ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বাঁচায় নদী, বাঁচাও নদী-৪৬

নদীঘেরা রংপুর শহর

ড. তুহিন ওয়াদুদ
🕐 ৯:৪৮ অপরাহ্ণ, মে ২২, ২০১৯

রংপুর বাংলাদেশের পুরনো শহরগুলোর একটি। রংপুরের আদি শহর মাহিগঞ্জ, যা এখন রংপুর শহরতলিতে পরিণত হয়েছে। নতুন শহরটাই ফুলে ফেঁপে বড় হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবেই বিকাশ হচ্ছে। পুরনো শহর মাহিগঞ্জ গড়ে উঠেছিল ইছামতী নদীর পাড়ে। বড় বড় জাহাজ আসত এই নদীর পাড়ে। এ অঞ্চলের বড় ব্যবসাকেন্দ্র ছিল মাহিগঞ্জ। ইছামতীর ওপর দিয়ে বিদেশে পণ্য আনা নেওয়া হতো রংপুর থেকে। বর্তমানে ক্ষীণ ধারায় এ নদীটি প্রবাহিত হচ্ছে। বেঁচে আছে নামমাত্র।

রংপুর শহরটি নদীবেষ্টিত। বাংলাদেশে এ রকম শহর খুব কম আছে যার চারদিকে নদীঘেরা। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, শহরের অনেক মানুষই জানেন না শহরের চারদিকে নদীঘেরা। শহরের পশ্চিমে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়েছে ঘাঘট নদ। তিস্তা নদীর শাখা নদী হচ্ছে ঘাঘট। উৎসমুখে ঘাঘটের প্রবাহ বন্ধ করা হয়েছে। তবুও বর্ষার পানিতে এ নদীটি অনেক প্রশস্ত রূপ লাভ করে। এক সময় এ নদীটি বারোমাসি নদী হিসেবে পরিচিত ছিল। বর্তমানে নদীটি অনেকটাই মৌসুমি নদীতে পরিণত হয়েছে। নদীটির প্রকৃত পরিচর্যা করা সম্ভব হলে সারাবছর পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা অসম্ভব নয়। শহরের সিও বাজারের পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ক্যান্টনমেন্টের পাশের দমদমা নামক স্থান দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গাইবান্ধার দিকে বয়ে গেছে।

সিও বাজারের পূর্ব দিক দিয়ে শহরের উত্তরাংশ ধরে প্রবাহিত হয়েছে বুরাইল নামের একটি নদী। উল্লেখ্য, রংপুরে তিনটি স্বতন্ত্র বুরাইল নদী আছে। এই বুরাইল খটখটিয়া নামক স্থানের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রংপুরের সাতমাথা নামক স্থানের পাশে শ্যামাসুন্দরী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

রংপুরের সাতমাথা-মাহিগঞ্জ থেকে খোকসা ঘাঘট নামের একটি নদী শহরের দক্ষিণাংশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শহরের পার্ক মোড়-মডার্ন হয়ে দমদমায় ঘাঘট নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এছাড়া ইছামতী এবং আলাইকুড়ি নামের দুটি নদী মাহিগঞ্জের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে শ্যামাসুন্দরী নদী। শ্যামাসুন্দরী নদীটি পরিচিতি পেয়েছে খাল হিসেবে। জমিদার জানকী বল্লভ সেন নদীটি পুনরায় খনন করে তার মায়ের নামে নামকরণ করেন। জানকী বল্লভ সেন ওই সময় খনন না করলে হয়তো নদীটি মারা যেত।

চারদিকে নদীবেষ্টিত এ শহরকে বাংলাদেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় শহরে পরিণত করা সম্ভব। এ নদীগুলোর পরিচর্যার মাধ্যমে পানির প্রবাহ বজায় রাখতে পারলে সারা বছর কিছু না কিছু পানি রাখা সম্ভব। এতে করে শহরের পরিবেশের ওপর একটি দারুণ ইতিবাচক প্রভাব থাকবে।

নদীগুলোর পাড় জনগণের চলাফেরার জন্য উপযোগী করে তোলা সম্ভব হলে, এগুলো হতে পারে বেড়াতে যাওয়ার অন্যতম স্থান। বর্তমানে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ঘাঘট নদের একটি অংশ বিনোদন পার্কের আদলে প্রস্তুত করা হয়েছে। সারাদিন শহরের মানুষ টিকিট কেটে সেখানে ঘুরতে যায়। শুধু ঘাঘটের পাড়ের সামান্য একটু অংশ নয়, শহরের চারদিকটাই এভাবে গড়ে তোলা সম্ভব। শহরের মানুষ খোলা জায়গার অভাব অনুভব করবে না। নদীগুলোতে নৌকা চলাচলের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেও এ নদীগুলোতে পানির অনেক প্রবাহ ছিল। একবার কল্পনা করুন তো- একটি শহর, চারদিকে নদী, নদীর পাড়ে মানুষের চলাচলের ব্যবস্থা। ভাবতেই তো ভালো লাগে।

বর্তমানে এ নদীগুলোর করুণ অবস্থা তৈরির পেছনে মানুষই দায়ী। দখল আর দূষণে এ নদীগুলোর প্রাণ ওষ্ঠাগত। ঢাকা শহরের নদীপাড়ে অবৈধ স্থাপনা সরকার তুলে দিচ্ছে। সরকারের এই উচ্ছেদপ্রক্রিয়া আমাদের মনেও আশার সঞ্চার করেছে। ১৯৪০ এবং ১৯৬২ এর ম্যাপ অনুযায়ী নদীর সীমানা চিহ্নিত করা এখন সময়ের দাবি। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড চলতি বছর শ্যামাসুন্দরী এবং খোকসা ঘাঘট খনন করছে। শ্যামাসুন্দরী খননের ঠিকাদারি যিনি পেয়েছেন তিনি কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে নতুন করে ঠিকাদার নিয়োগ করতে হবে। খোকসা ঘাঘট খননের কাজ অনেকটাই হয়েছে।

নদী দুটি খননের ধরন নিয়ে কথা আছে। নদী দুটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় খনন হচ্ছে না এ অভিযোগও শোনা যাচ্ছে। খোকসা ঘাঘট খনন করে মাটি নদীর দুপাড়ে ফেলা হচ্ছে। ফলে নদীটি দেখতে খালের মতো দেখাচ্ছে। আগে বৃষ্টির পানি যত সহজে নদীতে নেমে যেত, তা আর সহজে হবে না। নদী খনন করা হচ্ছে কিন্তু ১৯৪০ সালের ম্যাপ অনুসরণ করা হচ্ছে না। ফলে এই খনন আবারও নতুন করে করার প্রয়োজন হতে পারে। এতে করে সরকারের অর্থের ভীষণ অপচয় হবে। নদী আইনটাই এ রকম, একবার যেটি নদী নামে নিবন্ধিত হয়েছে তা আর কোনো দিন শ্রেণি পরিবর্তন করে ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের মালিকানায় যাবে না। সুতরাং পুরনো সিএস ধরেই নদী মাপাটাই যৌক্তিক।

নদী খনন করা হচ্ছে যাতে নদীর পানি প্রবাহ ঠিক থাকে। তার আগে আমাদের চিহ্নিত করা দরকার ছিল নদীটি ভরাট হওয়ার কারণ কী। আগে রোগের কারণ চিহ্নিত করা না গেলে ব্যাধি সারবে না। শ্যামাসুন্দরী নদী পলিতে ভরাট হচ্ছে না। ভরাট হচ্ছে সিটি করপোরেশনের ফেলা বর্জ্য আর নদী তীরবর্তী মানুষের ফেলানো ময়লায়। তাহলে এ নদী খনন করার আগে তো নদী ভরাট করার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। সেদিকে লক্ষ না দিয়ে যেভাবে নদী খনন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এতে করে নদীর খুব বেশি উপকার হবে বলে মনে হয় না। নদী খনন করা আর নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেলা তো একই সঙ্গে চলছে। নদীকে যারা ভাগাড় বানাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ময়লা-আবর্জনা ফেলা বন্ধ করতে হবে। তারপর আসবে নদীর খননসহ অন্যান্য পরিচর্যার প্রশ্ন। তা না করে শুধু খনন করার কাজ শুরু হচ্ছে।

শ্যামাসুন্দরী শহরের ময়লা বহন করে নিয়ে ফেলে খোকসা ঘাঘটে, আর খোকসা ঘাঘট সেই ময়লা ফেলে ঘাঘটে। তাহলে যে নদীগুলো হওয়ার কথা ছিল আশীর্বাদ, সেগুলোকে করা হয়েছে অভিশাপ। আমরা যে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা না নেওয়া জাতি, তার প্রমাণ এখানেও কম নয়।

রংপুর একটি বিভাগীয় শহর। এই শহরে বিভাগীয় পর্যায়ের বড় বড় কর্মকর্তারা আছেন। তাদের চোখের সামনে নদীগুলোর এহেন করুণ দশা। তাহলে আমাদের রংপুরের বিভাগীয় পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্তা-ব্যক্তিরা কি এ দায় এড়াতে পারবেন? আমাদের যদি আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ থাকত, মানুষ সচেতন হতো, সংশ্লিষ্ট দফতরের জবাবদিহিতা থাকত তাহলে নদীগুলো মারা যেত না। নদী দখল করে যারা বাড়ি করার জন্য সিটি করপোরেশনে প্ল্যান পাস করতে দেয় সেই প্ল্যান কীভাবে পাস হয়?

রংপুর সিটি করপোরেশন হওয়ার দশ বছর হলো। এই দশ বছরে শহরের জন্য একটি মাস্টার প্ল্যান এখনো করা সম্ভব হয়নি। মাস্টার প্ল্যানে নদীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা থাকতে হবে। স্থানীয় রাজনীতিক সিটি করপোরেশনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর বিষয়ে যে কোনো উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়। স্থানীয় প্রশাসনকেও কখনো তৎপর হতে দেখিনি। সিটি করপোরেশনও নির্লিপ্ত। অথচ, এই তিনের যৌথ প্রচেষ্টা ছাড়া নদীবেষ্টিত শহরের নদীকেন্দ্রিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করা অসম্ভব।

রংপুর শহরের প্রকৃত সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে হলে এ নদীগুলোর প্রতি মনোযোগ দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আমরা আশায় থাকি, নিশ্চয়ই রংপুরের নদীগুলোর প্রকৃত পরিচর্যার মাধ্যমে শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হবে। এতে বাঁচবে নদী, ভালো থাকবে পরিবেশ। সেই সুদিনের অপেক্ষায়।

ড. তুহিন ওয়াদুদ : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় রংপুর ও
পরিচালক, রিভারাইন পিপল
[email protected]

 
Electronic Paper