ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মাঠে-ঘাটে-বাটে

সব মা-ই রত্নগর্ভা

ড. তুহিন ওয়াদুদ
🕐 ১০:০৫ অপরাহ্ণ, মে ১৮, ২০১৯

মা মাত্রই রত্নগর্ভা। এ কথার ভিন্ন কিছু ভাবার কোনো অবকাশ নেই। মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক অভিন্ন সত্তা রূপে। জন্মের পর মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক কেটে স্বতন্ত্র সত্তা তৈরি করা হয়। শরীরের একটি অঙ্গ কেটে আলাদা করলেই সেটি আলাদা হয় না। মা এবং সন্তানের এরকম অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক।

পৃথিবীতে যত মানুষ আছেন, তাদের মধ্যে দুজন মানুষ নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসেন। তাদের একজন মা অন্যজন বাবা। সন্তানের প্রতি তাদের ভালোবাসায় কোনো স্বার্থচিন্তার বিষয় নেই। যাদের মা-বাবা বেঁচে আছেন তারা সবচেয়ে সৌভাগ্যবান। যাদের বেঁচে নেই তারা দুর্ভাগা। যাদের বাবা অথবা মা বেঁচে আছেন তাদের ভাগ্য একেবারেই খারাপ হওয়ার চেয়ে কিছুটা ভালো।

প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার মা দিবস পালিত হয়। এ বছরও পালিত হয়েছে। এ বছরের বিশ্ব মা দিবস আমার কাছে অন্যরকম। খুবই ভালো লাগার। বাংলাদেশ শিক্ষা পর্যবেক্ষক সোসাইটি এবং বাংলার চোখ নামক দুটি সংগঠন রংপুর বিভাগের ৫ রত্নগর্ভা মা’কে সংবর্ধনা দিয়েছে। এই ৫ মায়ের মধ্যে আমার মা একজন। সন্তান হিসেবে এর চেয়ে বড় আনন্দের আর কিছুই থাকতে পারে না। আমার মাসহ ডিমলা উপজেলার ইউএনও নাজমুন্নাহারের মাকে, রংপুরের মেট্রোপলিটন পুলিশ উপ-কমিশনার মহিদুল ইসলামের মাকে, তরুণ উদ্যোক্তা ও সংগঠক তানবীর হোসেন আশরাফীর মাকে এবং আবদুল মালেক মাস্টারের স্ত্রীকে এই সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

গত ১২ মে রংপুরের সুমি কমিউনিটি সেন্টারে এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

সংবর্ধনা অুনষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান। অনুষ্ঠানের শুরুতে অধ্যাপক শাহ আলম ‘মা’ প্রসঙ্গ নিয়ে নাতিদীর্ঘ আলোচনা করেন। কালে কালে, দেশে দেশে মা কত বড়, কত মহান এ নিয়ে তিনি আলোচনা করেন।

ডিমলা উপজেলার ইউএনও নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বার বার অশ্রুসিক্ত হচ্ছিলেন। বাবা মারা গেছেন অনেক আগে। মা-ই সন্তানকে মানুষ করেছেন। সেই ‘মা’ সংবর্ধিত হচ্ছেন, আর সন্তান তার অনুভূতি ব্যক্ত করছেন। তার কথায় মায়ের প্রতি আবেগ আর ভালোবাসা চোখের জল হয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। সন্তানের এই আবেগে উপস্থিত অনেকের চোখেই পানি চলে আসে।

রংপুরের মেট্রোপলিটন পুলিশ উপ-কমিশনার মহিদুলের বাবা মারা যান একেবারেই শৈশবে। কী এক লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি বেড়ে উঠেছেন। ‘মা’ ই তার বাবা এবং মা। তিনি নিজের শৈশব-কৈশোরের কথা বলতে গিয়ে মাকে জ্বালাতন করার কথা অসংখ্য স্মৃতিচারণ করেছেন। এখন তিনি পুলিশের অনেক বড় কর্মকর্তা। তিনি মাকে সামনে রেখে মধুর করে ভালো মানুষ হয়ে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করছিলেন।

তিনি বলেছেন- ‘সারা জীবনে মানুষের উপকার করতে চাই। যদি কারো উপকার করতে নাও পারি, একজন মানুষেরও ক্ষতি করতে চাই না। যার মা বেঁচে আছেন তিনি যদি ভালো মানুষ হন তার কোনো বিপদ হবে না।’ বসে বসে বৃদ্ধ মা সন্তানের মহৎ হয়ে ওঠার চেষ্টার কথা শুনছিলেন। আমি বসে বসে ভাবছিলাম মায়ের বুকটাও গর্বে নিশ্চয়ই আকাশের মতো হয়ে উঠছিল।

আমার মা, তানবীর হোসেন আশরাফির মা অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি। আমার বার বার মনে হচ্ছিল, আমার মা উপস্থিত থাকলে আমার খুব ভালো লাগত। মায়েরও খুব ভালো লাগত। এই অনুষ্ঠান যে কোনো মা দেখলে শুনলেই খুশি হতেন। সন্তানরা মাকে কত ভালোবাসেন, কতভাবে উপলব্ধি করেন তা মায়েরা শুনতেন। নিজের রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ততায় মায়ের খোঁজখবর অনেক সময় ঠিকমতো নিতে পারেন না বলে ডিমলার ইউএনও কত বিনয় করে অনুষ্ঠানেও মায়ের কাছে ক্ষমা চাচ্ছিলেন।

বাংলাদেশ শিক্ষা পর্যবেক্ষক সোসাইটির চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ এম শরিফুল ইসলাম এবং তানবীর হোসেন আশরাফীও মায়েদের প্রতি পরম শ্রদ্ধামূলক বক্তৃতা করেছেন।

আমি প্রচুর অনুষ্ঠানে যাই। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছিল ওই দিনের অনুষ্ঠান আমার জীবনের সেরা অনুষ্ঠান। মাকে সংবর্ধনা দেওয়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা জগতের যে কোনে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার চেয়ে গর্বের, আনন্দের। মাকে দেওয়া স্মারক মা নিজে গ্রহণ করছেন এটা দেখতে পারলে আরও ভালো লাগত। কিন্তু আমি নিজেই সেই স্মারক গ্রহণ করেছি। সেটিও আনন্দের। এই আনন্দের মধ্যে আর এক বিশাল শূন্যতাও আমার ছিল। আমার বাবা বেঁচে নেই। বাবা যদি এই অনুষ্ঠানে থাকতেন তাহলে পূর্ণতা পেত আমার আনন্দ। সেটা কোনো দিনই আর হওয়ার নয়।

অনেক সময় অনেকেই মায়ের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করেন। মাকে কষ্ট দেন। মা দ্রুতই সেই কষ্ট ভুলে যান। একজন লেখক লিখেছেন-যদি কোনো সন্তান মায়ের প্রসববেদনা এবং জন্মের সময় কষ্টের মাত্রা উপলিব্ধ করতে পারতেন তাহলে কোনো দিন সেই সন্তান মায়ের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে পারতেন না।

আমি নিজেও একজন বাবা। আমার সন্তান আমার স্ত্রীর গর্ভে আসার পর থেকে জন্ম হওয়া পর্যন্ত দেখেছি একজন মাকে কি সীমাহীন কষ্টের মধ্য দিয়ে একজন সন্তান জন্ম দিতে হয়। আমার সন্তান গর্ভে থাকাকালীন আমি সম্পূর্ণ সময় চাকরির কাজ ছাড়া ব্যক্তিগত আর কোনো কাজ করিনি। ওই এক বছর আমার ব্যক্তিগত কাজ বলতে কোনো কাজ ছিল না। প্রতি মুহূর্তে মনে উপলব্ধি করেছি মা কত কষ্টের মাধ্যমে সন্তানের জন্ম দেন। আমার সন্তানের জন্মের সময় আমি উপলিব্ধ করার চেষ্টা করেছি আমার মা আমাকে এমন কষ্ট করেই জন্ম দিয়েছেন। মায়ের প্রতি ভালোবাসা আরও বেড়ে যায়। আমি জ্ঞান হওয়ার পর কোনোদিন মায়ের সঙ্গে এমন কোনো আচরণ করিনি যাতে মা কষ্ট পান। উচ্চস্বরে তার সঙ্গে কথা বলিনি। শুধু এটুকু বুঝলেই হয়-মা কোনো দিন সন্তানের কল্যাণ ছাড়া আর কোনো কিছুই চিন্তা করেন না।

আমি আমার শিক্ষার্থীদের এমন কি পরিচিত অনেককেই সবসময় বলি মা-বাবার সঙ্গে কখনোই যেন তারা রূঢ় আচরণ না করে। নিজের অজান্তে কখনো আচরণে ত্রুটি হলে তা ভালোবাসা দিয়ে সেই ক্ষত পূরণ কতে হবে। ‘মা’র কোনো বিকল্প নেই। মা সব সময়ই মা। সারা জীবন অযুত ত্যাগের ভিতর দিয়ে মা সন্তানকে বড় করে তোলেন। কোনো সন্তান যদি মায়ের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করে দূরে সরে যান, তবুও দূর থেকে মা সেই সন্তানেরও মঙ্গল প্রার্থনা করেন। মা এমনই এক সত্তা। জগতের সব মা ভালো থাকুন।

ড. তুহিন ওয়াদুদ : সহযোগী অধ্যাপক
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর ও পরিচালক, রিভারাইন পিপল।
[email protected]

 
Electronic Paper