ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

চিকিৎসা নিয়ে রাজনীতি নয়

প্রভাষ আমিন
🕐 ৭:৫০ অপরাহ্ণ, জুন ১৮, ২০১৮

বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া চার মাসেরও বেশি সময় ধরে কারাগারে আছেন। বিদেশ থেকে এতিমদের জন্য আসা টাকা নয়-ছয় করার দায়ে আদালত তাকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি পুরনো ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে একমাত্র বন্দি হিসেবে দিনযাপন করছেন। ৭২ বছর বয়সী বেগম খালেদা জিয়া আগে থেকেই নানান শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন।
কারাগারে যাওয়ার পর তা নিশ্চয়ই তাকে ভোগাচ্ছে। এই সময়ে একবার নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত ৫ জুন তিনি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন বলে খবর বেরিয়েছে। দুদিন পর তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা কারাগারে গিয়ে বেগম জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তারা বেরিয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বেগম জিয়ার একটি মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে। ঝুঁকি আছে বড় স্ট্রোকেরও।
তারপর থেকেই সরকার বেগম জিয়াকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু বেগম জিয়া সেখানে যেতে রাজি নন। পরে সরকার তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। তাতেও তিনি সম্মত হননি। বিএনপির পক্ষ থেকে বেগম জিয়াকে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। প্রয়োজনে দলের পক্ষ থেকে চিকিৎসা ব্যয় বহনেরও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। দুপক্ষের টানাটানিতে বিলম্বিত হচ্ছে বেগম জিয়ার অতি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা।
বেগম জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে সরকার ও বিএনপির টানাপড়েনের ঘটনায় অনেকেই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কোথায় হবে সেটার চেয়ে কত দ্রুত তাকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব, সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বেগম জিয়ার ডাক্তারদের দাবি যদি সত্যি হয়, তাহলে বেগম জিয়ার মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে ৫ জুন। ১৪ জুন যখন এই লেখা লিখছি, তখন ৯ দিন পেরিয়ে গেছে। এই বিলম্ব খুবই শঙ্কার, উদ্বেগের। ৭২ বছর বয়সী একজন মানুষের এ ধরনের সমস্যার ক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা দেওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ।
দেশের সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রী অর্থ নয়-ছয় করার অভিযোগে দণ্ডিত হয়েছেন, এটা সবার জন্যই লজ্জার। এই ঘটনাটি না ঘটলে বা মিথ্যা হলেই আমরা সবাই খুশি হতাম। কিন্তু আদালত দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষেই তার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। আইনি প্রক্রিয়ায় বেগম জিয়ার জামিন হলেও আমরা স্বস্তি পেতাম। কিন্তু কেন তার সাজা হয়েছে, কেন তার জামিন হয়নি; তা সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার।
আমরা মুক্তি চাইতে পারি, কিন্তু দেওয়া না দেওয়া আদালতের বিবেচনা। বেগম জিয়ার আইনজীবীরাও নিশ্চয়ই চেষ্টা করেছেন। কিন্তু জামিন হয়নি। সর্বশেষ যা পরিস্থিতি তাতে ঈদে বেগম জিয়াকে কারাগারেই থাকতে হয়েছে। কারাগারে থাকা না থাকা আদালতের বিচার্য। তবে তার দ্রুত ও যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া অবশ্যই সরকারের দায়িত্ব। এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে সরকারকে দায় দেওয়ার মতো কিছু হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় দেশের একমাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
শুধু দেশের নয়, বিদেশেও ‘সেন্টার অব অ্যাক্সেলেন্স’ হিসেবে বিএসএমএমইউর সুনাম আছে। বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসা বিষয়ে সবচেয়ে আস্থার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বেগম জিয়ার আস্থা নেই। এর আগে যখন তাকে সেখানে নেওয়া হয়েছিল, তখনকার ব্যবস্থাপনায় তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। না হওয়ারই কথা। বেগম জিয়া হাসপাতালে আসবেন বলে সেদিন কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। তারপরও গণমাধ্যম কর্মীদের ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে নিরাপত্তা কর্মীদের।
সেই অব্যবস্থাপনার চাপে বেগম জিয়া অসন্তুষ্ট হতেই পারেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পর দেশের সেরা হাসাপাতাল সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল-সিএমএইচ। এখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার নেই। সাধারণত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাই সিএমএইচে চিকিৎসা সেবা পান।
তারপরও দেশের বিভিন্ন সংকট সময়ে সিএমএইচ গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে। রাশেদ খান মেনন, হুমায়ুন আজাদ, সর্বশেষ মুহাম্মদ জাফর ইকবাল দুর্বৃত্তের হামলায় আহত হওয়ার পর চিকিৎসা নিয়েছেন সিএমএইচে। তারা সবাই সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন। তবে সিএমএইচ সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানার কথা সাবেক সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ারই। তিনি কেন সিএমসএইচে যেতে চাইছেন না, সেটা বোঝা মুশকিল। ইউনাইটেড হাসপাতালে আয়েশটা হয়তো বেশি হবে। কিন্তু ইউনাইটেডের চিকিৎসা সুবিধা বিএসএমএমইউ বা সিএমএইচের চেয়ে ভালো; এটা আমার মনে হয় না।
শুধু চিকিৎসা সুবিধা নয়, নিরাপত্তা বিবেচনায়ও বেগম জিয়ার চিকিৎসায় সিএমএইচ হতে পারে সেরা হাসপাতাল। কারণ বেগম জিয়াকে সিএমএইচে নেওয়া হলে গণমাধ্যম কর্মীরা জাহাঙ্গীর গেটের পর আর যেতে পারবেন না। কাভার করতে, তথ্য পেতে আমাদের অনেক অসুবিধা হবে, তবুও বেগম জিয়ার চিকিৎসা সুবিধা নির্বিঘ্ন করতে সিএমএইচের ভালো কোনো বিকল্প নেই। সাংবাদিকরা যেমন যেতে পারবেন না, দলীয় নেতাকর্মীরাও সিএমএইচের ধারেকাছে যেতে পারবেন না।
আমার ধারণা এ কারণেই বিএনপি ইউানাইটেড হাসপাতালেই দলের চেয়ারপারসনের চিকিৎসার ব্যাপারে গোঁ ধরে আছেন। কিন্তু এখানে চিকিৎসাটা গুরুত্বপূর্ণ, রাজনীতিটা নয়। বিএনপির এই অনড় অবস্থান খালেদা জিয়ার চিকিৎসাকেই বিলম্বিত করছে। বেগম জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে রাজনীতি কারও জন্যই শুভ নয়। তাই দাবি করছি অবিলম্বে বেগম জিয়ার যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক।
কারাবন্দিদের চিকিৎসা নিয়ে জেল কোডে কী আছে জানি না। সাধারণত কারাবন্দিদের চিকিৎসা সরকারি হাসপাতালেই হয়। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালে হতে পারবে না, এমন কথা নেই। আমরা অতীতে দেখেছি, কারাবন্দি অনেককেই স্কয়ার বা বারডেমের মতো হাসাপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তাই বেগম জিয়াকে ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া যাবে না, এমন কোনো কথা নেই। তবে নিরপত্তা বিবেচনায় আমার পছন্দ সিএমএইচই।
তারপরও আশা করি বেগম জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে কোনো পক্ষই অনড় থাকবেন না। এটা রাজনীতির বিষয় নয়। সরকারের প্রতি অনুরোধ, প্রয়োজনে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে ইউনাইটেডেই পাঠানো হোক। তবু আর যেন দেরি না হয়। বিএনপির প্রতি অনুরোধ, তারা যেন বেগম জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে রাজনীতি বা দর কষাকষি না করে। অবিলম্বে চিকিৎসা হোক; সেটা সিএমএইচ বা ইউনাইটেড যেখানেই হোক।

প্রভাষ আমিন : সাংবাদিক, কলাম লেখক।

 
Electronic Paper