মাঠে-ঘাটে-বাটে
তরুণদের ভাবনা নিয়ে যৎকিঞ্চিত
তুহিন ওয়াদুদ
🕐 ৯:১৫ অপরাহ্ণ, জুলাই ০৬, ২০১৯
ঈদুল ফিতরের পূর্বাপর তরুণদের আয়োজনে এবং অংশগ্রহণে কয়েকটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। এ রকম অনুষ্ঠান এখন দেশজুড়ে অনেক স্থানেই হয়। অনুষ্ঠানগুলোর কাজের ধরন ভিন্ন ভিন্ন হলেও সবাই সেবামূলক কাজে মিলিত হওয়ার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করে থাকে। ঈদের কয়েকদিন আগে রংপুর উন্নয়ন ফোরাম নামের একটি সংগঠনের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। আমার অন্য একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ ছিল। তারপরও সেটি বাদ দিয়ে তরুণদের অনুষ্ঠানেই গেলাম। দুটি কারণে গেলাম।
প্রথমত, আয়োজনটি তরুণরা করেছে। দ্বিতীয়ত, রংপুরের উন্নয়নবিষয়ক কথাবার্তা হবে তাই। সুলতান মাহমুদ টিটন এই সংগঠনের আহ্বায়ক এবং রাকিব সদস্যসচিব। তারা সাহস করেছে রংপুর বিভাগের উন্নয়নবৈষম্য দূরীকরণে যে কোনো আন্দোলন করতে চায়। তাদের সঙ্গে আরও যারা এসেছে তারাও তরুণ। আহ্বায়ক এবং সদস্যসচিবের রাজনৈতিক পরিচয়ও আছে। রংপুর উন্নয়ন ফোরামের সংগঠকদের ভাষ্য-‘রংপুরের উন্নয়ন বুঝে নেবে রংপুরের জনগণ।’
দীর্ঘকাল ধরে রংপুর বাংলাদেশের গড় উন্নয়ন থেকে অনেক বঞ্চিত। শুধু বৈষম্য দূরীকরণ তথা রংপুর বিভাগের জন্য একটি প্লাটফর্ম তো আগে কখনই হয়নি। যখন হলো তখন দেখলাম তরুণরা একত্রিত হয়েছে। আমি তো এতসব তরুণ দেখে খুবই আশাবাদী। আলোচনা থেকেই বুঝলাম এর নেপথ্যে বিজ্ঞ রাজনীতিক আতাউজ্জামান বাবু ভাই আছেন। প্রতিশ্রুতিশীল এই তরুণরা এরই মধ্যে রংপুরের সঙ্গে অন্য এলাকার বৈষম্য দূরীকরণের দাবিতে মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদান এবং সংবাদ সম্মেলন করেছে। তরুণদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ অনেক ব্যক্তি।
এবার তারা উদ্যোগ নিয়েছে সংসদ সদস্য-মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে একটি গোলটেবিল বৈঠকের। তারা তাদের কার্যক্রম সব রংপুর বিভাগে বিস্তৃত করতে চায়। আমার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য পরামর্শ নেওয়ার কাজ তারা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের চেষ্টায় আমি আশাবাদী।
কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলারও প্রত্যন্ত এলাকা সুকদেব। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ুয়া একদল শিক্ষার্থী একত্রিত হয়ে একটি সংগঠন চালু করেছে। তারা তাদের এলাকায় বাল্যবিয়ে এবং মাদক দূর করতে চায়। দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীর লেখাপড়া বাধাহীন করতে চায়। আপাতত তারা তাদের ছোট্ট এলাকাটিকেই বেছে নিয়েছে। পরে কার্যক্রম আরও বাড়াতে চায়। তাদের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে তরুণদের দেশ গঠনের দায়িত্বশীলতা একটি অনন্য বাংলাদেশের স্বপ্নকে আরও বড় করে তুলেছে।
প্রথম আলোর সাংবাদিক সফি খান গত রমজান মাসের শেষ দিনের আগের রাতে মুঠোফোনে পরামর্শ করে একটি সভা আহ্বান করেন। যারা কুড়িগ্রামের বাইরে থাকেন ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসেছেন তাদের অংশগ্রহণে একটি আড্ডা দিতে চাওয়াই উদ্দেশ্য। সফি ভাই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন একদল তরুণ-যুবককে। বিভিন্ন পেশাজীবীরাও এসেছিলেন। ঈদের আগের সন্ধ্যায় কুড়িগ্রাম স্টেডিয়ামের হলরুমে সেই সভা অনুষ্ঠিত হয়। খুবই অনানুষ্ঠানিক একটি সভা। এর কোনো সভাপতি নেই। আলোচনাও অনেকটা উন্মুক্ত।
সভার প্রয়োজনে উদ্যোক্তা প্রাজ্ঞ সাংবাদিক সফি খান আমাকে সঞ্চালনার দায়িত্ব দিলেন। তাদের আড্ডার মূল বিষয় হয়ে ওঠে কুড়িগ্রামের দারিদ্র্য। বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব জেলা কুড়িগ্রাম।
কেন সবচেয়ে গরিব জেলা, গরিব জেলার কলঙ্ক থেকে উত্তরণে কী করা যায়, সরকার কেন দেশের সবচেয়ে গরিব জেলাকে আরও গরিব করে রাখতে চায় এসব নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। বিভিন্ন পেশাজীবীর মানুষদের এক অভিন্ন চাওয়া কুড়িগ্রামের দারিদ্র্য দূর হোক। তরুণরা এই আলোচনায় ছিলেন খুবই সোচ্চার।
ঈদের দুদিন পর নাজিম খান স্কুল অ্যান্ড কলেজে গিয়েছিলাম। সেখানে সোপান নামের একটি সংগঠন প্রতিবছর ঈদের সময়ই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এবং যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায় এমন শিক্ষার্থীদের নিয়ে অনুপ্রাণিতকরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকবার আমি গিয়েছি। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দেওয়ার কাজ করে এবং নবম-দশম-উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করার কাজ করার চেষ্টাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। নাজিম খান স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক আইয়ুব আলী এবং নাজিম খান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পাখি ভাই এই অনুষ্ঠান চলমান রাখার নেপথ্যে বড় শক্তি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। অনুষ্ঠানে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রক্তিম মিলনের আত্মপ্রত্যয়ী সঞ্চালনা ছিল।
গত শিক্ষাবর্ষে নাজিম খান স্কুল অ্যান্ড কলেজের ২৭ জন শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। প্রতিবছর তারা শিক্ষার্থীদের যে অনুপ্রেরণার বীজ রোপণ করে দেন এটা তারই ফল। দেশের প্রত্যন্ত এলাকার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ২৭ জন শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া একটি বিরল ঘটনা। সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীরা শুদ্ধ উচ্চজীবন প্রত্যাশী।
কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর সদর থেকেও সাত-আট কিলোমিটার দূরে হাতিয়া স্কুল। ওই স্কুল থেকে যারা এসএসসি পাস করেছেন তারা পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। স্কুলটি একবারেই ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর। চরাঞ্চলের অনেক শিক্ষার্থী এই স্কুলে লেখাপড়া করে। দুর্গম এলাকা হাতিয়া ইউনিয়নে একটি কলেজ থাকা অত্যাবশ্যক ছিল। সেই পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে নতুন-পুরাতনের স্বতঃস্ফূর্ত মিলনমেলা বসেছিল। দুর্গম চরের অনেক শিক্ষার্থী নৌকায় আবার অনেক শিক্ষার্থী চরের দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে এই স্কুলে এসে লেখাপড়া করে।
চলতি জুন মাসের ১৬ তারিখে গিয়েছিলাম রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলায় স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন এর আয়েজনে উচ্চশিক্ষা বিষয়ক একটি সেমিনারে। স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা সেখানে অংশগ্রহণ করেছিল। সেখানে আলোচনা হয় উচ্চশিক্ষা এবং উন্নত শিক্ষা নিয়ে। এই অনুষ্ঠানের আয়োজক সেখাকার কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী। সেখানে কথা হয় উচ্চশিক্ষা এবং উন্নত শিক্ষা নিয়ে। আমরা উচ্চশিক্ষা নিয়ে চিন্তিত, কিন্তু উন্নত শিক্ষা নিয়ে আমাদের কোনো ভাবনা নেই। উচ্চশিক্ষা এবং উন্নত শিক্ষার উন্নয়ন সমান্তরালে হতে হবে। নয় তো সমাজ মানবিক সমাজ হবে না।
উল্লিখিত অনুষ্ঠানগুলোর আয়োজক প্রধানত তরুণরা। তারা মেধাবীদের মেধার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ চায়। ঈর্ষাকাতর বাঙালি চরিত্রের বিরুদ্ধে তাদের জেগে ওঠা। যে শিক্ষার্থী বিশ্বদ্যিালয়ে ভর্তি হতে পারেনি সেও চায় তার প্রতিবেশী যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশকে তারা বদলে দিতে চায়। সুষম উন্নয়ন চায়। বাল্যবিয়েমুক্ত বাংলাদেশ চায়। এই তরুণরাই আগামীর বাংলাদেশ। তাদের আজকের উপলব্ধিতেই হয়ে উঠবে আগামীর বাংলাদেশ। তাদের সহমর্মিতা বোধের পথে রচিত হবে বাংলাদেশের দর্শন।
তুহিন ওয়াদুদ : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর ও পরিচালক, রিভারাইন পিপল
[email protected]