ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ভাই-বোন, দাদা-দিদি বনাম স্যার-ম্যাডাম

সাজ্জাদ কাদির
🕐 ৯:৩০ অপরাহ্ণ, জুন ১০, ২০১৯

গত ১২ মে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের সহকারী কমিশনার (ভূমি) সঞ্চিতা কর্মকারকে ‘দিদি’ ডাকায় তিনি ক্ষেপে গিয়ে মাছ ব্যবসায়ীর মাছের ঝুড়িতে লাথি মেরে ড্রেনে ফেলে দেন। এসিল্যান্ডের এমন কাণ্ডে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইতে থাকে। পরে অবশ্য বিষয়টি অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনক স্বীকার করে সঞ্চিতা কর্মকার সংশ্লিষ্ট মাছ ব্যবসায়ীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। ক্ষমা মহৎ গুণ। আমরা দেশবাসীও তাকে ক্ষমা করে দিতে চাই।

এ নিয়ে আর উচ্চবাচ্যও করতে চাই না। ৩৩তম বিসিএসে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৪ সালে চাকরিতে যোগদান করা প্রশাসনের অপেক্ষাকৃত নবীন কর্মকর্তা একজন সঞ্চিতা কর্মকার ভুল করেছেন এবং ভুল শুধরেও নিয়েছেন। তার ভুল শুধরালো কিন্তু সরকারি অফিসে এহেন ঘটনা যে অহরহ ঘটে চলেছে তার খবর কী আমরা রাখি? একটি ঘটনা পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছে কিন্তু কতশত ঘটনা অন্ধকারে রয়ে গেছে সে খবর আমরা কেউ রাখি না। ভুক্তভোগী মাত্রই কেবল জানেন।

এর ঠিক সপ্তাহখানেক পর সুনামগঞ্জের উন্নয়ন কর্মী সালেহীন চৌধুরী সুনামগঞ্জ কালেক্টরেটে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাধারণ মানুষ বা নাগরিকরা কী বলে ডাকবেন তা জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেছেন। একটি সম্বোধন যে আমাদের দেশের সরকারি অফিসে কত বড় ফ্যাক্টর এ দুটি ঘটনাই তার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। সরকারি দফতরগুলোতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্বোধন নিয়ে এ দেশের নাগরিকরা প্রতিনিয়ত দুর্ব্যবহারের শিকার হন। তাদের শুধু স্যার-ম্যাডাম না ডাকার কারণে কত মানুষের যে সেবা পেতে বেগ পেতে হয় তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন।

স্যার বলুন আর ম্যাডাম বলুন-এ যে এক আমদানি করা উপনিবেশিক মনোভাব তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আপনি একজন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। প্রজার জন্য বা প্রজার সেবা করার জন্যই আপনার চাকরি। আপনি সেই প্রজার কাছে বিশেষ ডাক না শুনলে দুর্ব্যবহার করবেন; ঠিক মতো সেবা দেবেন না এটি হতে পারে না। অথচ এটিই হয়ে চলেছে এই বাংলায়। সঞ্চিতা কর্মকার প্রশাসনের একজন নবীন কর্মকর্তা তাতেই তার এই ঝাঁজ কিন্তু যারা অপেক্ষাকৃত একটু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা তাদের যদি একজন সাধারণ মানুষ স্যার না ডাকে তাহলে কী অবস্থা হয় একবার ভাবুন।

ভাইরে বহু ত্যাগ আর সাধনার ফসল আজকের বাংলাদেশ। এই দেশে আপনি আমি সবাই কোনো না কোনোভাবে শ্রম আর ঘামে রক্ত পানি করে আজকে সাহেব হয়েছি; স্যার-ম্যাডাম হয়েছি। আপনার, আমার, আমাদের শতভাগ মানুষের পূর্বপুরুষ কৃষক, মুটে, মজুর, জেলে ছিল। প্রত্যেকে কোথা থেকে এসেছেন যদি একটু হিসাব করে দেখেন দেখবেন আপনার দুই, তিন বা চার পুরুষ আগে কেউ না কেউ সেই কৃষিজীবী আর শ্রমজীবী মানুষের কাতারে ছিল। পার্থক্য শুধু এটুকুই হয়তো কেউ একটু অবস্থাপন্ন কৃষক, কেউ গরিব কৃষক আবার কেউ অন্যের জমিতে কাজ করা কৃষি শ্রমিক। সেখান থেকেই আজকে আপনি স্যার-ম্যাডাম হয়েছেন। এই স্যার-ম্যাডাম হয়ে আজকে নিজের শিকড়টাকে ভুলতে বসেছেন। আমদানি করেছেন ব্রিটিশ উপনিবেশিক মনোভাব। দিদি ডাকায় লাথি মারেন জেলের মাছের ঝুড়িতে। এই লাথি কোথায় গিয়ে পড়ে একবার ভেবে দেখেছেন? আপনার পূর্বপুরুষের অস্তিত্বকেই আপনি লাথি মেরেছেন।

আমরা কে? কোথা থেকে এসেছি? এই মাটির এক শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। আর এজন্যই তিনি সবার মুজিব ভাই ছিলেন; মুজিব স্যার নন। আজকের বাংলাদেশেও তারই রক্তের সুযোগ্য উত্তরসূরি; তার আদর্শে গড়া বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাও কিন্তু সবার আপা; ম্যাডাম নন। বেশ কিছুদিন আগে ইউটিউবে দেখা এবং শোনা বঙ্গবন্ধুর একটি ভাষণ আমাকে দারুণ ভাবায়। পরে জেনেছি ভাষণটি ছিল ১৯৭৫ সালে জয়দেবপুরে শ্রমিক সমাবেশে সরকারি চাকরিজীবীদের উদ্দেশে দেওয়া।

ওই ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি চাকুরি করেন আপনার মাইনে দেয় ওই গরিব কৃষক, আপনার মাইনে দেয় ওই গরিব শ্রমিক, আপনার সংসার চলে ওই টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলেন, ওদের ইজ্জত করে কথা বলেন। এই বেটা কোথা থেকে আসলি? সরকারি কর্মচারীদের বলব, মনে রেখ এটা স্বাধীন দেশ, এ ব্রিটিশ কলোনি নয়, পাকিস্তানি কলোনি নয়। যে লোকরে দেখবা তার চেহারা তোমার বাবার মতো, তোমার ভাইয়ের মতো। ওরাই সবচেয়ে সম্মান বেশি পাবে। কারণ ওরা নিজে কামাই করে খায়।’
ভাষণে তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘আমাদের লেখাপড়া করায় কে? ডাক্তারি পাস করায় কে? আমাদের ইঞ্জিনিয়ার করায় কে? আমাদের সায়েন্স পান করায় কে? আমাদের বৈজ্ঞানিক করে কে? আমাদের অফিসার করে কে? কার টাকায়?’ উত্তরে তিনিই বলেন, ‘বাংলার দুঃখী জনগণের টাকায়।’ মাটির রাজনীতি করা; মাটিঘেঁষা মানুষ বঙ্গবন্ধুর কী অসাধারণ এক উপলব্ধি। তিনি সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের সরকারি কর্মচারীদের উপনিবেশিক আচরণ তখনই টের পেয়েছিলেন। আর তাই তার কণ্ঠে এই বলিষ্ঠ হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন।

আজকের বেশির ভাগ সরকারি কর্মচারী বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ শুনেছেন বলে মনে হয় না। কেউ কেউ শুনলেও ধারণ করার মতো ক্ষমতা তাদের নেই। বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ বর্তমানে সুদিন পার করছে। আর আওয়ামী লীগের পালে হাওয়া দিয়ে এই কর্মচারীরা নানা সুযোগ-সুবিধা নিতে ব্যস্ত। কিন্তু জনগণ সেবা কতটুকু পাচ্ছে তা আমরা দেখতেই পাচ্ছি। আমি যদি উপজেলা পর্যায় থেকেই বিষয়টি দেখি তাহলে দেখতে পাব উপজেলার প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা নির্বাহী অফিসার। এই নির্বাহী অফিসাররা কতটা গণমুখী ভূমিকা পালন করেন সেটি ভুক্তভোগী সেবাগ্রহীতারা হাড়ে হাড়ে টের পান। আর ইউএনও সাহেবকে স্যার না ডাকলে কতটা বিরাগভাজন হতে হয় সেটি সাধারণ মানুষ ভালোই জানেন।

কিছু ব্যতিক্রম যে নেই তা কিন্তু নয়। এই খারাপের ভিড়ে অনেক ভালো কর্মকর্তার উদহারণও আমাদের সামনে আছে। এবার আসি জেলা পর্যায়ে। জেলার প্রধান কর্তা ব্যক্তিটি জেলা প্রশাসক। প্রশাসনের মধ্যম শ্রেণির কর্মচারী জেলা প্রশাসকদের আচার-আচরণ দেখলে মনে হবে যেন এক একটি অঞ্চলের তালুকদার বা জমিদার বাহাদুর তারা। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তারা কতটা সম্পৃক্ত থেকে কাজ করেন তারাই ভালো বলতে পারবেন। আপাতদৃষ্টিতে যা দেখা যায় তা হচ্ছে সাধারণ মানুষ আর ডিসির সঙ্গে এক বিশাল দেয়াল যেন চেপে বসে আছে। আর স্যার সম্বোধন তো কমন ব্যাপার। স্যার না ডেকে রক্ষা নেই।

ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলের ভিনদেশি অফিসাররা যেভাবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন আজ এখনো সেই ধারা অব্যাহত আছে। ভিনদেশি অফিসাররা ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে আসার কারণে তাদের সঙ্গে একটি গ্যাপ থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ এমনকি তাদের সঙ্গে আমাদের চেহারায়ও কোনো মিল ছিল না। তারা এসেছিল আমাদের সেবা দিতে নয়; শুধুই শাসন করতে। সেই শাসনে অতিষ্ঠ হয়েই তো পরিবর্তনের পর পরিবর্তন প্রয়োজন হয়েছে। ব্রিটিশ ভারত, পাকিস্তানি কলোনি শেষে আজকের বাংলাদেশ। এত পরিবর্তন করে আমাদের কী এই প্রাপ্য ছিল? এখন তাহলে কী সাধারণ মানুষকে আবারও পরিবর্তনের ডাক দিতে হবে?

অবস্থাদৃষ্টে যেন তাই মনে হয়। পরিবর্তন চাই আবারও। তবে এবারের পরিবর্তন দেশ বা ভূখণ্ডের নয়। আপনার-আচরণের পরিবর্তন চাই। সময় থাকতে পরিবর্তন হোন। নইলে সাধারণ মানুষ কিন্তু ক্ষমা করবে না। আরে ভাই আজকের আপনি তো এই মাটিরই কাদা, মাটি, জলে বেড়ে ওঠা একজন মানুষ। আর এই মাটির সন্তানদের সঙ্গেই আপনি অসম্মানজনক আচরণ করবেন এটা কেমন কথা? বঙ্গবন্ধুর ভাষায় বলতে হয়, মুরব্বিদের দেখলে আপনারই বাপ-চাচাদের মতো লাগে। আর আপনার বয়সীদের চেহারা তো আপনার ভাইয়ের মতো। এই তাদের কাছে স্যার সম্বোধন প্রত্যাশা করেন কীভাবে?

প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে সাধারণ জনগণের প্রবেশ নেই বললেই চলে। যারা প্রবেশ করেন তারা খানিকটা অগ্রগামীই বলা চলে। সেখানকার বেশির ভাগ শীর্ষ সরকারি কর্মচারীর আচরণ তো আরও ভয়াবহ। তা নাইবা বললাম। এই অগ্রগামীদের জন্যও স্যার ডাকাটা এক প্রকার বাধ্যতামূলক। স্যার না ডাকলে আপনার কাজে নানা জটিলতা তৈরি হবে। এজন্য মানুষ প্রচণ্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্যার ডাকতে বাধ্য হন। এত কিছুর পরেও কিছু যে এই মাটির সংস্কৃতির কর্মচারী নেই তা বলব না। সীমিতসংখ্যক যারা আছেন তাদের ব্যবহারে আপনি মুগ্ধ হয়ে ফিরে আসবেন। অত্যন্ত অমায়িক ভদ্র কর্মচারীও আছেন। তারা দেশের জন্য বিরাট অবদানও রেখে চলেছেন। সেই সমস্ত ভদ্র কর্মচারীর প্রতি শ্রদ্ধা এবং সম্মান জানাই।

সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে যারা মানুষের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করেন তাদের বলতে চাই ১৯৭৫ সালে জয়দেবপুরে শ্রমিক সমাবেশে সরকারি চাকরিজীবীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণটি দিয়েছিলেন সেটি বারবার শুনুন এবং উপলব্ধি করুন দেখবেন আপনার মধ্যে ব্রিটিশ উপনিবেশিক কর্মচারীর আচরণ এবং মনোভাব কোনোটাই আসবে না। আপনাকে মনে হবে আপনি আমার ভাই-বোন কিংবা দাদা-দিদি।

সাজ্জাদ কাদির : লেখক, কলামিস্ট, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ও তথ্যচিত্র নির্মাতা।
[email protected]

 

 
Electronic Paper