ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বন্ধ হোক বন্যপ্রাণী হত্যা

খায়রুল বাশার আশিক
🕐 ১০:১০ অপরাহ্ণ, মে ১৭, ২০১৯

২০১৭ সালের ৯ এপ্রিল, দিনটি ছিল রোববার। বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার সাগরের মোহনায় রুহিতা চরে খুব সকাল বেলা একটি গুলিবিদ্ধ হরিণের মৃতদেহ দেখতে পায় স্থানীয় জনগণ। রুহিতা চরের গ্রামবাসী সকালে এক জেলের কাছে খবর শুনে ওই চরে গিয়ে দেখেন, শরীরের পেছন দিকটায় বন্দুকের গুলি লাগা একটি মৃত চিত্রা হরিণ বালুচরে আটকে আছে। স্থানীয় জনগণ ও বন বিভাগের কর্মকর্তারা সেদিন ধারণা করছিলেন, রুহিতার চরে বলেশ্বর নদীর অপর তীরে সুন্দরবনে হরিণটি কোনো শিকারি দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়ে নদীতে পড়লে ভাসতে ভাসতে এসে ওই চরে আটকা পড়ে।

২০১৮ সালের ১৩ জুলাই, কোস্টগার্ডের সদস্যরা অভিযান চালিয়ে সুন্দরবনের গহিন থেকে আটক করে দুজন হরিণ শিকারিকে। সেদিন পাওয়া যায় লাইসেন্সধারী তিনটি একনলা বন্দুক, একটি নৌকার সঙ্গে তিনটি মৃত হরিণ।

এ বছরের ৩০ জানুয়ারি বুধবারের ঘটনা, গভীর রাতে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বাগেরহাটের মংলা উপজেলাধীন কাগার ভাড়ানী এলাকা থেকে জবাই করা একটি চিত্রল হরিণ উদ্ধার করেছে বন বিভাগ। এ সময় হরিণ শিকারের ফাঁদ, নৌকা, মাছ ধরার পাস (পারমিট) উদ্ধার করা হয়েছিল।

গত ৯ মে বৃহস্পতিবার সুন্দরবনের কাটকা লঞ্চঘাট সংলগ্ন জামে মসজিদের সামনে থেকে চোরা শিকারিদের কাছ থেকে কালো রঙের স্কুলব্যাগের ভেতরে পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় ৫ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার করা করেছে কয়রা থানা-পুলিশ। এ ঘটনাগুলো কেবল উদাহরণ। এভাবেই প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছে হরিণ। সুন্দরবনের হরিণের খবর নিতে গেলে এমন হাজারও ঘটনার উদাহরণ মিলবে।

কথায় আছে ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’ অর্থাৎ হরিণের নিজের শরীরের মাংসই যেন তার নিজের শত্রু। প্রাচীন এই প্রবাদ কথাটি আজ বাস্তব সত্য হরিণকুলের জন্য। সত্যিই, হরিণ নামক প্রাণীটি যদি মানুষের খাবারের উপযোগী না হতো তাহলে কোনো শিকারিই হয়তো হরিণের পেছনে দৌড়াত না। হরিণের মাংসের প্রতি লোভে মুখিয়ে থাকে অনেক ভোজনরসিকরা। লোভী এসব ভোজনরসিকদের চাহিদা মেটাতে সৃষ্টি হয়েছে অর্থলোভী হরিণ পাচারকারী চক্র। এই পাচারকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আর্থিক ফায়দা নিচ্ছে কিছু অসাধু বন কর্মকর্তা। এসব লোভী গোষ্ঠীর লোভের খোরাকে পরিণত হয়ে ঝুঁকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম একটি বন্য শোভাবর্ধক প্রাণী ‘হরিণ’।

বাংলাদেশের সবুজ মানচিত্রে সুন্দরবনই হরিণের সব থেকে বড় উন্মুক্ত বসতি। সুন্দরবন ছাড়াও ভোলার মনপুরা ও নোয়াখালীর নিঝুম দ্বীপ, বরগুনার টেংরাগিরি ও হরিণঘাটা, গাজীপুর, সিলেটের গভীর বনাঞ্চল, চট্টগ্রাম ও বান্দরবনের পাহাড়ি অঞ্চলসহ কিছু কিছু বন অঞ্চলে উন্মুক্ত হরিণ মাঝে মধ্যে চোখে পড়লেও এর সংখ্যা গুটিকয়েক। তবে হরিণ শিকারির চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব হরিণ আর কত দিন তাদের প্রজন্ম বাঁচিয়ে রাখতে পারবে তা একটি বড় প্রশ্ন পরিবেশবিদদের মনে। রাতের আঁধারে তুলনামূলক বাচ্চা বা ছোট হরিণগুলোও রেহাই পাচ্ছে না হরিণ শিকারিদের লোভের ফাঁদ থেকে। এর মধ্যে অবাধ হরিণ শিকারের সুবিধা রয়েছে সুন্দরবনের আওতাধীন অঞ্চলে।

বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, শরণখোলা, মোড়েলগঞ্জ, মংলা, বাগেরহাট, খুলনা, রামপাল, পাইকগাছা, কয়রা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, শ্যামনগরের ও সাউদখালী অঞ্চলে বছরজুড়েই চলে হরিণ শিকারের মহোৎসব। এর মধ্যে সুন্দরবনসংলগ্ন মোড়েলগঞ্জ ও শরণখোলাতেই সবচেয়ে বেশি হরিণ শিকার করা হয়। এর পরের অবস্থানেই রয়েছে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ, ভেটখালী, কৈখালী, যতিন্দ্র নগর, মরাগাং এলাকার গ্রামগুলো। সুন্দরবন অঞ্চলের সাতক্ষীরা রেঞ্জেও যেন সর্বদাই বেপরোয়া অবস্থানে থাকে হরিণ শিকারিরা। এসব এলাকায় বন্য হরিণগুলো বাঘের থাবা থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারলেও শিকারিদের ফাঁদ আর বন্দুকের গুলি থেকে রেহাই পাচ্ছে না।

হরিণ শিকার সুন্দরবন অঞ্চলে একটি আর্থিক লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। কারণ, খুব সহজেই হরিণের মাংস বিক্রির গ্রাহক পাওয়া যায়। হরিণের চামড়া উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়। এর মাথা ও শিং ঘরের দেয়ালে শোভা পায় কারুপণ্য হিসেবে। ফলে মাথা ও শিং উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে। এর মাংস ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরেও কিনতে দ্বিধাবোধ করে না ভোজনবিলাসীরা।

হরিণ শিকারিদের রয়েছে একটি চক্র ও বিশাল সিন্ডিকেট, এই চক্রে আছে এলাকার প্রভাবশালীরা। রয়েছে কিছু গডফাদারও, হরিণ শিকারিরা আটক হলে তাদের আইন-আদালত করে মুক্ত করে আনার সব দায়িত্বও নেন এসব গডফাদার। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা ও কথিত জনপ্রতিনিধিরা রয়েছে চক্রের পাওয়ার পয়েন্টের ভূমিকায়। সুন্দরবন শরণখোলা রেঞ্জের একাধিক গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে দেখা যায়, এসব বিষয়ে সুন্দরবনসংলগ্ন গ্রামবাসীরা যেন মুখ খুলতেই রাজি নয়। আর যারা একটু আধটু মুখ খুলছে তারা গোপনে তথ্য দিলেও নাম প্রকাশে রাজি হয় না। যার ফলে সুনির্দিষ্ট প্রমাণের অভাবে সংবাদ মাধ্যমগুলোও নাম প্রকাশ করতে পারছে না সেসব গড ফাদারের।

প্রতিবছর রাশ পূর্ণিমার সময় সুন্দরবন ঘিরে চলে হরিণ নিধনের মহোৎসব। রাশ পূর্ণিমায় অনুষ্ঠিত মেলাকে কেন্দ্র করে হরিণ নিধন যেন একটি বড় সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় শিকারিদের। রাশমেলা শুরু হওয়ার ৮-১০ দিন আগেই বন রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে হরিণ শিকারিরা প্রবেশ করে বনের অভ্যন্তরে। এ সময় তারা মাছ ও কাঁকড়া ধরার পারমিট নিয়ে বনের মধ্যে প্রবেশ করে ফাঁদের উপকরণ রেখে আসে। ফাঁদের উপকরণ লুকিয়ে রেখে তারা তখন বন থেকে ফিরে আসে। রাশমেলা আরম্ভ হওয়ার সময় তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে এসব শিকারিও মিশে যায়। এ সময় রাশমেলার আনন্দে মেতে থাকা দর্শনার্থী ও নিরাপত্তা কর্মীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আগেই রেখে আসা সেসব ফাঁদ দিয়েই শুরু করে হরিণ নিধন।

একটি পর্যবেক্ষণে ও গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আওতাধীন সুন্দরবনের ১৪ লাখ ৯০ হাজার একরের বন্য সীমারেখায় ২২ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ১১৬টি প্রজাতির স্তন্যপায়ী ও ১৪৩ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণীর অস্তিত্ব রয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় প্রাণীর তালিকার শীর্ষে রাখা হয়েছে মায়াবী প্রাণী চিত্রল হরিণকে।

সাধারণ গ্রামবাসীরা মনে করেন, হরিণের চোরা কারবারি ও মাংস ব্যবসায়ীদের নামের তালিকা পুলিশ বা প্রশাসনের নিকট থাকলেও সেসব শিকারির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয় না প্রশাসন। এসব শিকারি ও মাংস ব্যবসায়ীরা বনবিভাগ ও থানা প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে প্রশাসন দেখেও যেন না দেখার ভাণ করে যাচ্ছে।

আর সচেতন মহলের দাবি, বনবিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে সুন্দরবনের অভয়ারণ্যে চোরা শিকারি ও জেলে বাওয়ালিদের সুযোগ করে দেওয়ার ফলে সুন্দরবনের হরিণ আজ হুমকির মুখে। তবে বনবিভাগের দাবি, শিকারিদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান সর্বদা চলমান থাকে। আর উৎকোচ গ্রহণের বিষয়টি একেবারে মিথ্যা।

শুধুই কি শিকার? শিকারিদের কালো থাবা ছাড়াও নানা কারণে হুমকির মুখে পড়ছে হরিণের বংশবিস্তার। আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট খাদ্য ঘাটতি, বনাঞ্চলের আয়তন কমে যাওয়া এবং চিত্রা হরিণের প্রধান খাদ্য কেওড়া পাতা লবণাক্ততার কারণে দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাওয়ার ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে হরিণের বংশবিস্তার। ইতোমধ্যেই কুমির ও বাঘের আক্রমণ, ঝড় জলোচ্ছ্বাস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বনভূমি উজাড়সহ অনেক কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে পৃথিবী থেকে প্রায় বিলুপ্ত হওয়া মায়াবী চিত্রল হরিণ।

বাংলাদেশের স্বার্থে সুন্দরবন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় এখনই উদ্যোগী না হলে আগামীর সুন্দরবন থেকে বাঘের মতোই বিলুপ্তির পথে যেতে পারে হরিণ নামক প্রাণীটিও। এ বিষয়ে সরকারের কঠোর অবস্থানের পাশাপাশি জনমহলে সচেতনতা সৃষ্টি জরুরি বলে মনে করছেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। বন্ধ হোক বন্যপ্রাণী হত্যা। প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেঁচে থাকুক হরিণসহ প্রতিটি প্রাণী।

খায়রুল বাশার আশিক : সাংবাদিক
[email protected]

 
Electronic Paper