ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

অনন্য এক বাঙালি খ্রিস্টান ধর্মযাজক

মিল্টন বিশ্বাস
🕐 ৯:৫৮ অপরাহ্ণ, জুন ২০, ২০১৯

রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় আজ থেকে ২০৬ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮৬ বছর আগে এই খ্রিস্টান ধর্মযাজক গির্জায় গির্জায় বাঙালিদের মধ্যে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় পবিত্র বাইবেলের বাণী প্রচারের কাজ শুরু করেন। উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। ছিলেন বাঙালি খ্রিস্টান ধর্মযাজক, লেখক, শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী এবং রাজনৈতিক নেতা।

বহুভাষাবিদ এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বিদ্যায় পারঙ্গম পণ্ডিত কৃষ্ণমোহন উইলিয়াম কেরির পর একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক হিসেবে পবিত্র বাইবেল বাংলায় অনুবাদ এবং খ্রিস্টধর্ম বিষয়ক বেশ কিছু পুস্তিকা রচনা করেন। বাংলা ভাষায় শিক্ষা প্রসার ও বাংলা ভাষার উন্নয়নে তিনি খুবই সচেতন ছিলেন। তিনি প্রথম বাঙালি যিনি বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ‘বিশ্বকোষ’ সম্পাদনা করে ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে পথিকৃৎ হয়েছেন।

তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি মিশনারি আলেকজান্ডার ডাফের কাছে দীক্ষা নিয়েও সাদা-কালোর বা বর্ণবাদের অবিচারে সরাসরি সোচ্চার হয়েছিলেন। প্রতিবাদ করে কখনোই পিছু হটেননি। মিশনারি ডাফের স্কটিশ চার্চ কলেজের সামনেই তিনি তার বাংলা মিশন ‘ক্রাইস্ট চার্চ’ স্থাপন করেন। তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি প্রখ্যাত বিশপস কলেজে ১৮৫২-১৮৬৮ সাল পর্যন্ত একটানা ষোলো বছর অধ্যাপনা করেন। এই কলেজে ১৮৩৬-১৮৩৯ সাল পর্যন্ত তিনি থিয়োলজি বা খ্রিস্ট ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে অধ্যয়ন করেছিলেন। তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি দশটি ভাষা জানতেন-বাংলা, সংস্কৃত, হিন্দি, ওড়িয়া, ফারসি, উর্দু, ইংরেজি, ল্যাটিন, গ্রিক ও হিব্রু। এদিক থেকে তিনি উইলিয়াম কেরির চেয়েও অগ্রগামী ছিলেন।

তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি বাংলা, সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষায় গবেষণামূলক গ্রন্থ লিখে গেছেন। সেই সঙ্গে একাধিক পত্র-পত্রিকা, কী সরকারি, কী বেসরকারি, একই সঙ্গে সম্পাদনা করেছেন। তিনিই প্রথম বাঙালি খ্রিস্টান যিনি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে খ্রিস্টান ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে তীব্র লড়াই করেছেন। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় স্বাজাত্যবোধ ও স্বদেশ প্রেমের ব্রতে জীবন উৎসর্গ করেন। ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে তার বাংলা ভাষার গ্রন্থ ‘উপদেশক কথা’য় বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের পথ দেখিয়েছিল।

২.
পশ্চিবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ‘নবগ্রাম’ ছিল রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮১৩-১৮৮৫) পিতৃভূমি। তবে উত্তর কলকাতার বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিটে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে ২৪ মে মামার বাড়িতে তার জন্ম। বাবা জীবনকৃষ্ণ, মা শ্রীমতী দেবী। এই দম্পতির কৃষ্ণমোহন ব্যতীত আরও দুটি পুত্র ও একটি কন্যা ছিল। তাদের মধ্যে ভুবনমোহন ছিলেন সর্বজ্যেষ্ঠ এবং কালীমোহন কনিষ্ঠপুত্র। পরবর্তীকালে কৃষ্ণমোহনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কালীমোহনও খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নেন। পিতা কর্মহীন থাকায় নিদারুণ অভাবের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয় কৃষ্ণমোহনের শৈশব-কৈশোর। তার মা চরকায় সুতো কেটে, বেতের দড়ি পাকিয়ে সংসারের অভাব মেটানোর চেষ্টা করতেন। স্কুল-কলেজের ছাত্র থাকাকালে কৃষ্ণমোহনকে একবেলা ঘরের রান্নাবান্নার কাজ করতে হতো; যাতে তার মা ওই সময়টুকু সুতো কেটে বা অন্য কোনো কাজ করে উপার্জনের উদ্দেশ্যে ব্যস্ত থাকতে পারেন।

দরিদ্র হয়েও মেধাবী কৃষ্ণমোহন স্কুল ও কলেজের গণ্ডি পার হন ডেভিড হেয়ারের সহায়তায়। ১৮১৯ সালে তিনি কালীতলায় ডেভিড হেয়ার (১৭৭৫-১৮৪২) প্রতিষ্ঠিত স্কুল সোসাইটি ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। অল্পদিনের মধ্যে তার প্রতিভার পরিচয় পেয়ে ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে হেয়ার তাকে নবনির্মিত হেয়ার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। এরপর ১৮২৪ সালে তিনি স্কুল সোসাইটির অবৈতনিক ছাত্ররূপে ‘হিন্দু কলেজে’ ভর্তি হন। ডিরোজিও হিন্দু কলেজে ১৮২৬ সালে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলে অন্য ছাত্রদের মতো কৃষ্ণমোহনও তার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং নব্যবঙ্গ দলের অগ্রগণ্য সদস্য হয়ে ওঠেন। পরবর্তীকালে ‘একাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি তার যুবক সভ্যদের নেতৃত্ব দিতে থাকেন।

৩.
হিন্দু যুবসমাজ তথা ছাত্রদের বিভ্রান্ত করছেন এই অভিযোগে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ এপ্রিল ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাসের শিক্ষক ডিরোজিও ‘হিন্দু কলেজ’ ছাড়তে বাধ্য হন। হিন্দু কলেজে ডিরোজিও-র কর্মকাল ছিল ১৮২৬ থেকে ১৮৩১ সাল পর্যন্ত। কৃষ্ণমোহন তার শিক্ষকের চাকরিচ্যুতিতে হতাশ হলেও দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। একই বছর মে মাসে তিনি প্রকাশ করেন ‘এনকোয়েরার’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। হিন্দু সমাজের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এই সাপ্তাহিক পত্রিকাটি জোরালো সামাজিক যুদ্ধ শুরু করে। তখনো তিনি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেননি। অবশ্য তিনি কখনই কলকাতার ধনী জনগোষ্ঠীর সুনজরে ছিলেন না। তবে তার বাড়িতে ডিরোজিওর শিষ্যদের আড্ডা ছিল।

১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে ২৩ আগস্ট কৃষ্ণমোহনের অনুপস্থিতিতে তার ঘরে কয়েকজন বন্ধু মিলিত হয়ে প্রতিবেশী ব্রাহ্মণের বাড়িতে গরুর হাড় নিক্ষেপ করেন। এর ফল হয় সাংঘাতিক। এই ঘটনায় সারা কলকাতার হিন্দুসমাজে প্রবল উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি প্রায়শ্চিত্ত না করায় ঘর ছাড়তে বাধ্য হন। ১৮৩১ সালের ২৫ এপ্রিল তার শিক্ষক ডিরোজিওর হিন্দু কলেজ থেকে চাকরিচ্যুতি আর ২৩ আগস্ট গৃহ থেকে কৃষ্ণমোহনের বিতাড়ন-তৎকালীন কলকাতার সমাজে আলোড়ন সৃষ্টিকারী দুটি ঘটনা। তখন কোনো হিন্দুপল্লীতেও মেধাবী কৃষ্ণমোহনের আশ্রয় মেলেনি।

শেষ পর্যন্ত চৌরঙ্গী অঞ্চলে এক ইংরেজের ঘরে থাকার জায়গা পান। কিন্তু হিন্দুসমাজের এই মানসিক নির্যাতনে একদম ভেঙে পড়েননি তিনি। আজকের বাংলাদেশে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে আমরা এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে পারি।

কৃষ্ণমোহন নতুন উদ্যমে সমাজের কুসংস্কার ভাঙার ব্রত নিয়ে নভেম্বর মাসে লিখে ফেলেন ইংরেজি ভাষায় একটি নাটক। ‘দ্যা পার্সিকিউটেড’ নাটকটি ছিল আধুনিক বাঙালির লেখা প্রথম নাটক। যা বিদেশির বাড়িতে বসে এক স্বদেশি নাট্যকার লিখেছেন। নারী চরিত্র বর্জিত নাটকটি প্রতিবাদী নাটক যা মাইলস্টোন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, নাটকটি বাংলায় লিখিত হলে বাংলা সাহিত্যে প্রথম নাটক রচয়িতা হিসেবে কীর্তিত হতেন তিনি।

সামাজিক সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে তার বুদ্ধিবৃত্তিক সৃজনশীলতা ছিল অসাধারণ। তখনো তার বয়স ২০ বছর হয়নি। অথচ কৃষ্ণমোহনের মধ্যে ওই বয়সেই দেখা গিয়েছিল এক প্রতিবাদী বিদ্রোহী সত্তা। তার ধর্ম-আন্দোলন ও সমাজ-সংস্কারমূলক আন্দোলন পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক-আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়।

৪.
খ্রিস্টান হওয়ার পর কৃষ্ণমোহন হেয়ারের স্কুলের চাকরি থেকে বিতাড়িত হন এবং চার্চ মিশনারি সোসাইটি স্কুলে শিক্ষকতা গ্রহণ করেন। শিক্ষাব্রতী কিন্তু নাস্তিক ডেভিড হেয়ার ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের প্রতি চরম বিরূপ ছিলেন। ফলে শুরু হয় কৃষ্ণমোহনের জীবনের নতুন অধ্যায়। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে তার কিশোরী স্ত্রী বিন্দুবাসিনীকে তিনি নিজে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেন। এর পর তিনি মিশনারি ডাফের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তিনি তার কাছে দীক্ষিত হলেও সাদা চামড়ার মানুষের দ্বারা ভারতীয় বাঙালিদের প্রতি অবিচারের বিরুদ্ধে সম্মুখ সংঘাতে সরব হয়েছিলেন। অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে মিশনারি ডাফের স্কটিশ চার্চ কলেজের একেবারে সামনেই তার বাংলা মিশন ‘ক্রাইস্ট চার্চ’ (১৮৩৯) স্থাপন করেন। কৃষ্ণমোহনের মধ্যে ছিল প্রবল স্বাজাত্যবোধ। দেশ ও জাতির শ্রেষ্ঠত্বে তিনি নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করতেন। সত্যসন্ধানী কৃষ্ণমোহন স্কটল্যান্ড মিশন ছেড়ে চার্চ অফ ইংল্যান্ডের মিশনে যোগ দেন। ‘ক্রাইস্ট চার্চ’-এর তিনি হন প্রথম বাঙালি ধর্মযাজক। ১৮৩৯ থেকে ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ১৩ বছর ধর্মযাজক হিসেবে কাজ করেন। প্রতি রোববার বাংলা ভাষায় উপদেশ দিতেন, যা ছিল সেই সময়ের চার্চের আন্দোলনে এক বিপ্লবী পদক্ষেপ।

১৮৪৩ সালে কৃষ্ণমোহনের কাছেই মাইকেল মধুসূদন দত্ত খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন। আগেই লিখেছি, নিজ স্ত্রীর পর কৃষ্ণমোহন ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে নিজের কনিষ্ঠভ্রাতা কালীমোহনকেও খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেন। এর পর প্রসন্নকুমার ঠাকুরের একমাত্র পুত্র জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন এবং কৃষ্ণমোহনের কন্যা কমলমণিকে বিবাহ করেন। জ্ঞানেন্দ্রমোহন বঙ্গদেশের প্রথম ব্যারিস্টার ছিলেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের খ্রিস্টান হওয়ার ব্যাপারে তার ভূমিকা ছিল। এ ছাড়া ব্রজনাথ ঘোষ নামে একটি বালকও কৃষ্ণমোহনের দ্বারা ধর্মান্তরিত হয়।

কৃষ্ণমোহন প্রথম বাঙালি যিনি বিখ্যাত ‘বিশপস কলেজে’ একটানা ষোলো বছর (১৯৫২-১৮৬৮) অধ্যাপনা করে ইউরোপে সাড়া জাগিয়েছিলেন। আর এখানেই মহাকবি মাইকেল মধুসূদনের ভাষা শিক্ষা তার হাত ধরেই হয়েছিল। প্রবল স্বাজাত্যসংগ্রামী কৃষ্ণমোহনের মধ্যে ছিল গভীর দেশপ্রেম। তিনি ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। ভারতীয় খ্রিস্টান সমাজের বর্ণভেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। এমনকি সাদা ও কালোর বেতনের মধ্যে পার্থক্য অবসানের জন্য কলকাতার বিশপের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিশপস কলেজ থেকে অধ্যাপনার অবসর নিয়ে আমৃত্যু জাতীয় আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন।

শিক্ষানুরাগী এই রেভারেন্ড ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি ও নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এমনকি ১৮৬৭-৬৮ খ্রিস্টাব্দে পরপর দুবার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস ফ্যাকাল্টির ডিন নিযুক্ত হন। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানে মূল্যবান ও গবেষণামূলক প্রবন্ধ পাঠ করেন। সেই সঙ্গে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার নিয়মিত লেখালেখি করতে থাকেন। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে ৪ জুলাই রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ইংল্যান্ডের রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য নির্বাচিত হন। তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি মহাকবি কালিদাসের সংস্কৃত গ্রন্থগুলোকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছিলেন। তিনিই প্রথম বাঙালি খ্রিস্টান যিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বোডেন প্রফেসার’ পদের জন্য নির্বাচিত হয়ে ভারতীয়দের মর্যাদা বাড়িয়েছিলেন।

৫.
কৃষ্ণমোহন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাদান, জ্ঞানীয় ও বৌদ্ধিক উন্নয়ন, লেখালেখির মাধ্যমে কুসংস্কার দূরীকরণ, সাংগঠনিক কার্যক্রম ও স্থানীয় শাসনে অংশগ্রহণ করেছেন সক্রিয়ভাবে। তিনি জ্যামিতি ও ভূগোলে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তার প্রচেষ্টায় বাঙালি জনগোষ্ঠীর মানসে আকর্ষণীয় শৈলী হিসেবে ইউরোপীয় বিজ্ঞান ও ইতিহাসের উপস্থাপন করা হয়। ধর্মযাজক হয়েও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করা যায়- এই দৃষ্টান্ত তিনিই প্রথম বাঙালি খ্রিস্টানদের দেখিয়ে গেছেন। তার ধর্মীয় গ্রন্থ ‘উপদেশ কথা’ ১৮৪০ সালে প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি ১২টি উপদেশের মধ্যে বাইবেলের পুরনো নিয়মের দশআজ্ঞার বিশ্লেষণ আছে। প্রত্যেকটি উপদেশের বাস্তবসম্মত উদাহরণও দিয়েছেন। অন্যদিকে ১৮৮১ সালে ‘দ্য রিলেশন বিটউইন ক্রিশ্চিয়ানিটি অ্যান্ড হিন্দুইজম’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন। এটি তার তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের গবেষণামূলক গ্রন্থ।

তিনি প্রথম বাঙালি যিনি বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বিশ্বকোষ ১৩ খণ্ডে সম্পাদনা করে ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে পথিকৃৎ হয়ে আছেন। ধর্মযাজকত্বের কাজে ব্যস্ত থেকেও ১৮৪৬ থেকে ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ৬ বছর ধরে খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশ করেন। বাংলা ভাষায় শুধু নয় সমগ্র এশীয় ভাষায় রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহনের ‘বিশ্বকোষ’ ছিল অভিনব ও বিরল।

৬.
রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৮৫ সালে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ছিলেন বাঙালি সমাজের মঙ্গল চিন্তায় নিবেদিত। তবু এই বাঙালি খ্রিস্টান ধর্মযাজক ও মনীষী বাংলাদেশে উপেক্ষিত। অথচ বাঙালির জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে তার অবদান বিজড়িত। উনিশ শতকের বরেণ্য এই মনীষীর অবদান স্মরণের মধ্য দিয়ে বাঙালি খ্রিস্টানম-লী নিজেকে দেখার সুযোগ পাবে। মনে রাখতে হবে বাঙালি সংস্কৃতিতে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন এক ভিন্ন মাত্রা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার নামে প্রতিষ্ঠানের নামকরণ কিংবা স্মারক বক্তৃতার প্রচলন অবশ্যই আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। আমি মনে করি বাঙালি খ্রিস্টানদের অবদানকে স্বীকার করেই আমাদের সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে অন্ধের মতো অনুসরণ করেছিলেন তিনি কিন্তু নিজের বাঙালিত্বকে বিসর্জন দিয়ে নয়। তার নিখাদ স্বদেশপ্রেম ও কুসংস্কারবিরোধী মনোভাব ভারতীয় সমাজকে পরিশুদ্ধ করেছিল।

মিল্টন বিশ্বস : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা
দফতর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

 
Electronic Paper