মানবাধিকার কমিশন : সাক্ষীগোপাল?
চিররঞ্জন সরকার
🕐 ৯:১৮ অপরাহ্ণ, জুন ১৯, ২০১৮
বাংলাদেশে অবৈধ মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিহতের সংখ্যা ১২০ জন ছাড়িয়ে গেছে। গত ৪ মে থেকে শুরু হওয়া এই অভিযানে কোনো নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন কি-না, তার নিশ্চয়তা কীভাবে দেওয়া হচ্ছে? না, এর কোনো যথাযথ ব্যাখ্যা নেই।
এ ব্যাপারে কারও কোনো ব্যাখ্যা নেই। রোমের মানুষ যখন পুড়ছিলেন, তখন নাকি নিরোর বেহালা-বাদন শোনা গিয়েছিল। দেশের মানুষ যখন মরছে, তখন আমাদের মানবাধিকার কমিশন কী করছে? একটি বিবৃতি দিয়েছে! মাদকবিরোধী অভিযানে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
গত ২২ মে কমিশন চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক স্বাক্ষরিত চিঠিতে জানানো হয়, মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনার সময় অভিযুক্ত আসামি, সন্দেহভাজন ব্যক্তিসহ সবার মানবাধিকার বিষয়টি যাতে যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয় এবং সংবিধান বর্ণিত অধিকার যেন সুরক্ষিত থাকে।
সে বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করে মানবাধিকার কমিশন।
এছাড়া মাদক নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও দৃঢ়ভাবে কাজ করার অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে। যে অভিযানে প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে, নিহতের স্বজনরা কান্নার রোল তুলছে, কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনাগুলোর সত্যতা নিয়ে জনমনে প্রবল সন্দেহ জাগছে, তখন মানবাধিকার কমিশনের এই ভূমিকা সত্যিই হতাশাব্যঞ্জক।
অবশ্য কমিশন কিছু করবে না, এটাই যেন প্রত্যাশিত। এই ধারণা শুধু মানবাধিকার কমিশন নিয়েই নয়। দেশের প্রচলিত সব সংস্থা নিয়েই। মানবাধিকার কমিশন, থানা, পুলিশ, প্রশাসন, বিচারালয়সহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ভাবমূর্তি হারাতে বসেছে।
দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন কিংবা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে।
বর্তমানে একটি দেশ কতটা সভ্য ও উন্নত, সেটা মানবাধিকারের মাপকাঠিতে মাপা হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটি রাষ্ট্র কতখানি গ্রহণযোগ্য ও সম্মানের পাত্র হবে- সেটা নির্ভর করে সেই রাষ্ট্রের মানবাধিকারের মর্যাদার ওপরে। একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র ‘যেমন ইচ্ছে তেমন আচরণ’ কখনই করতে
পারে না।
মানবাধিকার সব সময়ই একটি মানদণ্ড হিসেবে আবির্ভূত হয়। তাই মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা এবং বাস্তবে মানবাধিকার প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন করা প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক আইনগত একটি দায়িত্বে রূপান্তরিত হয়েছে। যে কোনো নাগরিকের মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। একজন নাগরিকের উন্নত জীবন এবং মর্যাদাসম্পন্ন জীবনের জন্য যে নিরঙ্কুশ স্বপ্ন-সংগ্রাম, সেই সংগ্রামের ভেতরে মানবাধিকার একমাত্র মাধ্যম এবং অস্ত্র। একজন অসহায় ব্যক্তিও সেটি ব্যবহার করতে পারে। তার মর্যাদার জায়গাটিকে সুরক্ষিত রাখতে পারে।
মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সংবিধানের নির্দেশে গঠিত হয়েছে স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য। সরকারের ওপর, বিশেষত পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য, নাগরিকের মর্যাদা এবং অধিকার সুরক্ষিত রাখার জন্য সর্বদা সক্রিয় ও তৎপর থাকবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো, এটাই প্রত্যাশিত। আমাদের সমাজে অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতা অতি প্রবল, অর্থনীতিতে প্রবল সামন্ততন্ত্র।
এই শক্তিগুলোই পরিচালনা করে রাষ্ট্রশক্তিকে। ফলে সরকার মানুষের মর্যাদা রক্ষায় অতি-উৎসাহী, পুলিশ ও প্রশাসন দরিদ্র ও প্রান্তবাসীর প্রতি সহানুভূতিতে আর্দ্র, এমন দাবি করা কঠিন। এই কারণেই গণতান্ত্রিক দেশে সরকার ও সমাজের কোপ থেকে দরিদ্র, নারী, সংখ্যালঘু, দলিত-আদিবাসী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন ও মর্যাদা বাঁচাতে কমিশন গঠন করতে হয়েছে। কিন্তু এই কমিশন যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। নেতা-মন্ত্রীরা নানা উপায়ে বিভিন্ন কমিশনকে কুক্ষিগত করতে চেয়েছেন। আর কমিশনের সফলতা নির্ভর করছে কমিশনের সদস্যদের ওপর। সব চাপ পরাহত করে কমিশনের দায়িত্ব পালন করেছেন, এমন কমিশন-সদস্যের দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে।
প্রশ্ন হলো, তাহলে আর এই দেশে এমন কমিশন থাকার মানে কী? ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘনের মুখে কমিশনের সদস্যরা সাক্ষীগোপাল সেজে থাকবেন, আর দেশবাসী বিনা প্রশ্নে তাদের সেলামি জোগাবেন, এই কি প্রত্যাশা?
অভ্যাস জিজ্ঞাসার পরম শত্রু। মানুষ যাতে অভ্যস্ত হয়, তার সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে ভুলে যায়। যা আছে, তাকেই বিনা প্রশ্নে, বিনা তর্কে স্বাভাবিক, অমোঘ, এমনকি শাশ্বত বলে ধরে নেয়। মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে আমাদের সহাবস্থান খুব বেশি দিন আগের নয়। বিশ্বের নানা দেশে অবশ্য এ ধরনের কমিশন দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ ঘোষণা, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন গঠন এবং দেশে দেশে ও ক্রমশ নানা দেশে নিজস্ব মানবাধিকার কমিশনের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে এই ধারণা ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, মানবাধিকার রক্ষার জন্য এই প্রতিষ্ঠান থাকা আবশ্যক। অথচ, দেশের আইনে ব্যক্তির অধিকার যাতে সুরক্ষিত থাকে, অধিকার ভঙ্গ করলে যাতে অপরাধীকে শাসনে আনা হয় এবং অপরাধ প্রমাণিত হলে তাকে শাস্তি দেওয়া হয়, তার জন্যই শাসনতন্ত্রের বিশদ আয়োজন। আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ এবং বিচার বিভাগ- এই তিনটি স্তম্ভের ওপর সেই তন্ত্র দাঁড়িয়ে আছে। সুতরাং এই প্রশ্ন আদৌ অযৌক্তিক নয় যে, এর পরেও কেন আবার মানবাধিকার কমিশনের প্রয়োজন? একটি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার অর্থ প্রতিষ্ঠানটিকে এককথায় অপ্রয়োজনীয় বলে সাব্যস্ত করা নয়। কিন্তু প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের প্রশ্নটি যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করা জরুরি।
অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায়, আমাদের মানবাধিকার কমিশনের ইতিহাস গৌরবময় নয়, বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান এবং বক্তৃতা ছাড়া তাকে কাজের কাজ করতে খুব একটা দেখা যায়নি।
এর আগে ড. মিজানুর রহমান খান কমিশনের দায়িত্ব গ্রহণের পরে সেই ইতিহাসে সামান্য পরিবর্তন এসেছিল। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন ঘটনায় তিনি তৎপর ও কার্যকর নজরদারির ভূমিকা পালন করছিলেন, বিশেষত সরকারি প্রশাসন ও পুলিশের অন্যায়কে চিহ্নিত করে প্রতিকারের জন্য নৈতিক চাপ সৃষ্টি করছিলেন। তিনি মানবাধিকার কমিশনের জন্য কিছু ‘দাঁত’ও চেয়েছিলেন। কিন্তু সরকার তার বক্তব্যকে খুব একটা পাত্তা দেয়নি। আসলে সরকার চায় একটা বশংবদ মানবাধিকার কমিশন। অতীত জমানাতেও চেয়েছে, বর্তমান জমানাতেও চাইছে।
যুক্তি মহাশূন্যে ভেসে থাকতে পারে না, তাকে বাস্তবের কঠিন ভূমিতে পথ কেটে চলতে হয়। একটি আদর্শ সংবিধানে মানবাধিকার কমিশনের প্রয়োজন নেই এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পরেও যুক্তিকে আদর্শের মহাশূন্য থেকে কঠিন বাস্তবে নামতে হয়। সেই বাস্তব পৃথিবীতে সংবিধানের রক্ষকরা নাগরিকের অধিকার রক্ষার পরিবর্তে প্রায়শই অধিকার হরণে তৎপর। এই ব্যাধি কালজয়ী। দলজয়ীও।
যখন যে দল ক্ষমতায় যায়, তখন তারা পুলিশ-প্রশাসন-মানবাধিকার কমিশন, নির্বাচন কমিশন ইত্যাদিকে নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে চায়। এটা ক্ষমতার ব্যাধি। মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠান এই ব্যাধির প্রতিষেধক স্বরূপ। সেখানেই তার গণতান্ত্রিক গুরুত্ব। ব্যাধি নির্মূল হলে ওষুধের আর প্রয়োজন থাকবে না। কিন্তু ক্ষমতার ব্যাধি দুর্জয়।
চিররঞ্জন সরকার : লেখক, কলামিস্ট।
[email protected]