ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ধানক্ষেতের আগুন সবার বুকে

আবু বকর সিদ্দীক
🕐 ৯:২৬ অপরাহ্ণ, মে ১৪, ২০১৯

সন্তানের মমতায় লালন করা ফসল এখন কৃষকের গলার কাঁটা। যোগ-বিয়োগের হিসাবে তা অর্থহীন, টেনে নিচ্ছে ক্ষতির দিকে। ভেতরের ঝলসানো কষ্ট রুখে দিতে কৃষক পাকা ধানে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। সামনে ঝুলে আছে এনজিওর ঋণ, ছেলেমেয়ের নতুন কাপড়ের বায়না, সংসার চালানোর দায়। পাকা ফসল মাঠেই নষ্ট হলে এবার আত্মহত্যা করা ছাড়া কৃষকের উপায় থাকবে না বলে মনে হয়।

সরকারের বেঁধে দেওয়া ধানের দামে সার-পানির খরচও জোটে না, তার ওপর শ্রমিকের মূল্য আকাশচুম্বী। ধান কাটার এ মৌসুমে কৃষি শ্রমিকদের মজুরির হিসাবটা রাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা পর্যায়ে। দেশ এগিয়েছে। ডিজিটাল তকমা লাগিয়ে ধেই ধেই করে জুটেছে উন্নয়নশীলের সম্মান। কিন্তু আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষিক্ষেত্র আজও সেই আঁতুর ঘরে। সেখানে গরু লাঙল টানার দায় থেকে মুক্তি পেয়েছে, পশুটি এখন দামি খাবারের তালিকায়। যান্ত্রিক পাওয়ার টিলার জমি চাষের সহজ উপায় এনে দিয়েছে, আসেনি ফসল ঘরে তোলার নিশ্চয়তা। প্রযুক্তির কল্যাণে জমি থেকে ফসল তোলার নানা যন্ত্র আমরা দেখতে পাই মনিটরে কিন্তু বাস্তবে এখানে তা অধরা। ফলে এখানে কৃষককে নির্ভর করতে হয় শ্রমিকের ওপর।

পেশা বদলের হিড়িকে গ্রামের কৃষি শ্রমিকরাও জোয়ারে ভেসে আসে শহরে। নদীভাঙন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও কর্ম না থাকায় একসময়ের কৃষি শ্রমিকরা শহুরে শ্রমজীবী। জাদুর শহরে তারাও ভাগ্যের পেছনে ছুটছে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা ফসল তুলে আনার ক্ষেত্রে এখনো কৃষি শ্রমিকই ভরসা। সেখানে প্রযুক্তির ছোঁয়া এখনো লাগেনি।

কৃষক এ দেশে ছোট জাত বা গালি হিসেবেই বিবেচিত। শ্রমিকের ঘামে তৈরি বহুতলা ভবনে তাদের প্রবেশাধিকার থাকে না, দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তির এ কারিগরদেরও কোনো সম্মান নেই, বাঁচার নিশ্চয়তাও ক্ষীণ। শেকড়ের বন্ধন আলগা হলে ওপরের উৎসব ফানুসের সঙ্গে মিশে যাবে। উৎপাদনের মূল চালিকাশক্তি কৃষককে বিপদে ফেলে আলো ঝলমলে উন্নয়ন আশা করা সম্ভব নয়।

ঘাম ঝরিয়ে কৃষক ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী ও রাজনীতির বরপুত্ররা সে ফসলকে ঘিরেই লুটে নিচ্ছেন কাড়ি কাড়ি টাকা। কুষ্টিয়ার কলা যেভাবে ঢাকায় চারগুণ দামে বিক্রি হয় তেমনি চাঁদপুরের সবজির শরীরেও দামের উত্তাপ থাকে ঢাকায় আসার পরে, সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যায় সবকিছু।

অন্যদিকে প্রান্তিক কৃষকের ফসল সংরক্ষণের কোনো উপায় নেই। ফসলকে ঘিরেই তাদের যাবতীয় চাহিদা পূরণ করতে হয়। বীজ-সার এমনকি সেচের পানিও নিতে হয় বাকিতে। ফসল তোলার সঙ্গে সঙ্গে তা পরিশোধ করতে হয়। এ সুযোগটাই নিয়ে আসছে বর্গীরা। মৌসুমি ফসলের মধ্যে রবিশস্যের বাইরে পিয়াজ ও আলু নিয়ে কৃষক সব থেকে বেশি সমস্যায় পড়ে। পৃথিবীর কোনো নিয়মেই যা পড়ে না, তা দেখা যায় এ সময়ে। মাঠ থেকে যখন পিয়াজ কৃষকের ঘরে আসে তখন তার দাম কমে যায়।

বহুগুণে কমে তা তলানিতে ঠেকে, ফড়িয়ারা তা কিনে গুদামজাত করে। মাথার ওপর ঋণ নিয়ে কৃষক চোখে-মুখে অন্ধকার দেখে, চাহিদা পূরণে বাধ্য হয়ে ৫-৭ টাকা কেজিতে পিয়াজ বিক্রি করে দেয়। অথচ মাস তিনেকের ব্যবধানে এই পিয়াজ ৫-৭ টাকায় এক পোয়াও পাওয়া যায় না। ঘাম ঝরিয়ে আবাদ করা নিজের ফসলের ভালোগুলো বিক্রির জন্য রাখে কৃষক, যেগুলো নষ্ট হয়, দ্রুত পচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তা নিজের বাড়িতে রাখে পরিবারের খাওয়ার জন্য। সেগুলো মাস তিনেকের মধ্যে শেষ হলে বাজারের ব্যাগে সেই কৃষককেই আবার কিনতে হয়। তখন খুব অচেনা লাগে নিজের উৎপাদিত পিয়াজকে। ঝাপসা চোখে হাড্ডিসার কৃষক দেখে, তার শ্রমে বেড়ে ওঠা ফসল কীভাবে টাকাওয়ালা মহাজনীদের ভুঁড়ি বাড়াচ্ছে।

আলুর দাম নিয়ে তেলেসমাতি কারবার গণমাধ্যমের কল্যাণে সবার চেনা। এখানেও মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপট। জেলা পর্যায়ের রাজপথে আলু ছিটিয়ে উদাসমুখে কৃষক প্রতিবাদ করে। যে ফসল ঘিরে একটি পরিবারে গড়ে ওঠে রঙিন স্বপ্ন, তা ধূসর হয়। মাটিতে মিশে যায় শ্রম-ঘামের সব আয়োজন। সাধারণ সময়ে আলু ২৫ টাকার কম না কিন্তু মৌসুমে তা নেওয়ার লোক নেই। দাম বলতে ২-৩ টাকা কেজি। মাঠ-উঠোন এবং বাজার পর্যন্ত টেনে আনার ভাড়াও জোটে না, বাধ্য হয়ে আলুর বস্তা রাস্তায় ঢেলে দেয় কৃষক।

দাম কম, ধান কাটার শ্রমিক নেই। টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামের কৃষক আব্দুল মালেক শিকদার রাগে-ক্ষোভে পাকা ধানে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। সে আগুন মিডিয়ার কল্যাণে ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। প্রতিবাদটি প্রতীকী হলেও এর মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে আমাদের রাষ্ট্রীয় দেউলিয়াত্বের নোংরা চিত্র।

মেঠোপথ থেকে ক্ষোভের আগুন পৌঁছে গেছে রাজধানীতেও। গত সোমবার বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে কৃষক বাঁচাতে আন্দোলন করেছে। সামনের সড়কে ধান ছিটিয়ে তারা ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের দাবি করেছে। যৌক্তিকভাবে তারা তুলে ধরেছে কৃষকের বর্তমান অবস্থার কথা।

কৃষকের এ খবরে নড়েচড়ে বসছে সবাই। মিডিয়ার কল্যাণে তাদের দুরবস্থার কথা জানছে বিশ্ব। গার্মেন্ট শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া পূরণ হচ্ছে, রপ্তানি খাতের গুরুত্বপূর্ণ পোশাকশিল্পের শ্রমজীবীরা অধিকার ফিরে পাচ্ছেন। কিন্তু দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছে কৃষি খাত। উৎপাদনবিমুখ হয়ে শুধু আমদানিনির্ভর হলে উগান্ডার অভাব আর ভেনেজুয়েলার মুদ্রাস্ফীতি চেপে বসবে প্রিয় স্বদেশের বুকে। আমদানি কমিয়ে ধুঁকতে থাকা চিনি ও পাটকলগুলো বাঁচাতে হবে। অবিলম্বে বীজ-সার-কীটনাশক ও জ্বালানির দাম কমিয়ে কৃষি উৎপাদন সহনশীল খরচের মধ্যে আনতে হবে। একই সঙ্গে উৎপাদিত ফসলের বিক্রি ও ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।

কৃষি ও কৃষকের সঙ্গে আমাদের নাড়ির সম্পর্ক। রাষ্ট্র যদি দুই-চারটি ফ্লাইওভার, মহাকাশের স্যাটেলাইট আর চকচকে রাস্তাঘাট নিয়ে পাকস্থলীর ক্ষুধা নিবারণের স্বপ্ন দেখে তা হবে বোকার স্বর্গে বাস করা। মানুষের চাপা ক্ষোভ বাড়তে থাকলে তা সবকিছু পুড়িয়ে দেবে।

বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের ফাইল থেকে কোটি কোটি টাকা গায়েব হয়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আয়েশি রুমে বসে কলমের খোঁচায় অর্জিত কাড়ি কাড়ি টাকা এক-শ্রেণির মানুষের বিদেশে আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা হয়। তারা বাথরুমে ব্যবহারের পানিও আনেন দেশের বাইরে থেকে। বায়ুত্যাগে সমস্যা হলে অথবা সর্দি-জ্বরের ভাব হলেও চলে যান সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক। এসব উচ্চমার্গীয়দের কাছে কৃষকের বাঁচা-মরা কিছু যায় আসে না।

একমাত্র কৃষিকাজে কোনো ঘুষ, দুর্নীতি ও ফাঁকি চলে না। প্রকৃতি নিয়ম মানে, কঠোর নিয়মের বাইরে তার কাছ থেকেও কিছু আশা করা যায় না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নানা গবেষণা করে ফসলের আকার বাড়িয়েছে, বাড়িয়েছে উৎপাদনের মাত্রা কিন্তু সময় কমাতে পারেনি। ১০ মাস ১০ দিন হিসেবে মাটির নির্যাসও মেনে চলে অক্ষরে অক্ষরে। নিয়মিত যত্ন না নিলে, কাজে ফাঁকি দিয়ে ঠিকমতো সার-কীটনাশক বিনিয়োগ না করলে ফসল ফলবে না। এখানে ক্ষমতার প্রভাব, ঘুষ, দুর্নীতি চলে না। আবার অনুরোধ, আবদারও রাখে না। সদ্য লাগানো কলাগাছের পায়ে পড়ে হাজার কান্নাকাটি করলেও সে রাতারাতি এক কাঁদি কলা দেবে না। আবার অভাব পূরণে সে একবারে দুই কাঁদি করেও ফলাবে না।

কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। উৎপাদনের মূল চালিকাশক্তি এ কর্মবীরদের যেন হতাশায় গিলে না ফেলে। সর্বোচ্চ খারাপ কিছু ঘটার আগেই রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা, নার্স তানিয়াকে ধর্ষণ শেষে হত্যার মতোই জঘণ্য কিছু হবে যদি কোনো কৃষক ফসলের সামনে আত্মহত্যা করে।

আবু বকর সিদ্দীক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
[email protected]

 
Electronic Paper