ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষিতার বিয়ে!

মুমিতুল মিম্মা
🕐 ১০:১৮ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৩, ২০১৯

কয়দিন আগে একটা খবর পড়লাম এ রকম যে, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে প্রভাবশালীর ছেলে মানসিক প্রতিবন্ধী নারীকে ধর্ষণের ফলে বাচ্চা প্রসব করায় উপজেলা পর্যায়ের সর্বোচ্চ সরকারি কর্মকর্তা ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন। খবরটি জনগণের কাছে খুবই প্রশংসিত হয়েছে। এবারে আসুন ধর্ষিতার দৃষ্টিকোণ থেকে তাকিয়ে একটু ভিন্নমতে কথা বলি।

বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়েটা আলাভোলা। জাগতিক কোনো ব্যাপারে সে সংশ্লিষ্ট হতে পারে না। তাকে খাইয়ে দিতে হয়, কাপড় ঠিক করে দিতে হয়, হাগুমুতু করাতে হয়, মাসিকের সময় পরিবারের মেয়েগুলোকেই যথেষ্ট ঝক্কি পোহাতে হয় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। কারণ পরিবারের কোনো প্রতিবন্ধী বাচ্চার দায়িত্ব পুরুষরা নেন, এ রকমটা খুব কমই দেখা যায়।

তো এই মেয়েটাকে দেখে ধর্ষকের মনে হয় খুবই সহজ শিকার। এদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারবে না, বললেও কেউ শুনবে না, মানবে না। তারপর ধর্ষক ছক কাটেন কীভাবে শিকার বাগে পাওয়া যায়। পেয়েও যান একটা সময়। (এ রকম কোনো ঘটনা শুনলে শুরুতেই হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকের রাবেয়াকে মাথায় আসে আমার। উপন্যাসটি যারা পড়েননি, পড়ে দেখতে পারেন)।

সম্ভাব্য দৃশ্যকল্প কেমন ছিল বলছি। ধর্ষণের সময় মেয়েটা বুঝতে সক্ষম না তাকে কী করা হচ্ছে। কিন্তু ধর্ষণের পুরোটা সময়জুড়ে সে তার স্পর্শকাতর জায়গায় ব্যথা পায়। ধর্ষকের উপর্যুপরি জোর করার জন্য যোনী ছিঁড়ে যায়। সে কাঁদে, মা-বাবাকে ডাকে। ধর্ষকের ভয়ানক উন্মত্ত আঁচড় কামড়ের শিকার হয়। ধর্ষণ শেষ হয়ে গেলে সে কাউকে বুঝিয়েও বলতে পারে না। তীব্র ট্রমায় পড়ে যায়। তলপেটে ব্যথায় কোঁকাতে থাকে। যোনী ছিঁড়ে যাওয়ায় হিসু করতে গেলে জ্বলতে থাকে। হাঁটতে পারে না ঠিক করে। কিন্তু সয়ে যাওয়া এত এত যন্ত্রণা ব্যক্ত করার ভাষা তার ঝুলিতে নেই যে!

এই ক্ষেত্রে মেয়েটা গর্ভবতী হয়ে পড়ে। নির্দিষ্ট সময় পর গর্ভাবস্থা প্রকাশিত হয় এবং জিজ্ঞাসাবাদে সব কথা বেরিয়ে আসে। বাচ্চাটা ভূমিষ্ঠ হয় পৃথিবীতে। আমাদের মাথায় রাখতে হবে একটা ভয়াবহ নির্যাতনের ফলাফল বাচ্চাটা। তাই বাচ্চাটার প্রতি মায়ের কোনো রকম মাসুলভ অনুভূতি না থাকাটাই স্বাভাবিক। বরং বাচ্চাটাকে দেখামাত্রই তার ধর্ষণের কাহিনী মনে পড়ে যায়, আবার সে নার্ভাস ব্রেক ডাউনের শিকার হয়। (অনেক ক্ষেত্রেই ধর্ষিতা মা ক্ষুব্ধ হয়ে ধর্ষণের ফলে ভূমিষ্ঠ বাচ্চাটাকে মেরেও ফেলতে চান)।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এর ৮ নম্বর আইনের ১৩ ধারার উপধারা (১) দফা (গ) অনুযায়ী ধর্ষণের ফলাফলে ভূমিষ্ঠ বাচ্চাটার দায়িত্ব রাষ্ট্রের নেওয়ার কথা। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র দায়িত্ব নেয় না বা হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পায় না। মেয়েটা এবং তার পরিবারকে একঘরে করে ফেলা হয়। মেয়েটার পরিবার স্থানীয় থানার দ্বারস্থ হয়েও কোনো ফল পায় না।

উপরোক্ত ক্ষেত্রেও তাই-ই ঘটেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কানে খবর পৌঁছামাত্র তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে সমাধানে এগিয়ে আসেন। কিন্তু তিনি আইন অনুযায়ী বিচারিক ব্যবস্থায় না গিয়ে ছেলের পরিবারকে চাপ দিয়ে মেয়েটাকে বিয়ে করাতে বাধ্য করেন। বিয়ে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান যেখানে আপনি সামাজিক মর্যাদা পান নারী পুরুষ একসঙ্গে থাকার এবং বাচ্চা উৎপাদন করার। বাচ্চা যদি বিয়ের স্বাক্ষর ছাড়াই উৎপাদিত হয় সেটাকে সমাজ বলছে জারজ। সেই বাচ্চাকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয় এবং সব সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়।

বিয়ের প্রাথমিক নিয়ামকগুলো কী কী? একেবারে সংক্ষেপে তিনটি- ১। পাত্রপাত্রীর পারস্পরিক সম্মতি ২। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ৩। শারীরিক-মানসিক সক্ষমতা।
মানসিক সম্মতি বিয়ের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কিন্তু বিয়ের ক্ষেত্রে মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়ের সম্মতি থাকবে না অবশ্যই। কেননা সম্মতি দেওয়ার মতো মানসিক অবস্থানে সে থাকে না। আবার একই সঙ্গে, তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া অন্যায়ও সে কোনোভাবেই ভুলতে পারে না।

ঘটনার বিবরণ থেকে জানা যাচ্ছে ধর্ষকের পরিবারও প্রভাবশালী এবং অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল। মেয়েটাকে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দিলে কোন নিয়ামকগুলোকে টিক দেওয়া হলো? সম্মতি এবং মানসিক সক্ষমতার মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটো পয়েন্টে অবজ্ঞা করে বিয়ের প্রসঙ্গ কীভাবে তোলা হয়?

কেবল এই ঘটনার প্রেক্ষাপটেই নয় বরং আরেকটু বড় পরিসরে বলি, সাধারণভাবে ধর্ষণের কথাটা বেশির ভাগ ধর্ষিতার পরিবার কাউকে বলে না একঘরে হয়ে যাওয়ার ভয়ে। আমাদের সমাজে ধর্ষিতা মাত্রই অচ্ছুৎ প্রতিপন্ন করা হয়। তাকে কোনোভাবেই পাত্রস্থ করা সম্ভব না বলেই পরিবার চেপে যায় ধর্ষণের ঘটনা। ধর্ষণ মূলত ক্ষমতার তীব্রতম বহিঃপ্রকাশ। আর যদি কোনো পরিবার উৎসাহী হয়ে আইনের দ্বারস্থ হতেও চায় বেশির ভাগ ধর্ষকের পরিবার থাকে তুলনামূলক প্রভাবশালী। তাই বিচারের দাবি নীরবে নিভৃতে কাঁদে।

এছাড়া বিচারিক ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা, বিচারিক খরচ এবং বিচার চলাকালীন আদালতে ধর্ষিতার হেনস্তা হওয়ার ভয় ভিক্টিম এবং ভিক্টিম পরিবারকে বিচারের পথে যেতে নিরুৎসাহিত করে। এসব প্রভাবকের কারণে বিয়েটাকেই সমাজের চাপে সাধারণ সমাধান হিসেবে দেখা হয়।

যে কোনো ধর্ষিতার ক্ষেত্রেই ধর্ষকের সঙ্গে তার বিয়ের ব্যাপারে সম্মতি থাকা সম্ভব নয়। ধর্ষক এবং ধর্ষিতার সম্পর্ক হলো ট্রমাটিক ঘৃণার। যতবার সে ধর্ষককে দেখবে ততবার তার ওপরে ঘটে যাওয়া অত্যাচারের কথা মনে পড়বে এবং ক্রমাগত তার ট্রমা বাড়তে থাকবে। ট্রমাটিক ঘৃণার সম্পর্ককে ভালোবাসায় রূপান্তরিত করা অসম্ভব ব্যাপার।

এবার আসি বিয়ের পরবর্তী দৃশ্যকল্পে। মেয়েটা কোনোভাবেই ভুলতে পারে না তার ধর্ষণকে। ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে হওয়ায় প্রতিনিয়ত পরিস্থিতি মানিয়ে নেওয়ার জন্য নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় তার। ধর্ষণের মতো ফৌজদারি অপরাধের বিচার না করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গ্রামীণ সালিশি মোড়লের মতো আচরণ করলেন। তার দেওয়া বিয়ের ফলাফল হলো সুদূরপ্রসারী-
১। ধর্ষণের বিচারের পথ দেখালেন না।
২। বিয়ের মাধ্যমে ধর্ষণের অপরাধমুক্তির মতো করে ধর্ষণের বৈধতা দিলেন।
৩। বিয়ের মোড়কে সন্তানের পিতৃত্ব নিশ্চিত করার জন্য মেয়েটাকে পুনরায় ধর্ষিত হওয়ার পথ বাতলে দিলেন।

প্রশ্ন আসতে পারে বিয়ের পরেও পুনরায় ধর্ষণের কথা কেন আসছে। ব্যাখ্যা করছি তা। কারণ বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী মিলিত হবেন এটা সামাজিক সত্য। কিন্তু কোনো ধর্ষিতা কি স্বেচ্ছায় ধর্ষকের সঙ্গে মিলিত হতে চাইবে? সহজ উত্তর চাইবে না। আর মেয়েটার না চাওয়া মানে অনিচ্ছায় বিছানায় যাওয়া। ছেলেটার হাতে যেহেতু বিয়ে নামক মিলিত হওয়ার লাইসেন্স আছে তাই সে ছাড় দেবে না। আর কারও অনিচ্ছায় জোর করে শারীরিক সম্পর্কের নাম ধর্ষণ এবং এক্ষেত্রের ফলাফল হবে দাম্পত্য ধর্ষণ। কিন্তু বিয়ের ট্যাগ যেহেতু মাথার ওপরে ঝুলে আছে তাই আমাদের সামাজিক ও বিচারিক পরিমণ্ডলে স্বামী কর্তৃক জোরপূর্বক মিলন ‘ধর্ষণ’ হিসেবে হালে পানি পাবে না। অথচ সম্মতি না থাকলে যে কোনো শারীরিক সম্পর্কই ধর্ষণ এবং দাম্পত্য ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধের আইনি স্বীকৃতি এবং শাস্তি জরুরি। দাম্পত্য ধর্ষণের প্রসঙ্গে সামাজিক মনস্তত্ত্বের পরিবর্তন করাটাও ভীষণভাবে জরুরি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসলে যে সমাধান দিতে চাইলেন তাতে বিয়ের আড়ালে ধর্ষণের অপরাধ ধামাচাপা পড়ে গেল এবং সেই সমাধান মেয়েটার ক্ষেত্রে বুমেরাং হবে এ কথা নিশ্চিন্তে বলা যায়।

কাজেই ধর্ষিতার সঙ্গে ধর্ষকের বিয়ে কোনোভাবেই হতে পারে না। কারণ ধর্ষণ পরিবর্তী ট্রমা নারী সারা জীবনেও কাটাতে পারেন না। তার ওপরে ঘটে যাওয়া অত্যাচারের বিচার না করে তাকে পুনরায় অত্যাচারিত হতে দেওয়া তীব্রতম মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং কোনোভাবেই এই অপরাধ চলতে দেওয়া যায় না। কাজেই ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষিতার বিয়েকে ‘না’ বলুন এবং রাষ্ট্রকে বেরিয়ে আসতে বলুন এই অমানবিক সমাধানের গোলকধাঁধা থেকে। সচেতন নাগরিক হিসেবে আওয়াজ তোলার এই দায়িত্ব আমাদের সবার। (পরের পর্বে সমাপ্য)

মুমিতুল মিম্মা : লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট

 
Electronic Paper