ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বাঁচায় নদী, বাঁচাও নদী-৪৭

দিকে দিকে নদী দখল ও উচ্ছেদ

ড. তুহিন ওয়াদুদ
🕐 ৯:৫০ অপরাহ্ণ, মে ২৯, ২০১৯

একটি নদী একদিনেই দখল হয় না। ধীরে ধীরে একটি নদী দখল হয়। একজন মানুষ একাই একটি নদী দখল করে না। অনেকে মিলে নদী দখল করে। নদী যে গোপনে দখল হয় তাও নয়। প্রকাশ্যে নদী দখল হয়। দখলের প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে এবং বিভিন্ন স্থানে এর দখল সংগঠিত হওয়ার কারণে দখলদাররা সাধারণত বাধা প্রাপ্ত হন না।

মাঠ পর্যায়ে নদীর সীমানা কোথাও চিহ্নিত করা থাকে না। ইউনিয়নভিত্তিক ভূমি কার্যালয়ের দায়িত্ব আছে নদীর সীমানা চিহ্নিত করা। কিন্তু কখনোই তা করা হয় না। নদী কোথাও দখল হলে ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিগণ তা প্রতিরোধে এগিয়ে আসার কথা। বাস্তবে তা করা হয় না। যদি প্রতি বছর নদীর সীমানা চিহ্নিত করার কাজ বহাল থাকত তাহলেও নদী কেউ দখল করতে পারত না। জেলা প্রশাসকগণ দেখভালের দায়িত্ব থাকলেও অনেক কাজের চাপে নদীর প্রতি আলাদা নজর দেওয়ার পর্যাপ্ত সময় তারা পান না। ফলে নদী হয়ে ওঠে অভিভাবকহীন।

নদী শ্রেণিভুক্ত জমির কখনো শ্রেণি পরিবর্তনের সুযোগ নেই। নদী শিকস্তি এবং নদী পয়স্তি আইন আছে। নিয়ম অনুযায়ী যদি কোনো এলাকা ভেঙে নদীতে যায়, তাহলে ৩০ বছর ধরে সেই নদীর প্রতি বছরের রেকর্ড রাখতে হয়। তারপর যদি সেই নদী যদি আবার সেখান থেকে সরে যায় তাহলে সেই জমির পুরনো মালিক তার মালিকানা বিধান সাপেক্ষে ফিরে পাবেন। আর যদি নদী ৩০ বছর বলবৎ থাকে তাহলে তার মালিকানা রাষ্ট্রের। সাধারণত কোনো ভূমি অফিস কিংবা জমির মালিক প্রতি বছরের রেকর্ড তারা রাখেন না। ফলে জমি নদীতে ভেঙে গেলে তা নদীরই হয়ে যায়। এ ছাড়া সিএস নকশায় ১৯৪০ সালে যেটা নদী হিসেবে উল্লেখ হয়েছে সেটার শ্রেণি পরিবর্তন করা আইনগতভাবেই সম্ভব নয়।

আমাদের দেশে যে নদীগুলো আছে তা প্রাকৃতিকভাবেই হয়েছে। নতুন করে মানুষ এসব নদী তৈরি করেনি। ফলে আজকের দিনে সেব নদী পাওয়া যায় সেগুলো নদী ১৯৪০ সালেও ছিল। সিএস নকশায় নদী হিসেবে সেগুলো তালিকাভুক্ত হয়েছে। ১৯৪০ সালের পর ১৯৬২ সালে আরেকটি ভূমি জরিপ হয়েছে। সেই জরিপে অনেক স্থানে সিএস নকশায় উল্লেখিত নদীর শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়েছে। এটা একেবারেই বেআইনি। ব্যক্তিগত জমি সুরক্ষায় এবং নদী দখলে দখলদাররা সোচ্চার থাকেন। এই দখল প্রক্রিয়ায় আমাদের অনেক সরকারি ব্যক্তিও যুক্ত থাকেন। অন্যদিকে নদী রাষ্ট্রীয় সম্পদ। সেই সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য কেউ নিবেদিত নন। বিভিন্ন এলাকার অভিজ্ঞতা এরকম যে, কিছু কিছু জনপ্রতিনিধি দখলপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। ফলে নদীর পক্ষে দাঁড়ানো মানুষের সংখ্যা কম। ব্যক্তি যদি অপর কোনো ব্যক্তির সম্পদ দখল করতে আসত তাহলে বাধা পেত। রাষ্ট্রের সম্পত্তি দখল হলে মানুষ ভাবে রাষ্ট্র দেখবে। রাষ্ট্রযন্ত্রও থাকে চুপ। ফলে নদী এসব দুর্বলতার কারণে নদীখেকোর পেটে চলে যায়।

একটি নদী দখল করার পর সেই নদীর খাজনা দেওয়া হয়। দখলকৃত জমিতে বাসা করা হলে তার প্ল্যানের অনুমোদন দেওয়া হয়। যারা নদীর জমির খাজনা গ্রহণ করেন তারা কেন এটা করেন? যে জমির খাজনা আগে থেকে নেওয়া হয়নি কিংবা যে জমি নদীতে পরিণত হয়েছে তার তো খাজনা নেওয়াটাই অন্যায়। নদী তো দূরবর্তী কোথাও থাকে না। যে ইউনিয়নে নদীটি প্রবাহিত সেই ইউনিয়নেই ভূমি কার্যালয় খাজনা গ্রহণ করছে। তারা কি কখনো মাঠপর্যায়ে খবর রাখেন না?

দখলদার সব সময়ই দখলদার। অসাধু চক্রের মাধ্যমে তারা জমির দখল নেয়। এই অসাধু চক্রের মধ্যে সরকারি কর্মচারীরা যুক্ত হলে তো সরষের মধ্যেই ভূত ঢুকে পড়ার শামিল। যারা জমি দখল করেন, সেই দখল উচ্ছেদ করতে গেলে তখন তারা নিজেদের পক্ষে খাজনা দেওয়ার তথ্যাদি হাজির করেন। দখলদাররা মনে করেন, তিনি সরকারকে দীর্ঘকাল ধরে খাজনা দিচ্ছেন। তাই সে জমির মালিকানা তার না হওয়ার কোনো কারণ নেই।

সবাই জমির কাগজ ভালোভাবে বোঝেন তা নয়। কেউ হয়তো দেখেছেন অনেক দিন ধরে একজন নদীর পাশের জমি ভোগ করছেন। সেই জমি যখন তিনি বিক্রি করছেন, কেউ হয়তো সেই জমি কিনলেন। যিনি জমিটি কিনলেন, তিনি জমি নিজের নামে খারিজ করতে গেলে ভূমি অফিস কোনো আপত্তি তুলল না। তিনি নিয়মিত খাজনা পরিশোধ করলেন। সেই জমিতে বাড়িও করলেন। এরপর একদিন সরকারি-বেসরকারি যে কোনো সূত্রে তিনি জানলেন যে, তার জমি মূলত নদীর।

নদীর জমি হলে সেই নদী ভোগ করার সুযোগ নেই। ফলে তার বাড়ি ভেঙে ফেলা হবে এটাই স্বাভাবিক। তাহলে দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় সেই ব্যক্তি জমি ক্রয় করলেন, খাজনা দিলেন, নিজের নামে খারিজ করলেন, বাড়ির প্ল্যান পাস করালেন এমনকি বাড়ি করার পর বাড়িরও কর দিলেন। এর যে কোনো একটিতেও যদি তিনি বাধাগ্রস্ত হতেন তাহলে তিনি আগেই বুঝতেন জমিটি নদীর। কেনার সময়ে ভূমি অফিস আপত্তি তুললে তার নদী কেনার টাকা নষ্ট হতো না। খাজনা না নিলে তার জমি খারিজ হতো না। ফলে বাড়ি করার প্রশ্নই আসত না। যদি প্ল্যান পাস না হতো তাহলেও তিনি বাড়ি করতে পারতেন না। ফলে কোনো একজন মানুষ যখন তার সবটুকু আয় দিয়ে একটি বাড়ি তৈরি করলেন তারপর সরকারিভাবে বলা হলো নদীর জমিতে বাড়ি করা হয়েছে। এ কথা ঠিক, যিনি বাড়ি করবেন তারও দায়িত্ব আছে যথাযথ খবর নেওয়ার। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন স্তরের দায়িত্ব ছিল যথাযথ ব্যবস্থা যথাসময়ে গ্রহণ করার। এভাবে আমাদের অনেক মানুষের অনেক বড় বড় ক্ষতি হচ্ছে। এতে করে অনেকেই সামজিকভাবেও হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন। নদীর পাড়ে যাদের বাড়ি আছে, তাদের নিজেদেরই এখন খবর নেওয়া প্রয়োজন তার বাড়ি কোনোভাবে নদীর জমিতে পড়েছে কিনা। যদি পড়ে থাকে তাহলে স্বেচ্ছায় সরকারকে জানানো। যারা তাদের বিপদে ফেলেছেন তাদের শাস্তি দাবি করে কণ্ঠ উঁচু করা প্রয়োজন। নদীর জমি ব্যক্তির নামে বরাদ্দ দেওয়ার পক্ষে যেসব কাগজপত্র আছে সব কাগজে যাদের স্বাক্ষর আছে তারাই মূলত এই অসাধু চক্রের প্রমাণিত সদস্য। অজ্ঞতায় হোক আর অবৈধ সুবিধা নিয়ে হোক, যারা নদীর জমি ব্যক্তির নামে দিয়েছে তাদের এখন আইনের আওতায় আনা সম্ভব।

নদী দখল করলে সেই দখল যেদিনই হোক না কেন উচ্ছেদ হবেই। কারণ নদী যারাই দখল করুক না কেন, সেই নদীর পরিচিতি কাগজ থেকে তো তুলে ফেলতে পারেনি। পুরনো অনেক কাগজপত্রে নদীর উল্লেখ আছে। সেই পরিচিতি ধরে একদিন নদী উদ্ধার হবেই। আমরা ঢাকায়, চট্টগ্রামে দেখেছি সরকার অনেক বড় বড় স্থাপনা ভেঙে নদীর জায়গা উদ্ধার করছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে যারা এসব বাড়ি করার অনুমতি দিয়েছিল, নদীর জমি ব্যক্তির নামে বরাদ্দ দিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি ছিল। আমাদের নদী উচ্ছেদের নতুন আইন করে তো নদীর দখল উচ্ছেদ করা হচ্ছে না। পুরোনো আইনেই দখল উচ্ছেদ হচ্ছে। বেআইনিভাবে এই দখল প্রক্রিয়া সংগঠিত করার ক্ষেত্রে যারা সহায়ক তারা কেন শাস্তির বাইরে থাকবেন? একদিনে তো বিশাল বিশাল অট্টালিকা গড়ে ওঠেনি।

এখন সময় এসেছে যারা নদীর জমি ব্যক্তির নামে বরাদ্দ দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার। এরকম কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করা গেলে সরকারি কর্মচারীরা আগামীতে নদীর জমির শ্রেণি পরিবর্তন করার সময়ে দশবার করে ভাববেন। যারা প্রকৃত দখলদার তারা শত চেষ্টা করলেও নদীর দখল পাবে না। আর যারা জমির কাগজ বোঝেন না তারাও প্রতারণার শিকার হবেন না।

ড. তুহিন ওয়াদুদ : সহযোগী অধ্যাপক,
বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর ও
পরিচালক, রিভারাইন পিপল
[email protected]

 
Electronic Paper