বাংলায় পাটের ঐতিহ্য
মোশারফ হোসেন মামুন
🕐 ৮:৩৫ অপরাহ্ণ, জুলাই ০২, ২০১৯
বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি অর্থাৎ বাংলার আবহমানকালের প্রাচীন সংস্কৃতির বিশেষ অংশজুড়ে রয়েছে সোনালি আঁশখ্যাত পাট। বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে মিশে আছে এর গৌরবের অধ্যায় যা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের নেই। পাটের বীজ বপনের দিন থেকে শুরু হতো কৃষকের সোনালি স্বপ্ন বোনা। যাপিত জীবনের পরিকল্পনা এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিভোর কৃষক নিরন্তর চেষ্টার মধ্যে সেসময় অভাবের তেষ্টা মেটাত। যেটি আমাদের লোকজ সংস্কৃতির ধারাবাহিক উন্নত সংস্কৃতির ব্যাপ্তিকেই প্রকাশ করিয়ে দেয়।
পাটকে ঘিরে পাটচাষী, ব্যবসায়ী, গ্রামগঞ্জ থেকে সারা দুনিয়া পর্যন্ত সবারই স্বপ্ন জড়িয়েছিল। এর সঙ্গে এখনো জড়িয়ে আছে শিল্পসাহিত্য, কবিতা, লোকজ সংস্কৃতি, সুখ-দুঃখ, সাহিত্য, নান্দনিকতা, জীবন-জীবিকার বর্ণনা। পাট আমাদের সংস্কৃতিকে ঐতিহ্যগতভাবে করেছে সমৃদ্ধ। সেই সঙ্গে সারা বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস জুগিয়েছে। গ্রাম-বাংলার কৃষক তথা চাষিরা পেয়েছেন মর্যাদার আসন। তাই তো কবি বলেছেন- ‘সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা’।
চৈত্রের খরতাপে কৃষক মাথাল দিয়ে রোদের প্রকোপ থেকে রেহাই পেত, আর নিড়ানি দিতে গিয়ে কণ্ঠে সুর তুলতো জারিসারি, ভাটিয়ালী, মুর্শিদী, লোকসংগীত। আবার কবির কবিতায় দুপুরের কবিতাখানি শোভা পায় এভাবে-
‘আমার দেশের মাঠের মাটিতে
কৃষাণ দুপুর বেলা।
ক্লান্তি নাশিতে কণ্ঠে যে তার
সুর লয়ে করে খেলা।’
পাট ক্ষেতের আইলে বসে হুকা, বিড়ি খাওয়ার মধ্য দিয়ে যে আবেগ-অনুভূতি, হাসি, তামাশা তা জীবন থেকে নেওয়া নানা গল্পের বর্ণনায় নিত্যদিনের জীবনের উপাখ্যান।
পাটের বহুমুখী ব্যবহার, ভেষজ চিকিৎসা, রসনা বিলাস, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে নিবিড় মমতায় জড়িয়ে আছে এ সমাজ। পেটের নানান অসুখ যেমন পেটে ব্যথা, মুখে অরুচি, বসন্ত রোগের মহৌষধ হিসেবে পাট আবহমান গ্রাম-বাংলায় ব্যবহৃত হচ্ছে যুগের পর যুগ। পাটের নানামুখী উপকারিতার কথা বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে মুখে রয়েছে এখনো।
পাটের তেতো খাওয়ার সংস্কৃতি গ্রামগঞ্জে এখনো বিরাজমান। চৈত্র সংক্রান্তি, পহেলা বৈশাখে পাটশাক খাওয়ার রেওয়াজ এখনো বহমান। পাটশাকের সঙ্গে কাঁসুন্দি এবং কাঁচা পেঁয়াজ-মরিচ, শুকনো মরিচ খাওয়ার অতুলনীয় স্বাদ শুধু এই বাংলাতেই দেখা যায়। পাটের নানা ধরনের আঞ্চলিক নামও রয়েছে। চট্টগ্রামে পাটশাককে ‘নারী’ শাক বলা হয়। পাট নিয়ে কবিতাও রচনা হয়েছে-
‘মনা রে মনা কোথায় যাস?
বিলের ধারে কাটব ঘাস। ঘাস কি হবে?
বেচব কাল, চিকন সুতোর কিনব জাল।
জাল কি হবে? নদীর বাঁকে
মাছ ধরব ঝাঁকে ঝাঁকে। মাছ কি হবে?
বেচব হাটে, কিনব শাড়ি পাটে পাটে।
বোনকে দিব পাটের শাড়ি, মাকে দিব রঙিন হাঁড়ি।’
কৃষিনির্ভর গ্রামবাংলার গৃহস্থালির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিত্যদিনের দড়ি-কাছি, চট, বস্তা-কার্পেট, গালিচা, পাপোশ, ঝুটন-ঝাড়ু, সুতলি, পাটের ব্যাগ, পাটের স্যুটকেস, গৃহপালিত পশু বেঁধে রাখার দড়ি ইত্যাদি। এই পাট থেকেই হতো পাটের শাড়ি। রং বেরঙের হাঁড়ি পাতিল রাখার জন্য গ্রামের মহিলারা পাট দিয়ে বুনন করত বাহারি ধরনের শিকা যা নান্দনিকতার বহিঃপ্রকাশ। একটা সময় পাটের খড়ি দিয়ে ঘরের বেড়া এমনকি ঘরের চালসহ বানানো হতো। পাটখড়ির জ্বালানির কদর এখনো আছে। আবার পাটখড়ির সঙ্গে গোবর লেপটে জ্বালানি তৈরির দৃশ্য এখনো চোখে পড়ে। আর এটি করে থাকে কৃষি এবং শিল্পের গোড়াপত্তন যাদের দিয়ে হয়েছে সেই নারী।
পাটের সঙ্গে স্বাধীনতার আন্দোলনের মূলমন্ত্র গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালি জাতির গৌরব মুক্তির ইতিহাস। কালের পরিক্রমায় দেশি-বিদেশি নানা চক্রান্তের কারণে সোনালি আঁশখ্যাত পাটশিল্প ধ্বংস হয়ে যেতে থাকে।
পাটকলগুলো বন্ধ হতে থাকে। একই সঙ্গে সোনালি স্বপ্ন বিবর্ণ হতে হতে এক সময় বিশ্ববাজার হারাতে থাকে পাট। ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে বাংলার মেহনতি কৃষক। তবে সেদিন এখন আর নেই।
পাট একটি পরিবেশবান্ধব পণ্য। পাটের তন্তুকে বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে উন্নতমানের পলিথিন তৈরি হয় যা পচনশীল, টেকসই এবং সারা বিশ্বে সমাদৃত। সারা বিশ্বে পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে পাটের নানামুখী ব্যবহারের বিকল্প নেই। পাটের ভ্যানিটি ব্যাগ, জুতা, ভিসকস, জিওজুট, পাটের পাতা থেকে পানীয়, পাট কাঠি থেকে উন্নত মানের চারকোল, পাটের বীজ থেকে উপকারী বিষ, পাটখড়ি থেকে হার্ডবোর্ড, কাগজ, ঢেউটিন তৈরি হচ্ছে যার জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলছে।
অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং বিশ্বব্যাপী চাহিদার কথা মাথায় রেখে সরকার পাট গবেষণা নিয়ে নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে চলেছে। এক্ষেত্রে নীতিগত উদ্যোগ গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বাংলাদেশের গর্ব ড. মাকসুদুল আমীন পাটের জীবনরহস্য বা জীনতত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন।
পাটের অংশ থেকে পলিমার ব্যাগ তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন মোবারক আহমদ খান, যেটি সম্পূর্ণ পচনশীল তথা পরিবেশবান্ধব। সরকারের নানামুখী উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন ২০১০, বিধিমালা ২০১৩, পাট আইন ২০১৭, ৬ মার্চকে পাট দিবস ঘোষণা ইত্যাদি। ইতোমধ্যে পাটপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টি সম্প্রসারণেও নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বর্তমান সরকার।
সোনালি স্বপ্ন পূরণের জন্য সর্বপ্রথম দরকার দেশপ্রেম। সরকারি-বেসরকারি সবার আন্তরিক প্রচেষ্টা ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত, নতুন বাজার সৃষ্টি, ভর্তুকি, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয় অন্তর্ভুক্তিকরণ, মননশীলতার অবদান রাখতে বিশেষ পুরস্কার ঘোষণা, গবেষকদের পৃষ্ঠপোষকতা, চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, উন্নতমানের বীজে প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, এর যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাটের স্বর্ণালি দিন আবার ফিরে আসবে এই বাংলায়। আমরা সে প্রতীক্ষায় বসে আছি।
মোশারফ হোসেন মামুন : শিক্ষক ও কলামিস্ট
[email protected]