অভিনন্দন মাশরাফি ও ভূমিমন্ত্রীকে
নূরুজ্জামান
🕐 ১০:০১ অপরাহ্ণ, মে ৩১, ২০১৯
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ’ শীর্ষক নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী ২১ দফা অঙ্গীকার করেছিলেন। তার মধ্যে তৃতীয় দফায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের কথা বলেছিলেন। নির্বাচন শেষ হলো। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুনরায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন। তারপর নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে বক্তব্যও দিলেন। এমনকি ডাক্তারদের কর্মস্থলে না পেলে চাকরিচ্যুত করার কথাও বললেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে এত এত দক্ষ ও ঝানু রাজনীতিক থাকা সত্ত্বেও একজন নবীন ও বয়সে তরুণ সংসদ সদস্য মাশরাফিকেই প্রথম প্রত্যক্ষভাবে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হলো!
সারা বাংলাদেশ একজন ক্রিকেটযোদ্ধাকে সত্যিকারের রাজনীতিক হিসেবে জনগণের পক্ষের বীর জনযোদ্ধা হিসেবে দেখল। তিনি জাতীয় ক্রিকেট দলের ওয়ানডে অধিনায়কত্বের ফাঁকে নিজ নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সদের অনিয়ম ও কর্তব্যে অবহেলা প্রত্যক্ষ করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। সংসদ সদস্য মাশরাফি সাহেবের এমন কার্যক্রমে অনেকেই নাখোশ হয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। জনৈক ডাক্তার সাহেব তার বিরুদ্ধে অবজ্ঞাসূচক ও অবমাননাকর বক্তব্যও দিয়েছেন। ওই দিন ২৫ এপ্রিল ২০১৯ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। বিশেষ করে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের না পাওয়ার হতাশায় নিমজ্জিত জীবনে একজন প্রিয় নায়কের আবির্ভাবের দিন।
সেদিন দেশের জনপ্রিয় ক্রিকেটার নবীন সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মর্তুজা নড়াইল সদর হাসপাতালে গিয়ে ওই দিনের কর্তব্যরত ডাক্তারদের তালিকায় যাদের নাম ছিল তাদের কয়েকজনের হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর না দেখে তাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন এবং রোগীদের সঙ্গে কথা বলে হাসপাতালের সার্বিক পরিস্থিতি অনুধাবন করেন। তারপর জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের কর্তাদের নিয়ে মতবিনিময় সভা করেন। মাশরাফি একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি, জনপ্রিয় খেলোয়াড় হিসেবে সমাদৃত হলেও সেদিন তিনি যে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করেছিলেন তা আমাদের বিস্মিত করে। যার ফলশ্রুতিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ওই দিন নড়াইল সদর হাসপাতালে অনুপস্থিত চার ডাক্তারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল।
চার ডাক্তারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। এরপর বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উন্মাদনায় মাতাল বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা যখন বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলার জন্য বিদেশে পাড়ি জমানোর আগমুহূর্তে তিনি দেখলেন বাংলার কৃষকরা তাদের অতি কষ্টে ফলানো ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না কিন্তু সরকারিভাবে ধান-চাল কেনা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। তখন তিনি নড়াইল জেলা প্রশাসককে ফোন করে খোদ কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার জন্য পরামর্শ দিলেন। আওয়ামী লীগে এমন অনেক নেতা আছেন যারা জেলা প্রশাসক কেন বিভাগীয় কমিশনার মহোদয়কেও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কাজ করার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন। সেই তুলনায় নবীন রাজনীতিক ও বয়সে তরুণ মাশরাফি নিতান্তই বাচ্চা ছেলে। কিন্তু সেই বাচ্চা ছেলেই আমাদের ঝানু রাজনীতিকদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যে কীভাবে প্রশাসনের লোকজনকে সম্পৃক্ত করে তাদের সম্মান দিয়ে জনগণের কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। তিনি ধান কেনার ব্যাপারে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ না দিয়ে তাকে সম্মান করে পরামর্শ দিলেন। এই কাজগুলো আমাদের অনেক দক্ষ, অনেক অভিজ্ঞ, অনেক ঝানু রাজনীতিক কিন্তু করতে পারছেন বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় না।
২
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে দেখলাম আরেকজন বাংলার বীর সন্তান ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ নিজে বিভিন্ন ভূমি অফিসে গিয়ে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের জুলুমে অতিষ্ঠ ভুক্তভোগী জনসাধারণের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলে ভূমি অফিসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে সাময়িক বরখাস্তসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এই কাজগুলো করার অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন আওয়ামী লীগ নেতার কিন্তু দেশে অভাব নেই। প্রধানমন্ত্রী যেখানে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিচ্ছেন, সেখানে অন্য নেতারা তেমন দৃশ্যমান কাজ করছেন না। আমার দেখায় ও জানায় কমতি থাকতে পারে। কিন্তু ক্রিকেটার সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মর্তুজা ও ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ মহোদয়ের কার্যক্রম আমাকে ও দেশবাসীকে আকৃষ্ট করেছে। তাই এই দুই নেতাকে ধন্যবাদ, সালাম ও অভিনন্দন না জানালে নাগরিক হিসেবে দায়িত্বের দায়ভার আমাকে কুরে কুরে খাবে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সভা সমাবেশে আবেগতাড়িত বক্তব্য দিয়ে দেশের মানুষকে সচেতন করার কাজ প্রথম শুরু করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর সরাসরি মাঠে গিয়ে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া অনন্য উদাহরণ স্থাপন করলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা ও সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ। মুখে বলা যত সহজ কাজে প্রকাশ তার চেয়ে অনেক কঠিন। সেই কঠিন কাজে সরাসরি নিজেদের জড়িত করে দুর্নীতির মতো কঠিন ব্যাধির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামলেন বাংলার এই দুই বীর সন্তান। কেউ হয়তো বলবেন তোষামোদি করা হচ্ছে। না, আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের দুজনের কারও সঙ্গেই পরিচিত নই। তাদের দিয়ে আমার কোনো স্বার্থোদ্ধারের অভিপ্রায়ও নেই। কেবল আমাদের প্রিয় দেশকে কণ্টকমুক্ত করতে, সম্ভাবনাময় দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল দেখার মানসে এই দুই নেতার কাজের প্রশংসা করে তাদের উৎসাহিত করতে চাই এবং তাদের মানসিক শক্তি জোগাতে সহায়ক হতে চাই। তাই লেখার ধরন তোষামোদির মতো মনে হলেও আসলে এটা আমার ও দেশের মানুষের আবেগের কথা মাত্র।
এই আবেগ যদি অন্যান্য নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের অনুপ্রাণিত করে, তবে দেশের মানুষের হৃদয়ে যে প্রশান্তির বাতাস প্রবাহিত হবে তার তুলনা কোনো সম্পদ বা প্রশাংসা দিয়ে করা যাবে না। কারণ গলাবাজির রাজনীতি অনেক নেতাই করেন। অনেক আমলাকেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মহামানবের মতো বক্তব্য দিতে দেখি! কিন্তু আন্তরিকভাবে কাজ করার মতো লোক খুব কমই দেখতে পাই। প্রসঙ্গক্রমে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম মহোদয়কেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনেক কথা বলতে শুনেছি। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের গণপূর্ত শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল আলমের বিরুদ্ধে কেনাকাটায় সাগর চুরি করার মতো দুর্নীতির কথা দেশের সব সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যখন ‘বালিশ মাসুদ’ নামে উপহাস করা হচ্ছে, ঠিক তখনই তাকে রূপপুর থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো মাত্র।
তার বিরুদ্ধে ন্যূনতম শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হলো না। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এহেন পদক্ষেপে দেশের মানুষ সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাই তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রতিক্রিয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন। এরই মধ্যে আবার সংবাদমাধ্যমে ব্যাপকভাবে বিটিসিএলএর আধুনিকায়নের নামে লোপাটের দেন-দরবারের কথা ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া সরকারি বিভিন্ন অফিসের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনার কথাও প্রকাশিত হয়ে চলেছে। গত ২৯ মে ২০১৯ তারিখের দৈনিক খোলা কাগজ পত্রিকায় একটি কলাম পড়লাম। সেখানে লেখক ‘রহস্যময় শক্তির আধার বিজেএমসি’ শিরোনামে এক নিবন্ধ লিখেছেন। লেখায় বাংলাদেশের অহংকারের প্রতীক সোনালি আঁশ পাটের উজ্জ্বল সম্ভাবনার যুগে এসে বিজেএমসি কেন লোকসানের পর লোকসান দিয়ে যাচ্ছে তার সুন্দর গঠনমূলক সমালোচনা করেছেন। রাস্তাঘাটের উন্নয়নমূলক কাজের দুর্নীতির চিত্রও গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কম প্রকাশ হচ্ছে না।
মোট কথা, সরকারি কাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যখন দুর্নীতির বিভিন্ন ধরনের চিত্র দেশবাসীর চোখ ছানাবড়া করে ভেসে বেড়াচ্ছে, তখন বাংলার জনপ্রিয় ক্রিকেটার নবীন সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মর্তুজা ও ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ মহোদয়ের মাঠে নেমে প্রত্যক্ষভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত হয়ে দাঁড়ানোকে দেশবাসী স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সমর্থন দিচ্ছেন। আর আমি তাদের বাংলার বীর সন্তান হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের সাহস জোগানোর জন্যই এই লেখা লিখলাম। দেশবাসী রাজনীতিক ও আমলাদের মাধ্যমে দেশে বিরাজমান দুর্নীতির টুঁটি চেপে ধরার যুদ্ধে শামিল হওয়ার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছেন। আমি সেই আগ্রহ বাস্তবায়নের কাজে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া দুই অগ্রপথিক সংসদ সদস্যকে ধন্যবাদ জানাই।
নূরুজ্জামান : কলাম লেখক।
[email protected]