ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ভেজালের লাগাম টেনে ধরুন

আশেক মাহমুদ
🕐 ১০:১৬ অপরাহ্ণ, জুন ০৭, ২০১৯

সারা দেশে ভেজালের সয়লাব দেখে মনে হচ্ছে ‘নির্ভেজাল’ শব্দটা বাংলা ডিকশনারি থেকে বাদ পড়ে কিনা। ভেজালের তো একটা সীমা পরিসীমা থাকবে। সব সীমা অতিক্রম করে ভেজাল এখন এতটাই দুর্দমনীয় যে, ভেজাল ছাড়া মানুষ আর কোনো গতি দেখছে না। ভেজালের এই দুঃশাসন যে এ জাতির মজ্জাগত তা তারুণ্যের কবি সুকান্তের ‘ভেজাল’ কবিতা থেকে বোঝা যায়। সুকান্ত লিখেছেন, ‘ভেজাল, ভেজাল, ভেজাল রে ভাই, ভেজাল সারা দেশটায়/ ভেজালছাড়া খাঁটি জিনিষ মিলবে নাকো চেষ্টায়।’

এ কালে দেখি ভেজালের রাজত্ব আরও দুর্দান্ত প্রতাপে এগিয়ে চলছে, যার প্রতাপে ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই চরমভাবে অসহায়। সবার একটাই প্রশ্ন, কিসে ভেজাল নেই? রেস্তোরাঁগুলো যেন আধুনিক ভেজাল রেস্তোরাঁ। সরেজমিন টিভি চ্যানেলগুলো প্রচার করছে, কীভাবে খাবারের হোটেলগুলো আমাদের কাছে পরিবেশন করছে ভেজাল আর অস্বাস্থ্যকর খাবার। এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, রাজধানীতে প্রতিদিন হাজার হাজার মরা মুরগির প্রায় ৮০% চলে যায় খাবার হোটেলগুলোতে। অনুসন্ধান করে দেখা গেছে এ পর্যন্ত কোনো ডাস্টবিনে কোনো মরা মুরগি পাওয়া যায়নি।

কিছুদিন আগে তেজগাঁও হিমাগারে পাওয়া যায় শত শত টন পচা গরুর মাংস। অথচ আমরা আধুনিক ভোক্তা হয়ে রেস্তোরাঁ থেকে মজা করে খাচ্ছি গ্রিল, রোস্ট, রেজালা, বিফ। আমরা কি জানি ডাস্টবিনের উপযোগী মরা মুরগি আর পচা মাংস খেয়ে আমাদের পাকস্থলীকে ডাস্টবিন বানিয়ে ফেলেছি।

যারা নিজেদের আধুনিক ভোক্তারূপে পণ্য কিনছে স্বপ্ন, আগোরা, মীনাবাজার থেকে, তাদের কয়জন জানে যে, তারা সেখান থেকে কিনছে পচা মাংস, ফরমালিনের মাছ, বিষাক্ত মেলামিন মেশানো দুধ। যে ফরমালিন আবিষ্কার হয়েছে মৃত মানুষের দেহকে ডিকম্পোজড বা সংরক্ষণ করার জন্য, আমরা সেই ফরমালিন মেশানো মাছ, মাংস, দুধ খেয়ে চলছি, আর ধীরে ধীরে চলছি মৃত্যুর দিকে। ভেজালের দাপট আজ এত বীভৎস হয়েছে যে, কাওরান বাজারের পচা কুমড়া, টমেটোর সঙ্গে কাপড়ের বা কাঠের রং মিশিয়ে খাবারের সস বানানো হচ্ছে।

আমরা নিজেদের যে মাছে-ভাতে বাঙালি বলি, সেই মাছে-ভাতে ভেজাল এখন নিত্যদিনের খাবার হয়ে গেছে। শিশুদের গুঁড়ো দুধে মেশানো মাত্রাধিক মেলামিন শিশুদের বলে দিচ্ছে জন্ম তাদের আজন্ম পাপ। বাজারের এমন কোনো ফল নেই যাতে ফরমালিনসহ বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে না। সব খাবারই যখন ভেজাল তখন তো মানুষের রোগব্যাধি বাড়বে বৈ কমবে না। এর মানে খাদ্যে ভেজাল এক মানব বিধ্বংসী ব্যবসা যা ভোক্তাদের চিররোগী বানাচ্ছে। এই চির রোগীরাই হলো বেসরকারি হাসপাতালের মালিক শ্রেণির মুনাফা লাভের কেন্দ্রস্থল। ভেজাল খাবার গ্রহণের মাত্রা যত বাড়বে হাসপাতালে ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, গ্যাস্ট্রিক, আলসার, কিডনিসহ বহুবিধ রোগীর ভিড় বাড়তে থাকবে। বাড়তে থাকবে মেডিসিনের চাহিদা। সেই মেডিসিনের ব্যবসা জমজমাট করতে মেডিসিন কোম্পানিগুলো মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

দুর্ভাগ্যের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, মেডিসিনের মধ্যেও মাত্রাতিরিক্ত ভেজাল চলছে! এত ভেজাল যে, মেডিসিনেও এখন অসুখ সারতে চায় না। মেডিসিন এখন নিজেই রোগ সৃষ্টির কারণ হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর জানিয়েছে, দেশের ৯৩ ভাগ ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ পাওয়া গেছে। আরও অবাক ব্যাপার হলো, ডাক্তাররা তাদের ব্যবসা পাকাপোক্ত করার জন্য রোগীদের উচ্চমানের এন্টিবায়োটিক দিচ্ছে, যার ফলে রোগীরা চিররোগী হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। মূলত ভেজাল খাবারে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আর ভেজাল চিকিৎসায় আমাদের এই মাতৃভূমি এত কদর্য হয়ে যাবে এ কথা এভাবে কেউ না ভাবলেও ভেজালের দৌরাত্ম্য দুর্দান্ত গতিতে চলছে।

কেন ভেজালের এই দুর্দান্ত গতি? কেন ভেজাল এত লাগামছাড়া? এক সময় মানুষ ভেবেছিল বিজ্ঞানের জয়জয়কার অগ্রগতি উজ্জ্বল এক মানবসমাজ বিনির্মাণ করবে। সে কারণে ফ্রান্সিস বেকন বিজ্ঞানের মধ্য দিয়ে এক মানবিক সমাজের প্রত্যাশা করেছিলেন। বিজ্ঞানবাদীরা বিজ্ঞানের মোহে আবিষ্ট হয়ে নৈতিকতার স্বতন্ত্র প্রয়োজন বুঝতে পারেনি। বেকন কি কখনো ভেবেছিলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যখন নগ্ন মুনাফার হাতিয়ার হয়ে পড়বে তখন সেই উন্নত বিজ্ঞানই মানবসমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে। বিষয়টি বুঝতে পেরে উলরিচ বেক ‘Risk Society’ নামে বইয়ে উল্লেখ করেন, কী প্রাচ্য কী পাশ্চাত্য- সারা দুনিয়া এখন ঝুঁকির মধ্যে বাস করছে। দার্শনিক ও ফিজিওলোজিস্ট এলেক্সিস ক্যারেল বলেন, আধুনিক মেডিসিন আমাদের এক দুর্বল প্রজাতি উপহার দিয়ে চলছে। এর মানে নীতি নৈতিকতার অবক্ষয়টা এত প্রবল যে, মানুষ বিজ্ঞানের অপব্যবহার করে সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

আমাদের দেশে এ পরিস্থিতি এত নির্মম যে, নগ্ন মুনাফাখোররা ব্যবসার নামে যা ইচ্ছে তা করে যাচ্ছে। আমাদের প্রশাসন কাঠামো ও আইন কাঠামো এত দুর্বল যে, আমরা জনতার অধিকারের চাইতে মুনাফাখোরদের ছাড় দেওয়াকে কর্তব্য মনে করি। জনতার টাকায় যে ম্যাজিস্ট্রেট বেতন পান, সেই ম্যাজিস্ট্রেট বড় অঙ্কের ঘুষ পেলে সব পাপ চাপা পড়ে যায়। পুলিশ কিছু বখরা পেলে আইন দরজা জানালা দিয়ে পালায়। নামকাওয়াস্তে কিছু জরিমানা করলেও সেই জরিমানা পোষাতে ভেজাল আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়।

এর সুরাহা না করলে পুরো জাতিরই মৃত্যু ঘটবে। আর তাই প্রশাসন ও আইন কাঠামোকে এমনভাবে দাঁড় করাতে হবে যেন ভেজালের মাত্রানুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি হয় মৃত্যুদণ্ড কিন্তু আইনের প্রয়োগধারীরা যদি নীতিকে ঘুষের কাছে বিসর্জন দেয় তাহলে আইন কঙ্কাল হয়ে পড়ে। প্রশাসনে অন্তত কিছু খাঁটি মানুষের অতি প্রয়োজন। কেননা মানুষের মন মানসিকতা আর ভাবনাতে ভেজাল থাকলে ভেজালের লাগাম কে টেনে ধরবে?

আশেক মাহমুদ : সহকারী অধ্যাপক, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
[email protected]

 
Electronic Paper