জাকাত অনুগ্রহ নয়, গরিবের প্রাপ্য
আরিফুর রহমান জসিম
🕐 ১০:১৪ অপরাহ্ণ, মে ১৯, ২০১৯
জাকাত কি গরিবদের প্রতি ধনী লোকদের অনুগ্রহ ও দান, নাকি ধনীদের কাছে গরিবদের প্রাপ্য হক- এটি একটি বড় প্রশ্ন। যারা ধর্ম মানে না বা ধর্মের প্রতি উদাসীন তারা বলতে পারেন, আমাদের অর্জিত সম্পদে শতকরা আড়াই ভাগ হারে গরিবদের জন্য ভাগ বসানো নিশ্চয়ই অন্যায়। আরবের মুশরিক-কাফেররা এর চেয়েও ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় মুমিনদের যে যুক্তি দেখিয়েছিল, কোরআন মজিদে সুরা ইয়াসিনে তার রেকর্ড রয়েছে। ‘আল্লাহ ইচ্ছা করলে যাদের খাওয়াতে পারতেন তাদের আমরা কেন খাওয়াব- এ তো চরম বোকামি। আসলে তোমরা স্পষ্ট গোমরাহীতে নিমজ্জিত।’ (সুরা ইয়াসিন : ৪৭)।
কোরআন মজিদ এই যুক্তি ও দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করে। আল্লাহপাক স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন, ‘ধনীদের সম্পদে বঞ্চিতদের হক রয়েছে।’ (সুরা আয যারিয়াত : ১৯)। সমাজে কোনো মানুষ একাকী যেমন বসবাস করতে পারে না, তেমনি একাকী সম্পদশালী হওয়াও অসম্ভব। জীবনযাপনের প্রয়োজনে আমরা প্রত্যেকে সমাজের নানা শ্রেণির সাহায্য নিতে বাধ্য।
তাঁতি, দর্জি, ধোপা থেকে নিয়ে পরিবহন শ্রমিক, কৃষক, মজুর, প্রত্যেকের সর্বত্রমুখী চেষ্টায় সমাজ চলে, অর্থনীতির চাকা ঘোরে। ফলে মনের অজান্তেই একজনের হক ও দাবি আরেকজনের ওপর বর্তায়। সমাজের সম্মিলিত প্রয়াসে যখন দেখা যায়, একজন বা একটি শ্রেণির কাছে অনেক সম্পদ জমা হয়েছে আর একটি শ্রেণি হাড়ভাঙা খাটুনি দিয়েও জীবনযুদ্ধে পিছিয়ে পড়েছে, তখন বুঝতে হবে, পিছিয়ে পড়া বঞ্চিত শ্রেণির প্রাপ্য হক যথাযথ আদায় হয়নি, যা ধনীর কাছে গিয়ে জমা হয়েছে।
যার ফলে জীবন বাঁচানোর জন্য সে অন্যের কাছে হাত পাততে বাধ্য বা বঞ্চিত হয়ে পড়েছে। এখন পিছিয়ে পড়া লোকদের কী পরিমাণ সম্পদ ধনীর কাছে জমা হয়েছে বা কত পরিমাণ সম্পদ গরিব শ্রেণির কাছে ফেরত দিলে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা হবে বা এ কাজটি কীভাবে সম্পাদন করা হবে, সে তথ্য দুনিয়ার দার্শনিকদের কাছে নেই। তাই স্বয়ং আল্লাহ ও তার প্রিয় রাসুল (সা.) এই হক নির্ধারণ করে দিয়েছেন শতকরা আড়াই ভাগ হারে।
জাকাতের শাব্দিক অর্থ পবিত্রতা। অর্থাৎ আল্লাহ ও রাসুল (সা.) নির্ধারিত হারে অর্থ দান করলে প্রথমেই ধনীর মনের লোভ মোহ নাস্তনাবুদ হয়ে যাবে। এ লোভ মোহই দুনিয়াতে অধিকাংশ অনর্থের মূল। তাদের লোভ-মোহমুক্ত করার জন্য জাকাতের চেয়ে মোক্ষম হাতিয়ার আর কিছুই হতে পারে না। তাই জাকাত ধনীর অন্তরকে লোভ মোহমুক্ত পরিচ্ছন্ন করে।
অন্যদিকে জাকাত সম্পদকে পবিত্র করে। কীভাবে? সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মাঝে দু’-একজন যখন বিরাট অর্থবিত্তের মালিক হয়; তখন স্বভাবতই তাদের সম্পদের প্রতি গরিব ও বঞ্চিত মানুষের ঈর্ষা জাগে। হিংসার আগুন জ্বলে ওঠে। কিন্তু যখন ধনী লোক বছর শেষে হিসাব করে আল্লাহর হুকুম পালনার্থে জাকাত দিয়ে দেয়, তখন ধনীর প্রতি গরিবের ঈর্ষা ও লোভ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় পরিবর্তিত হয়। দেখা যায়, এ গরিবরাই এমন ধনীর সম্পদের পাহারা দেয়। এভাবেই জাকাত ধনীর মন ও ধনকে পবিত্র করে।
রমজানে জাকাতের প্রসঙ্গ এলে অনেক সম্পদশালী লোক আতঙ্কে ভোগেন। কারণ, মনে করেন যে এত গাড়ি-বাড়ি, দোকান-কারখানা সবকিছুর মূল্য হিসাব করে জাকাত দিতে হলে তো ফতুর হয়ে যেতে হবে। আসলে জাকাত সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে এমন ধারণা জন্মায়।
অন্যথায় হিসাব করলে দেখা যাবে, অনেকের ওপর জাকাত ফরজ হয়নি। হলেও তার পরিমাণ বেশি নয়। যেমন নিজের ঘর, ভাড়া দেওয়ার বাড়ি, গাড়ি, ঘরের আসবাবপত্র, দোকানের ফার্নিচার, কলকারখানার যন্ত্রপাতি যত দামিই হোক, জাকাত দিতে হবে না। যাকাত দিতে হবে জমা টাকা, স্বর্ণ-রুপা, ব্যবসার পণ্যসামগ্রী ও চলতি মূলধনের ওপর, তাও লোন থাকলে সে পরিমাণ বিয়োগ দিয়ে যা এক বছর কাল স্থায়ী থাকে, তার ওপরে।
এক বন্ধু বললেন, এসব কথা বললে ঢাকা শহরের অধিকাংশ লোকের তো জাকাত আসবে না। কারণ, প্রত্যেকে তো বাড়ি করা বা কলকারখানার জন্য বিরাট অঙ্কের লোন নেন। বললাম, হিসাব করে প্রয়োজন হলে ধনীদেরই গরিবের খাতায় এনে জাকাত দেবেন। আপত্তি কোথায়? তবুও সবাই আল্লাহকে ভয় করে নিজের সম্পদের প্রকৃত জাকাতটুকু বের করে দিলে দেখবেন সমাজের চেহারা বদলে যাবে।
আরিফুর রহমান জসিম : খতিব ও ইসলামি চিন্তাবিদ