ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মাঠে-ঘাটে-বাটে

সাতক্ষীরা দর্শন

ড. তুহিন ওয়াদুদ
🕐 ১০:১৩ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২০, ২০১৯

আমার এক সহকর্মী উমর ফারুক সাত ভাইবোন মিলে বাবা-মায়ের নামে ‘মনু-জরি’ ফাউন্ডেশন গঠন করেছেন। প্রতিবছর এ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সুবিধাবঞ্চিত এবং মেধাবীদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে মেধা উৎসব, গুণীজন সংবর্ধনা, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বেশ কিছুদিন আগে উমর ফারুকের আমন্ত্রণে সেই অনুষ্ঠানে তার বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলায় গিয়েছিলাম।

সাতক্ষীরা বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোর একটি। এখানকার জীবন অনেকটা কষ্টের। আবহাওয়া রুক্ষ। সম্পূর্ণ জেলায় সড়কের খুবই বেহালদশা। সড়কের এতটা বেহাল অবস্থা বাংলাদেশের আর কোথাও আছে কি না সন্দেহ। রেল যোগাযোগও নেই।

খুলনা বিভাগের সবচেয়ে দরিদ্র জেলা সাতক্ষীরা। এখানে মঙ্গা দূরীকরণ কর্মসূচি আছে। সাইন বোর্ডে লক্ষ্য করলাম ‘পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন’ (পিকেএসএফ) এর সহযোগিতায় জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন বাস্তবায়ন করছে ‘মঙ্গা নিরসনে সমন্বিত উদ্যোগ (সংযোগ)’। সাতক্ষীরায় অনেক মাটির ঘর। মাটির ঘরগুলোতে গোলপাতার ছাউনি।

চিংড়ি চাষ এখানকার প্রধান অর্থকরী সম্পদে পরিণত হয়েছে। আশির দশক থেকে বাণিজ্যিকভিত্তিতে সাতক্ষীরায় প্রচুর পরিমাণ চিংড়ি চাষ হচ্ছে। চিংড়ি চাষে যদি ভাইরাস আক্রমণ করে তাহলে অনেক লোকসান গুনতে হয়। প্রথমে চিংড়ি বিক্রি হয় স্থানীয় বাজারে। আশাশুনির মহিষকুড় মৎস্য শেডের মালিক নওরোজ মিয়া বলছিলেন- ‘কোনো কোনো শেডে আমরা শতকরা ২ টাকা নিই, কোনো শেডে ৩-৪ টাকাও নিই।’

স্থানীয় বাজারে মাছ ক্রেতা মনিরুজ্জামান বলছিলেন- ‘আমরা ব্যাপারীরা এখানে মাছ কিনে খুলনায় বিদেশে রপ্তানিকারী কোম্পানির কাছে বিক্রি করি। খুলনা থেকে কোম্পানি চিংড়ি বিদেশে পাঠায়।’ গলদা চিংড়ির দাম সবচেয়ে বেশি। স্থানীয় বাজারেই এ চিংড়ির কেজি প্রায় ৭শ থেকে ১ হাজার টাকা।

বিদেশে এ চিংড়ির খুব কদর। তবে চিংড়ি চাষে ধানচাষের জমি কমে যাচ্ছে, সবুজ বিপন্ন হচ্ছে, প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। চিংড়ির পাশাপাশি এখন অনেকেই কাঁকড়াও বাণিজ্যিকভিত্তিতে চাষ করছেন। কাঁকড়ার হ্যাচারি করা হয়েছে সাতক্ষীরায়।

সাতক্ষীরায় জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক ছিল অনেক। বিএনপি-জামায়াতের অসহযোগ আন্দোলনে তাণ্ডবের রাজ্যে পরিণত হয়েছিল এই জেলা। স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী শিক্ষার হার কম থাকায় অনেকে অজ্ঞতাজনিত কারণে জামায়াতে ইসলামী করে। প্রকাশ্যে এখন আর কোনো পুরুষ জামায়াত-শিবির করে না। অনেকে জানালেন, জামায়াতের মহিলা কর্মীরা গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন বেশ ধরে জামায়াতের প্রচারণার কাজ করে যাচ্ছে। জামায়াতের কার্যক্রম বন্ধের ব্যাপারে সাবেক এসপি মনজুরুল কবিরের ভূমিকার অনেকেই প্রশংসা করছিলেন। সাতক্ষীরার মানুষের পানির ভীষণ কষ্ট। টিউবওয়েল তিন-চারশ ফুট গভীর না করলে এখানে খাওয়ার উপযোগী পানি পাওয়া যায় না। টিউবওয়েলে খুব কষ্ট করে চাপ দিয়ে পানি ওঠাতে হয়। শ্যামনগর উপজেলার সম্পদ নামের একজন বলছিলেন- ‘আমরা পুকুরের পানি ফিল্টার করে খাই।’

সাতক্ষীরার জোয়ার-ভাটাজনিত কারণে সমুদ্র থেকে উঠে আসা লোনা পানিতে কিছু কিছু নদী বেঁচে আছে। সুন্দরবন ঘেঁষে খোলপেটুয়া অনেক বড় নদী। আইলার সময়ে এ নদী ভয়াল মূর্তি ধারণ করেছিল। এখনো আইলাদুর্গতরা নিজেদের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারেননি। কালিগঞ্জের কাকশিয়ালী, শ্যামনগরের চুনা ও মালঞ্চ নদীতে যথেষ্ট পানি আছে। আশাশুনির মরিচ্চাপ নদীর অবস্থা মৃতপ্রায়। নদী দখলও চলছে। নদীর মাঝখানে বাড়িও করছেন কেউ কেউ।

স্থানীয় বাসিন্দা পুলিশ সুপার আবু বকর সিদ্দিক বলছিলেন- ‘এক সময় অনেক কষ্ট করে আমাদের এ নদী পার হতে হতো। অনেক পানি থাকত। এখন আর সেই নদী নেই।’ উজানের সব নদীর পানি কমে যাওয়ার কারণে নদীর পানির চাপ সমুদ্রের ওপর পড়ছে। ফলে নোনা পানি দিনের পর দিন উজানের দিকে উঠে আসছে। জোয়ার-ভাটার সঙ্গে উপকূলীয় জীবনও সম্পর্কিত। যে অনুষ্ঠানে সাতক্ষীরায় গিয়েছি সেখানে সাউন্ড সিস্টেম আসতে দেরি হচ্ছিল। আয়োজক উমর ফারুক বলছিলেন- ‘জোয়ার আসতে আরও খানিকটা সময় লাগবে। জোয়ার হলে নদীর ওপার থেকে নৌকায় সাউন্ড সিস্টেম আসবে।’

ভাঙা সড়ক ধরে ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেলে সুন্দরবন দেখতে গিয়েছিলাম শ্যামনগরের নীল ডুমুরিয়ার কলাগাছি। বনবিভাগ কার্যালয় দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য ট্রলারের ভাড়া নিজেদের কার্যালয়ে টাঙিয়ে রেখেছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, সুন্দরবনের নিকটবর্তী জনগণ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে অনেকটাই অন্ধকারে। সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হলে তাদের স্বচ্ছ ধারণা থাকাটা খুবই জরুরি। সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ রামপাল প্রসঙ্গের চেয়ে হরিণের মাংস প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতেই বেশি আগ্রহী। প্রায়ই হরিণের মাংস সেখানে পাওয়া যায়। ৫শ টাকা কেজি। খেতে চাইলেই তারা ব্যবস্থা করে দিতে পারেন।

সাতক্ষীরা থেকে প্রচুর হিন্দু জনগণ ভারতে স্থায়ীভাবে চলে যাচ্ছে। আশাশুনির নাকতাড়া গ্রামের খগেন্দ্রনাথ সরকার বলছিলেন- ‘দেশভাগের পর হিন্দুদের ভারতে যাওয়া শুরু। এখনো কিছু কিছু হিন্দু ভারতে যায়।’ কারও অত্যাচারে ছেড়ে যাচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন- ‘কারও অত্যাচারে নয়। অনেকের আত্মীয় আছে, অনেকে কাজের আশায় যায়। অনেক মুসলমানও কাজের আশায় ভারতে যায়।’ খগেন্দ্রনাথ সরকারেরও এক ছেলে ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।

সাতক্ষীরায় ‘ভোমরা’ নামের একটি স্থলবন্দর রয়েছে। এ বন্দর দিয়ে অনেক পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়। হিমসাগর-ল্যাংড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির আম মৌসুমের শুরুতেই পাকে। সাতক্ষীরার দুজন ক্রিকেটার মুস্তাফিজুর রহমান এবং সৌম্য সরকারকে নিয়ে তাদের গর্বের শেষ নেই। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন এবং বাংলাদেশ জাতীয় ভলিবল দলের অধিনায়ক সাঈদ আল জাবীরের বাড়িও এ জেলায়।

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হকের উদ্যোগে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সাতক্ষীরার যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত করা প্রয়োজন। সড়কের বেহাল অবস্থার কারণে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন পর্যটকদের নিরুৎসাহিত করছে। সাতক্ষীরায় ভাড়ায় যে মোটরসাইকেল পাওয়া যায় তাও চলার উপযোগী নয় ওখানকার সড়কে। জামায়াতপ্রবণতা দূর করার জন্য গ্রামে গ্রামে সাধারণ মানুষের মধ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরাও জরুরি। সরকার দৃষ্টি দিলে অল্প সময়েই সাতক্ষীরার অবহেলা আর উপেক্ষা দূর হতে পারে।

ড. তুহিন ওয়াদুদ : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
[email protected]

 
Electronic Paper