মুনতাসীর মামুন
পথিকৃৎ তিনি নতুন স্বপ্নবোনার
আমিনুর রহমান সুলতান
🕐 ১০:০৭ অপরাহ্ণ, মে ২৫, ২০১৯
মুনতাসীর মামুন সৃজনশীল ও মননশীল উভয় শাখার খ্যাতিমান লেখক এবং ইতিহাসবিদ। এ ছাড়াও তিনি পেশাজীবনে অধ্যাপক। ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে যে-কজন ইতিহাসবিদ ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, আচার্য যদুনাথ সরকার, রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনেশচন্দ্র সেন, ড. নীহার রঞ্জন রায়, বিনয় ঘোষ, মমতাজুর রহমান তরফদার, সালাহউদ্দীন আহমদ প্রমুখ খ্যাতির শীর্ষে রয়েছেন তাদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে যার নামটি যুক্ত হওয়ার সামর্থ্য অর্জন করেছেন তিনি হলেন- মুনতাসীর মামুন।
ইতিহাস রস-কষহীন পাঠ্যবিষয় হিসেবেই সবার জানা। কিন্তু ইতিহাসকে কীভাবে জনপ্রিয় করে তোলা যায়, জনমানুষের জীবনচর্চার নানা প্রাসঙ্গিকতায় সঙ্গী করা যায়-এর সাফল্যের পথিকৃৎ হিসেবে মুনতাসীর মামুন অগ্রগণ্য।
মুনতাসীর মামুনের অগ্রজ খ্যাতিসম্পন্ন ইতিহাসবিদ ইতিহাসের রাস্তা তৈরি করার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন সত্য, তবে এই রাস্তায় যেন সর্বসাধারণ আপন গতিতে হাঁটতে পারেন সেজন্য চেষ্টা করেছেন তিনি। সেই সঙ্গে ইতিহাসের পাঠ থেকে কেবল রাজাবাদশা, রাজ্যশাসকদের প্রেক্ষাপটই নয় বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, মুক্তিসংগ্রাম ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতির সামগ্রিকতা থেকেও পাঠ নেওয়া যায়, এ বিষয়ে মুনতাসীর মামুন দীর্ঘবছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন।
প্রথমে আসা যাক, ঢাকাকে কেন্দ্র করে যে ইতিহাস, জনশ্রুতি ও কিংবদন্তি তা আমাদের যেকোনো প্রজন্মের মানুষকে কৌতূহলী করে তোলে। আর এক্ষেত্রে ইতিহাসের ভেতর দিয়েও যে মনকে কৌতূহলী করে ঐতিহ্যবাহী স্থান এবং এখানে বসবাসকারী মানুষ সম্পর্কে সম্যকভাবে জানার যে স্বপ্ন মনে জাগে তার পথিকৃৎ তিনি। শুধু তাই নয়, স্বপ্ন বাস্তবায়ন ও রূপায়ণেও তিনি অনন্য। নিজেই ঢাকা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি ও সম্পাদনা করেছেন। ঐতিহ্যবাহী ঢাকার প্রাচীন ইতিহাসের অনেক কিছুই প্রায় বিস্মৃত। এ বিস্মৃতপ্রায় নানান দিক তিনিই উন্মোচন করেছেন। ঢাকাবিষয়ক তার গ্রন্থ রয়েছে ৫৫টি। হয়তো আরও রচিত হতে পারে। এ বিষয়ে রেহানা পারভীন একটি গ্রন্থও লিখেছেন। গ্রন্থের শিরোনাম ‘ঢাকার ইতিহাস চর্চা ও মুনতাসীর মামুন’।
গ্রন্থটি মুনতাসীর মামুনের জন্মদিন উপলক্ষে প্রকাশ করেছে সুবর্ণ। এ বই সম্পর্কে ভোরের কাগজ সাময়িকীর বিভাগীয় সম্পাদক লিখেছেন- ‘চার যুগেরও বেশি সময় ধরে ঢাকার ইতিহাস নিয়ে কাজ করছেন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। নিরলস সাধনায় ঢাকার প্রাচীন ইতিহাসের বিস্মৃতপ্রায় বহু অধ্যায় উন্মোচন করেছেন তিনি। মুনতাসীর মামুনের এখন পর্যন্ত প্রকাশিত ঢাকাবিষয়ক বইয়ের সংখ্যা ৫৫টি। এর মধ্যে রয়েছে কোষগ্রন্থ, গবেষণাগ্রন্থ, প্রবন্ধ সংকলন, সম্পাদনা ইত্যাদি। ঢাকা বিষয়ে অন্য কোনো লেখকের এত অধিকসংখ্যক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ লেখা নেই। মুনতাসীর মামুনের ঢাকা গবেষণার ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্য নিয়ে পাঠক-গবেষকদের অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তাদের বিভিন্ন লেখায়। এবার গবেষক রেহানা পারভীন মুনতাসীর মামুনের গবেষণার এ দিকটি নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা করেছেন ঢাকার ইতিহাসচর্চা ও মুনতাসীর মামুন শিরোনামে। গ্রন্থের শুরুতে ঢাকা বিষয়ে অন্য লেখকদের লেখার একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ধাপে ধাপে মুনতাসীর মামুনের ঢাকাবিষয়ক বইগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত কিন্তু ঋদ্ধ আলোচনা রয়েছে। ফলে মুনতাসীর মামুনের পাঠকগণ তার ঢাকাবিষয়ক সব রচনার সঙ্গে একটি প্রাথমিক পরিচিতি তৈরি করতে পারবেন। বাংলা বইয়ের প্রকাশনা জগতে নিঃসন্দেহে বইটি একটি ভিন্নধারার সংযোজন।
গ্রন্থে মুনতাসীর মামুনের একটি সংক্ষিপ্ত জীবনীও যুক্ত করেছেন লেখক। ফলে ৫৫টি বইয়ের রচয়িতা হিসেবে যারা মুনতাসীর মামুনকে ঢাকা গবেষক হিসেবে দেখবেন তারা তার রচনাভুবনের ব্যাপ্তি ও গভীরতা সম্পর্কেও ধারণা লাভ করবেন। মুনতাসীর মামুনকে কেউ জানেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, কেউ জানেন পূর্ববঙ্গ গবেষক, কেউ আবার জানেন রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে। এমন নানা পরিচয়ের একটি দিক ঢাকা গবেষণা। ফলে পাঠক যেন ঢাকার ইতিহাস পড়তে গিয়ে লেখকের খণ্ডিত পরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে পড়েন এ ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত জীবনীটি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।’
ঢাকা সম্পর্কে মুনতাসীর মামুন রেহেনা পারভীনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে যে মন্তব্য করেছেন তা উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন- ‘ঢাকা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে প্রাথমিকভাবে কিছু বাধার সম্মুখীন হই। আমি কাদের জন্য লিখব? প্রথম থেকেই আমার লক্ষ্য হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষ, গুটিকয় নাক উঁচু পাণ্ডিতের জন্য লিখতে আমি কখনো আগ্রহ বোধ করিনি। গবেষণা ও পাণ্ডিত্য সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল অদ্ভুত। যেমন- ইংরেজিতে লিখতে হবে, বই বা সাময়িকী দেখতে হবে অনুজ্জ্বল, ভাষা জটিল ও কঠিন। বাংলায় ভালো গবেষণা হয় না। যদি কোনো বই বেশি বিক্রি হয় তাহলে তার মূল্যহ্রাস পায় ইত্যাদি। স্বাধীনতার পরপর আমাদের তরুণদের চিন্তা-চেতনা ছিল অন্যরকম। মনে হয়েছিল, এ দেশের কাছে আমরা ঋণী। তাই এ দেশের ইতিহাসের ওপর গুরুত্ব দিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য লিখতে হবে যে ভাষায় তারা বোঝে। এটি সামাজিক দায়িত্ব। তা ছাড়া একটি বিষয় বুঝতে আমি অক্ষম যে, দলিলপত্রের ওপর ভিত্তি করে গবেষণালব্ধ ফলাফল যদি সাধারণ বাংলায়, পত্রিকায় লিখি তাহলে তা গুরুত্বহীন হবে কেন? আমি তো ফিকশন লিখছি না।
এ বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে আমি লিখতে শুরু করি। বিচিত্রা ঢাকা বিষয়ক অনেক প্রচ্ছদ কাহিনীও প্রকাশ করে। বিষয় হিসেবে ঢাকা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। আমরা অনেকেই এতে উৎসাহিত বোধ করি।’
মুনতাসীর মামুনই একমাত্র ইতিহাসবিদ যার চেতনাগত অবস্থান থেকেই মনে প্রথম জিজ্ঞাসার উদ্ভব হয়েছিল এই ভেবে, ‘বাংলার ইতিহাসে পূর্ববাংলা নেই কেন?’ আর এজন্যই তিনি প্রথম ঐতিহ্যবাহী ঢাকাকে তার গবেষণা ও রচনার মূল কেন্দ্রে এনে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন।
প্রতিটি মানুষের মনোজগতে সুপ্ত থাকে ঐতিহ্য-ইতিহাস সংস্কৃতি ও রাজনীতির বোধ। আর তাকে জাগিয়ে তোলার কাজটি সহজ নয়। অথচ মুনতাসীর মামুন প্রতিটি মানুষের মর্মমূলেই নাড়া দিতে সক্ষম। প্রতিটি মানুষের মনোজগতে সুপ্ত থাকা ঐতিহ্য-ইতিহাস সংস্কৃতি ও রাজনীতির বোধকে মুনতাসীর মামুনের পক্ষেই ধার দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে। এটি সম্ভব হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ-
১. একই সঙ্গে তিনি ইতিহাসচর্চা ও সৃজনশীল সাহিত্যচর্চায় তার চিন্তাকে মুক্ত রেখে কর্মের ভেতর দিয়ে বিকশিত করায়;
২. তার লেখালেখি বিজ্ঞজন ও জনমানসের কাছাকাছি পৌঁছাতে সক্ষম হওয়ায়।
পঁচাত্তর-উত্তর সময় থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বাঙালির ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইতিহাস পাঠ্য বইয়ে বিকৃতির যে ধারাবাহিকতা চলছিল সে জায়গায় তিনিই প্রথম স্বপ্ন দেখেন কীভাবে পাঠ্যপুস্তক থেকে সেই বিকৃতি রোধ করা যায়। এ নিয়ে গ্রন্থও রচনা করেন তিনি। পাঠ্য সংস্কারের কমিটিও গঠিত হয় এ সময়। কমিটির একজন সদস্যও ছিলেন তিনি। এ বিষয়ে তার রচিত গ্রন্থের শিরোনাম- ‘পাঠ্যবই : ইতিহাস দখলের ইতিহাস’ (২০০২)।
মুনতাসীর মামুনের মানসগঠন তৈরিতে তার পরিবারের প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার কথা স্বীকার করতেই হয়। তারপরও নিজের মতো করে ‘দশের মধ্যে এক হওয়া’র কৃতিত্ব তারই।
মুক্তিযুদ্ধের কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক প্রভৃতি বাংলাদেশের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধে জনমানুষের ভূমিকা প্রভৃতির ইতিহাস রচনা করার ক্ষেত্রে এবং সেগুলো সবার মাঝে পৌঁছে দেওয়ার পথিকৃৎ তিনি। স্বপ্ন তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় নানা কর্মের প্রণোদনায় এবং স্বপ্নবোনার জন্য।
মুনতাসীর মামুনের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখালেখি নিয়ে যারা ভাবেন তাদের মূল্যায়ন এক্ষেত্রে স্মর্তব্য- ‘ইতিহাসের প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত শক্তির খোঁজ করেছেন। প্রথমত তার জিজ্ঞাসা মুক্তিযুদ্ধ শুধু কি সামরিক যুদ্ধ ছিল? এ প্রশ্নে তিনি মুক্তিযুদ্ধে গঠিত ১১টি সেক্টরের বাইরে আরও কয়েকটি ক্ষেত্র, তার ভাষায় সেক্টর আবিষ্কার করেছেন। এগুলো মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধের মাত্রা এনে দিয়েছিল। এগুলো মুক্তিযুদ্ধকে যুক্ত করেছিল জনমানুষের সঙ্গে। সেক্টরগুলো হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক ভূমিকা, আঞ্চলিক বাহিনী, বহির্বিশ্বে সাধারণ মানুষের ভূমিকা। তার বিবেচনায় এগুলোকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মূলধারার সঙ্গে যুক্ত না করলে ইতিহাসের মৌলিক দিকটিই হারিয়ে যাবে। সেই তাগিদ থেকে তিনি লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের ১৩ নং সেক্টর যেখানে মুক্তিযুদ্ধে দেশ-বিদেশের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের ভূমিকা ও অবদান তুলে ধরা হয়েছে।
এত দিন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গৌরবগাথা ও বীরত্ব প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের অশ্রু ও বেদনার কাহিনী ছাড়া তার প্রকৃতি স্বরূপ উঠে আসতে পারে না। এজন্যই মুনতাসীর মামুন গণহত্যা-নির্যাতন সিরিজ প্রকাশের প্রয়াস নেন। সাধারণ মানুষের কথা তিনি তুলে ধরতে চান, তুলে ধরেছেন।’
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চায় জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে তাই মুনতাসীর মামুন আমাদের কাছে পুজনীয়। তিনি যা করেন দায়িত্ব নিয়ে করেন, সত্যনিষ্ঠ থেকেই করেন। কারও প্ররোচনা, ভীতি বা প্রীতি তাকে তার বোঝাপড়ার জায়গাটি থেকে এক চুলও সরাতে পারে না। এই দিকটিও গণমুখী ও জনপ্রিয় করে তোলে তাকে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার নানা বিষয়ে বই রয়েছে। তার ‘গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ’, ‘মুক্তিযুদ্ধকোষ’, ‘রাজাকারের মন’, ‘পাকিস্তানি জেনারেলদের মন’; বাঙালি-বাংলাদেশ-মুক্তিযুদ্ধ আমাদের নতুন করে ভাবিয়ে তোলে।
এ প্রসঙ্গে হাশেম খান যথার্থই বলেছেন, ‘জনগণের মনের কথা আশা-আকাক্সক্ষার কথা, স্বপ্নের কথা সময়োপযোগীভাবে তুলে ধরতে পারেন বলেই জনগণের প্রিয় মানুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন।’
মামুন সিদ্দিকী বলেছেন, ‘জনসমাজের কাছে প্রতিনিয়ত তুলে ধরেছেন জনইতিহাস ও তার প্রত্যয়।’
ইতিহাস ও জনজীবনবোধ সম্পর্কে চৌধুরী শহীদ কাদেরের মূল্যায়নও যথার্থ। তিনি লিখেছেন, ‘সমাজের সঙ্গে ইতিহাসকে যুক্ত ও অতীতের ঘটনাবলির সঙ্গে বর্তমানকার ঘটনাবলির সম্পর্ক তৈরি করা ইতিহাসবিদ হিসেবে তিনি তার দায়িত্ব বলে মনে করেন। এভাবেই হয়ে উঠলেন গণমানুষের ইতিহাসবিদ। কেবল তাই নয়; তিনি জনমুখী করতে সচেষ্ট বাঙালির অহমের ইতিহাস, বাঙালির বীরত্বের ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।’
তিনি পথিকৃৎ ‘১৯৭১ : গণহত্যা নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’-এর। এটি গড়ে উঠেছে খুলনার ২৬, সাউথ সেন্ট্রাল রোডে। ২০১৪ সালের ১৭ মে এই জাদুঘরের যাত্রা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে জাদুঘর ট্রাস্টকে একখ- জমি ও একটি বাড়ি উপহার দেন। সেটি সংস্কার করে নিজস্ব ভবনে গণহত্যা জাদুঘরের নবযাত্রা শুরু হয় ২০১৬ সালের ২৬ মার্চ। এ বছর ভবনটি ভেঙে নির্মিত হচ্ছে ছয়তলা ভবন। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে দেশের প্রথম গণহত্যা জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রকল্প নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দক্ষিণ এশিয়ারও প্রথম গণহত্যা বিষয়ক জাদুঘর এটি। মুক্তিযুদ্ধ বা শুধুই যুদ্ধের ইতিহাস বা কাহিনী নয়, এর সঙ্গে আরও নানাবিধ বিষয় যুক্ত এবং যা মুক্তিযুদ্ধের সময়, মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনকারী, গণহত্যাকারী শাসক ও সৈন্যদের প্রভাব তুলে ধরার প্রচেষ্টা করছে।
শুধু জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হননি তিনি। এই প্রতিষ্ঠান থেকে মুক্তিযুদ্ধের গবেষকদের জন্য আয়োজন করে চলেছেন গণহত্যা-নির্যাতন বিষয়ক কর্মশালা। এই কর্মশালায় আমারও অংশগ্রহণ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। নবীন-প্রবীণে মুক্তিযুদ্ধের গবেষকদের দিয়ে মাঠ পর্যায়ে বড় ধরনের একটি কাজ তিনি করিয়ে নিচ্ছেন। তা হলো- ‘গণহত্যা-বধ্যভূমি ও গণকবর সংক্রান্ত জেলা জরিপ’। এর উদ্দেশ্য-
১. গণহত্যার সংখ্যাতাত্ত্বিক বিতর্কের অবসান ঘটানো।
২. গণহত্যায় শহীদের সংখ্যা, বধ্যভূমির সংখ্যা ও অবস্থান, গণকবর নির্ধারণ, গণহত্যা ও নির্যাতন কেন্দ্র নিরূপণ করা।
জরিপ শেষে গ্রন্থাকারে প্রকাশেরও ব্যবস্থা করছেন। এর মধ্যে ২০টি জেলার জরিপ সম্পন্ন হয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। ময়মনসিংহ জেলা জরিপের কাজটি আমি করেছি। গ্রন্থটি প্রকাশের অপেক্ষায়।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় এ ধরনের জরিপ এবং গণহত্যা নিঘণ্ট গ্রন্থমালা নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। ৮০টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ইতোমধ্যে।
এ জাদুঘরের আরেকটি নতুন মাত্রা হচ্ছে “গণহত্যার স্মৃতি সংরক্ষণ ও নতুন প্রজন্মের সামনে গণহত্যার ইতিহাস তুলে ধরতে ‘স্মৃতিফলক’ নির্মাণ।”
বলা যায় ‘বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর’ কথা। এই প্রতিষ্ঠানের স্বপ্নবোনারও পথিকৃৎ তিনি। সারা দেশের অধিকাংশই তরুণ (প্রবীণ নেই এমন বলছি না) মুক্তিযুদ্ধের গবেষক, ইতিহাস, ঐতিহ্যের গবেষক তার নেতৃত্বে স্বপ্ন রূপায়ণের কাজ করে চলেছেন। তিনি যেন দ্রোণাচার্য। তার যেমন রয়েছে পা-বের দল, তেমনি রয়েছে একলব্যের দল।
নিজের হাতে গড়ে তুলছেন এক দল তরুণ গবেষক। তিনি যে নতুন নতুন স্বপ্ন দেখেন এবং বুনে যান তার সেসব স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করেন তরুণ গবেষকদের।
এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করতে পারি- মামুন সিদ্দিকী, তপন পালিত, চৌধুরী শহীদ কাদের, আহম্মেদ শরীফ, রেহানা পারভীন, মুর্শিদা বিনতে রহমান, মিঠুন সাহা, শান্তা পত্র নবীশ, সুস্মিতা দাশ, আজরিন আফরিন প্রমুখের নাম। অবশ্য আমার মতো একলব্যও অনেক রয়েছে।
মুনতাসীর মামুন আজ অনুকরণীয়, অনুসরণীয় নতুন প্রজন্মের কাছে। এতসব পথিকৃতের জন্যই তার প্রাপ্তি। স্বদেশ রায় মুনতাসীর মামুনকে মূল্যায়ন করছেন এভাবে- ‘তিনি ঝড়ের পরে আম কুড়ান না, তিনি ঝড় মাথায় নিয়েই আম কুড়ান।’
মুনতাসীর মামুন আমাদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন কীভাবে সাহসী হতে হয়, সত্যকে নির্মোহ দৃষ্টিতে উদঘাটন করতে হয়। কীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে হয়, জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হয় সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।
নতুন নতুন স্বপ্নবোনার পথিকৃৎ মুনতাসীর মামুন সম্পর্কে কবি আসাদ মান্নানের একটি কবিতার শেষ অংশ যেন আমারও কথা-
এমন ভয়াল দিনে যাকে দেখি দুর্মর সাহসে
সত্যের সমূহ শক্তি শব্দে ধরে চারণের মতো
চুয়ান্ন হাজার বর্গমাইল ব্যাপ্ত এই রক্ত মাখা
দেশের মাটিকে ভালোবেসে নির্ভয়ে ছুটছেন তিনি
প্রান্ত থেকে সীমান্তের দূরান্তের আনাচে কানাচে-
খুঁজে বেড়াচ্ছেন বধ্যভূমি, গণকরবের দাগ;
এখনো যুদ্ধের মাঠে তিনি এক লড়াকু সৈনিক।
তরুণ প্রজন্মপ্রাণে অবিরাম ধ্যানে আর জ্ঞানে
যে আলো ছড়িয়ে তিনি জাগাচ্ছেন জাতির চেতনা
তাঁকে আজ ঠাঁই দেব কোন নামে- কোন উঁচু ধামে!
এটা গল্পকথা নয়- জন্মদুঃখী মরমি বাংলার
মহা জাতিসত্তা থেকে জন্ম নেয়া তুলনারহিত
এক রত্নপুত্র তিনি- সময়ের পরশপাথর।
মৃত্যুকে উপেক্ষা করে দেশ থেকে কলঙ্কের দাগ
মুছে ফেলতে যিনি নিরলস; কথা ও কলম যাঁর
গ্রামে গঞ্জে খুঁজে ফেরে সব বধ্যভূমি; অবলুপ্ত
বহু গণকবরের অবরুদ্ধ কান্না, হাহাকার
কী অপূর্ব কথার জাদুর টানে নিয়ত লিখেন
জনতার জনযুদ্ধে গৌরবের জনইতিহাস,
যেখানে পিতার স্বপ্নে কন্যা আজ মূল বাতিঘর।
আমিনুর রহমান সুলতান : উপপরিচালক, ফোকলোর উপবিভাগ এবং জাদুঘর ও মহাফেজখানা উপবিভাগ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা
[email protected]