি হয় বন্যা। অধিক মুনাফা অর্জনের আশায় আমাদের দেশে অধিকাংশ কল-কারখানার মালিক ইটিপি (তরল বর্জ্য পরিশোধন প্ল্যান্ট) ব্যবহার করতে নারাজ।

রাসায়নিক সার ও কীটনাশক যথাযথ ব্যবহারে কৃষকদের নেই প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা। ব্যবহার করা হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। দীর্ঘদিন ধরে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ যেমন-ক্যাডমিয়াম, লেড ইত্যাদি খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। এ ছাড়া যেখানে সেখানে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে এবং সেখান থেকে নানা রোগ-জীবাণু ঢুকছে মানবদেহে। সব মিলিয়ে দূষণের কারণে এখন মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েছে। এর ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে জনজীবনে।

বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর যত মানুষের মৃত্যু হয় তার ২৮ শতাংশই মারা যায় পরিবেশ দূষণজনিত অসুখ-বিসুখের কারণে। অথচ পরিবেশ দূষণের উৎসগুলোকে রোধ করতে পারলেই অনেক অসুখ-বিসুখ যেমন-ব্রঙ্কাইটিস, হাঁপানি, অ্যাজমা, হৃদরোগ, লিভার ও কিডনির সমস্যাসহ অনেক জটিল রোগের সমাধান হয়ে যাবে অনেকাংশেই। এজন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা ও সরকারের সক্রিয়তা। আমরা যদি নিজ নিজ এলাকা অর্থাৎ নিজেদের পাড়া-মহল্লাগুলোকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখি তাহলে আমাদের পুরো দেশটাই হয়ে উঠবে নির্মল পরিবেশের অধিকারী। এজন্য জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে দেশের তরুণ সমাজকেই। পরিবেশ সুরক্ষায় জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য জনপ্রতিনিধি ও শিক্ষিত তরুণদের নিয়ে পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন গড়ে তোলা যেতে পারে। এই সংগঠনের সদস্যদের বলা হবে ‘সবুজ সৈনিক’ এবং যাদের কাজই হবে এলাকার মানুষদের পরিবেশ বিষয়ে সচেতন করা, দূষণের উৎসসমূহকে রোধ করা এবং কোথাও পরিবেশের জন্য ধ্বংসাত্মক কর্মকা- সংগঠিত হতে দেখলে তা নিরূপণে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা। বৃক্ষরোপণ ও সামাজিক বনায়নে এ জাতীয় সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই স্কুলে সেমিনার করে বাচ্চাদের মধ্যে পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পরিবেশবান্ধব আচরণ যেমন-নির্দিষ্ট জায়গায় ময়লা ফেলা, পানির পরিমিত ব্যবহারে বড়দের যেমন সচেতন হতে হবে তেমনি শিশুকেও তাদের ছোটবেলা থেকে পরিবেশবান্ধব আচরণে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। পরিবেশ রক্ষায় তরুণদের জ্ঞান, মেধা, মনন ও সৃষ্টিশীলতাকে কাজে লাগাতে হবে। আর এজন্য তরুণদের মধ্যে পরিবেশবিষয়ক জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিবেশ সম্পর্কিত বিজ্ঞানমেলা, অলিম্পিয়াড, কুইজ, বিতর্ক ইত্যাদি আয়োজন করা যেতে পারে। তরুণদের পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে হলে গবেষণা আবশ্যক। গবেষণার মাধ্যমেই পরিবেশ রক্ষার চ্যালেঞ্জগুলো জানা যাবে এবং সমাধান করা যাবে। তাই যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ বিজ্ঞান ও এ সম্পর্কিত বিভাগ রয়েছে ওই সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ বিষয়ক গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

পরিবেশ সুরক্ষায় জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যমকেও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষিত তরুণরা বিদ্যা অর্জনের পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে জনসেবামূলক কর্মে নিজেদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে পরিবেশ বিপর্যয় রোধে গণসচেতনতা বাড়াতে পারে। ক্ষমতার জোরে নদী ভরাট, পাহাড় কাটা, যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে শিল্প-কারখানা স্থাপন রোধে যেমন প্রয়োজন সরকারের কঠোর ভূমিকা তেমনি প্রয়োজন জনগণের সচেতনতা ও সতর্কতা। মনে রাখতে হবে, পরিবেশ বিপর্যয় রোধ সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। সরকারের কার্যকরি উদ্যোগের পাশাপাশি প্রয়োজন জনসচেতনতা ও আমাদের সবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।

উম্মে হানি রিয়া
লেখক ও কলামিস্ট

 
Electronic Paper