শবে কদরের সন্ধানে
ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
🕐 ৮:৫৭ অপরাহ্ণ, মে ২৪, ২০১৯
কোনো বিষয়ের ধর্মীয় গুরুত্ব প্রমাণের জন্য কোরআন হাদিসে একটু ইশারাই যথেষ্ট। তারপরও শবে কদরের একটি রাতের মহিমার কথা পরিষ্কার ভাষায় ব্যক্ত করা হয়েছে কোরআন মজিদে। তাও একটি দুটি শব্দ, বাক্য বা আয়াতের মাধ্যমে নয়। স্বতন্ত্র একটি সুরা নাজিল করে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে এই রাতের মহিমাকে।
সুরা কদর বা ‘ইন্না আনজালনা’ নামে পরিচিত কোরআনে কারিমের ৩০তম পারায় ৯৭ ক্রমিকের এই সুরায় বলা হয়েছে, ‘কদরের রাত এমন মহিমান্বিত যে, মহাগ্রন্থ কোরআন এই রাতে নাজিল করা হয়েছে। এই একটি রাত হাজার বছরের চেয়ে উত্তম।’ অর্থাৎ কেউ এক হাজার মাস (৮৩ বছর ৪ মাস) একটানা ইবাদত-বন্দেগির মধ্যে কাটালে যে সওয়াব হবে, এই একটি রাতের সওয়াব তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি।
শরতের পূর্ণিমায় পৃথিবীতে যেভাবে জ্যোৎস্নার প্লাবন নামে, তেমনি শবে কদরেও শান্তি-প্রশান্তির অপার্থিব বন্যায় প্লাবিত হয় বিশ্বজাহান। আসমানের ফেরেশতারা নেমে আসেন পৃথিবীতে আর চারদিকে আলোর উৎসবে শামিল হন এই রাতে। ফেরেশতাদের নেতৃত্বে থাকেন হজরত জিব্রাঈল (আ.), যিনি নবী-রাসুলগণের কাছে আল্লাহর সংবাদ ও ওহী আনার মহান দায়িত্ব পালন করেছেন সৃষ্টির শুরু থেকে।
সারা রাত শান্তির সওগাত বিলানোর এই কাজ চলতে থাকে পরদিনের ফজরের উদয় পর্যন্ত। সত্যিই কত মহিমান্বিত একটি রজনী আল্লাহপাক অবারিত করেছেন মানব জাতির জন্য। এই রাতকে বরণ করার প্রার্থী বা পাত্র যদি না পাওয়া যায়, ফেরেশতারা আল্লাহর অফুরন্ত অনুদান ফেরত নিয়ে যান না আসমানে। তারা বনে জঙ্গলে সাগরবক্ষে বিলিয়ে দেন এ রাতের আসমানী সওগাত।
অবশ্য এই মহিমান্বিত রাতটি অনির্দিষ্ট এবং তা গোপন রাখা হয়েছে। কারণ, যদি রাতটির দিনক্ষণ নির্দিষ্ট থাকত আর মানুষ রাত জেগে এর ফজিলত ও মহিমা লাভের জন্য তৎপর না হতো, তাহলে আল্লাহর এত বড় নেয়ামতের প্রতি অবহেলা করার শাস্তি হতো অকল্পনীয়। কাজেই শবে কদর অনির্দিষ্ট ও গোপন থাকার মধ্যেও মানব জাতির জন্য কল্যাণ রয়েছে। তবে প্রিয়নবী এর সম্ভাব্য দিনক্ষণ বাতলে দিয়েছেন পবিত্র হাদিসে।
নির্দেশ দিয়েছেন ‘তোমরা রমজান মাসের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে শবে কদর তালাশ কর।’ শবে কদর তালাশের জন্য তিনি মদীনার জীবনে একবার বাদে প্রতিবছর রমজানে ইতেকাফ করেছেন। কাজেই শবে কদর তালাশের সবচে উত্তম পন্থা মসজিদে গিয়ে পুরুষদের এবং বাসগৃহে কোনো স্থান নির্দিষ্ট করে মহিলাদের ইতিকাফ করা। অন্য কথায় পবিত্র লাইলাতুল কদর সন্ধান করাই ইতেকাফের মূল লক্ষ্য। সে লক্ষ্য অর্জনের সিদ্ধান্ত এখনই নিতে হবে।
হাদিস শরীফে শবে কদরের ফজিলত বা মাহাত্ম্য সম্বন্ধে তেমন বর্ণনা নেই। কারণ, কোরআন মজিদে একটি স্বতন্ত্র সুরা (সুরা কদর) নাজিল করে আল্লাহপাক যেভাবে এই রাতের ফজিলত বর্ণনা করেছেন, তার চেয়ে অধিক ফজিলতের বর্ণনা অসম্ভব। তাই ফজিলত বর্ণনার পরিবর্তে হাদিস শরীফে এর দিনক্ষণ ও তালাশের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা রয়েছে।
নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আমি শবে কদর তালাশ করতে গিয়ে (রমজানের) প্রথম দশক ইতিকাফ করেছি। অতঃপর মধ্যম দশকেও ইতিকাফ করেছি। এরপর স্বপ্নে কেউ এসে আমাকে বলল, এটি শেষ দশকে। অতএব যে ব্যক্তি আমার সঙ্গে প্রথমে ইতিকাফ করেছে সে যেন শেষ দশকেও ইতিকাফ করে। (মিশকাত : ১৯৮৬)।
কোন রাতটি শবে কদর তার একটি পরিচয় বা লক্ষণ বলা হয়েছে, পরের দিনের সূর্যের কিরণ উদয়ের সময় নিস্তেজ হবে। (মুসলিমের বরাতে মিশকাত : ১৯৮৭)। তাফসীরে মাইবেদীতে এর কারণ বলা হয়েছে, শবে কদরে রাতের বেলা যে অগণিত অসংখ্য ফেরেশতা আল্লাহর রহমত ও শান্তির সওগাত বিতরণ করেছেন, পরদিন ভোরে তারা আকাশে ফিরে যেতে ভিড়ের আবছা ছায়ায় সূর্যকে নিষ্প্রভ দেখা যায়।
প্রশ্ন হলো, মসজিদে রমজানের শেষ দশ দিন ইতিকাফ করার সুযোগ যাদের নেই তারা কীভাবে এই মহিমান্বিত রাতের ফজিলত লাভ করতে পারে। আমরা জেনেছি, রমজানের শেষ দশদিন মসজিদে ইতিকাফ সুন্নাতে মুয়াক্কাদা এবং তার আসল লক্ষ্য শবে কদর তালাশ করা। আরেক প্রকারের ইতিকাফ আছে, যা মুস্তাহাব। মুস্তাহাব ইতিকাফে দশ দিনের শর্ত নেই। অল্প সময়ের জন্যও হতে পারে। কাজেই শবে কদর সন্ধানীরা দিনের বেলা সম্ভব না হলেও অন্তত শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে কাটাতে পারেন। এই মতের পক্ষে সমর্থন পাওয়া যায় এক হাদিসে।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উনাইছ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.)! পল্লীগ্রামে আমার বাড়ি। আমি সেখানে বাস করি এবং আলহামদুলিল্লাহ সেখানে নামাজও পড়ি। সুতরাং আমাকে রমজানের একটি নির্দিষ্ট রাতের কথা বলে দিন, যাতে আমি (শবে কদরের তালাশে) আপনার মসজিদে আসতে পারি। তখন হুজুর (সা.) বললেন, তুমি তেইশে (রমজান) রাতেই এসো। বর্ণনাকারী বলেন, তখন তার ছেলেকে জিজ্ঞেস করা হলো যে, তোমার পিতা তখন কি করতেন? সে উত্তরে বলল, তিনি যখন আসরের নামাজ পড়তেন তখন ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে প্রবেশ করতেন। অতঃপর (প্রাকৃতিক প্রয়োজন ব্যতীত) ফজর নামাজ না পড়া পর্যন্ত কোনো কাজে মসজিদ হতে বের হতেন না। যখন ফজর পড়তেন মসজিদের দরজায় আপন বাহনটি প্রস্তুত পেতেন এবং সেই বাহনে চড়ে আপন পল্লীতে চলে যেতেন। (আহমদ, আবু দাউদ এর বরাতে মিশকাত : ১৯৯৩)।
হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.)! বলুন, যদি আমি বুঝতে পারি ‘শবে কদর’ কোন রাত্রিতে, তখন আমি কী বলব? তিনি বললেন, তুমি বলবে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা-ফু আন্নি।’ অর্থ : ‘প্রভু হে! তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালোবাস। অতএব আমাকে ক্ষমা কর।’ (আহমদ, ইবনু মাজা, তিরমিজী সূত্রে মিশকাত)।
ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী : প্রাক্তন শিক্ষক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]