ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষীরা এখনও বড় পদে : ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী

কাজল রশীদ শাহীন
🕐 ৯:৫৯ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৮, ২০১৯

ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, একাত্তরের উত্তাল সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা, শিক্ষক সমিতি কর্তৃক স্বাধীনতার প্রস্তাবনা, মুজিব বাহিনী, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, বাকশাল, ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে বলেছেন খোলা কাগজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কাজল রশীদ শাহীন

একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ কেমন দেখছেন?
একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশ নিয়ে অতিমাত্রায় চিন্তিত ছিলাম। কী করব, কী করা উচিত-এসব ভেবে মনটা খুব দুর্বল হয়ে যেত। বিশেষ করে ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর। দেশটা উলট-পালট হয়ে গেল, সঙ্গে নিজের জীবনটাও। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হলো, জেলে দেওয়ার জন্য পরিকল্পনাও হলো। অগত্যা দেশ ছেড়ে চলে গেলাম। সেই থেকে অনেকদিন দেশের বাইরে ছিলাম। যখন দেখলাম পরিবেশ কিছুটা অনুকূল, তখন ফিরে এলাম। যদিও বিদেশে ভালো চাকরি করতাম, উপার্জনও ছিল প্রচুর। ঘরে এসি, বাইরে এসি, গাড়িতে এসি। বাজারে গেলে এক সের মাংস নয়, আস্ত খাসি কিনে নিয়ে আসতাম।

কোন দেশে ছিলেন?
নাইজেরিয়াতে। ওখানকার চাকরিতে বেতন খুব বেশি ছিল। অর্ধেক দিয়ে খাওয়া-পরা, বাকি অর্ধেক রেমিট করতে পারতাম। সে জন্য দেশে যখন চলে আসি, বেশ কিছু টাকা-পয়সা নিয়ে এসেছিলাম।

কেন চলে এসেছিলেন?
চলে আসার একটা ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। প্রতি রাতেই অদ্ভুত এক ধরনের স্বপ্ন দেখতাম-আমার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বা আমার পরামর্শে যারা মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে নিহত হয়েছে, তারা স্বপ্নে আসত। এসে বলত, আমি তো বেড়াতে গিয়েছিলাম, আরেকজন বলত, অসুস্থ হয়েছিলাম, তাই একটু ট্রিটমেন্টের জন্য গিয়েছিলাম। আরেকজন এসে হয়তো বলত, আমি তো মরিনি, শুধু শুধু তোমরা ভাবছো যে আমি মরে গেছি। এসব দেখে আমি ঘুমের মধ্যে চিৎকার দিয়ে উঠতাম। ব্যাপারটা আমার ওপর প্রভাব বিস্তার করল। এক দিন হঠাৎ করেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রিজাইন দিয়ে দিলাম। ভাইস চ্যান্সেলর তো অবাক, অনুরোধ করলেন, থেকে যাও, তোমাকে আমরা সিটিজেনশিপ দেব। কিন্তু আমি থাকলাম না। এটা ১৯৮৪ সালের কথা।

বাংলাদেশে এসে কী করলেন?
তখন তো দেশের দুরবস্থা। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে অথচ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে কেউই কিছু করছে না। কিন্তু আমরা তো জানি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না নড়লে সারা দেশ নড়ে না। তো অগত্যা আমিই প্রথম উদ্যোগ নিলাম। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের জন্য একটি সেমিনার করলাম। লক্ষ করলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন যারা বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত, তারা তখন সাহসী ভূমিকা পালন করেননি, কেউ এগিয়ে দিলে হয়তো তারা এগুতেন।

আপনি তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকাবস্থাতেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন...
হ্যাঁ, এটা আমার জন্য একটা গর্বের বিষয়। আমি আরেকটা বিষয় নিয়ে গর্ব অনুভব করি, সেটা হলো-বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ। তার সঙ্গে একটা ছবিও আছে আমার। এ দেশে অনেক ভাইস চ্যান্সেলর আছে, সামনে আরও অনেকেই হবে, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ এবং তার সঙ্গে ছবি আছে খুব কমজনেরই। আরও একটি গর্বের বিষয় আছে-৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতার যে প্রস্তাব আনা হলো, সেটা নিয়ে আমিই মুভ করেছিলাম। আমরা শিক্ষকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বেলা ১১টায়, ছাত্ররা নিয়েছিল বিকালে। প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর ঘোষণা আকারে বলা হলো। সে জন্য তামাশা করে আমরা বলে থাকি, জিয়াউর রহমান যদি ২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে থাকে, তাহলে তো ৩ তারিখেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলাম আমরা।

আপনারা কারা কারা ওই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। আমরা সেদিন মিটিং করেছিলাম বটতলায়, যা শিক্ষক সমিতি আর কখনো করেনি। তবে তার আগে ২৮ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু এরকম একটা নির্দেশনা আমাদের দিয়েছিলেন।

নির্দেশনাটা কি ঘরোয়াভাবে দিয়েছিলেন নাকি অফিসিয়ালি?
ঘরোয়াভাবে তো বটেই কিন্তু অন্যভাবে এটাকে অফিসিয়ালিই বলতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে মনি ভাই আমাদের সঙ্গেই থাকতেন। এক দিন তিনি বললেন, চল, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে আসি। আমরা দেখা করতে গেলাম। সাক্ষাতের শুরুতেই তিনি বললেন, এমন কোনো সেনাপতি দেখেছো, যে একটি গুলিও খরচ না করে যুদ্ধে জয়ী হয়? আমি তখন তামাশা করে বললাম, সেনাপতি বোধহয় আমাদের সামনেই হাজির আছে। উনি হো হো করে হেসে দিলেন। একপর্যায়ে বললেন, রক্তারক্তি আর এড়ানো গেল না বোধহয়। তোমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে কিছু একটা করো। সে অনুযায়ী, ৩ মার্চেই আমি শিক্ষকদের হাজির থাকতে বললাম।

শিক্ষক সমিতির এ সিদ্ধান্তটি সেভাবে প্রচারে আসেনি কেন?
তখন আসলে কোনো কিছুই ওভাবে প্রচার পায়নি। ছাত্ররাও তো স্বাধীনতার প্রস্তাব দিয়েছে, সেটা নিয়েও তখন খুব একটা আলোচনা হয়নি। পতাকা যে উত্তোলিত হয়েছে, সে কথাও তো ফরমালি আসেনি। পরবর্তী সময়ে আমরা বলেছি বলে লোকজন এসব লিখেছে। সম্প্রতি কারও কারও লেখায় শিক্ষক সমিতির মিটিংয়ের কথা এসেছে। অন্তত দু’তিন জায়গায় আমি দেখেছি। টিক্কা খানের বইতে আছে, আমেনা মহসিনের একটা লেখাতে আছে। এ ছাড়া রফিকুল ইসলাম চৌধুরীর লেখাতেও দেখলাম।

তা ছাড়া ওইদিনের মিটিংয়ের একটা ছবিও ছিল কিন্তু ছবিটা সংগ্রহে রাখতে পারিনি। অবজারভার আমাদের সঙ্গে বেইমানি করেছিল-শিক্ষকদের এই প্রস্তাবনা নিয়ে ‘স্টপ এনার্কি’ শিরোনামে একটা সংবাদ করেছিল। সেখানে বঙ্গবন্ধুকেও দায়ী করা হয়েছিল এনার্কির জন্য। সে কারণে আমরা অর্গানাইজ করে অবজারভার পত্রিকা পুড়িয়ে দিয়েছিলাম। যাই হোক, একপর্যায়ে আমাকে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। বলা হলো, তুমি বাইরের হালচাল দেখে আস। আমরা যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দিই তাহলে লোকজন আমাদের সঙ্গে কতটুকু থাকবে।

বঙ্গবন্ধুই আপনাকে বাইরে পাঠালেন?
সরাসরি না। বঙ্গবন্ধুর ভায়া হয়ে মনি ভাই দায়িত্বটা দিলেন। বঙ্গবন্ধু সব সময় সব নির্দেশ দিতেন না বা দিতে পারতেন না। তো আমি তখন কুমিল্লা এবং নোয়াখালীর দায়িত্ব নিয়ে চলে গেলাম।

সীমান্ত অতিক্রম করলেন কখন?
প্রথমবারের মতো সীমান্ত অতিক্রম করলাম ৭ এপ্রিল। ভাবছিলাম ভারতে গেলে অন্তত কিছু আর্মস পাব, কিন্তু পেলাম না। ভারত গণতান্ত্রিক দেশ তো, চাইলেই ওদের কাছ থেকে সবকিছু পাওয়া যায় না। বেশ কিছুদিন এভাবে কাটল। তখন আমরা কয়েকজন মিলে ‘সাপ্তাহিক বাংলাদেশ’ নামে একটা পত্রিকা প্রকাশ করলাম। আমার এলাকার লোকজন যখন জানল যে আমি যুদ্ধে গেছি, তখন তারাও তাদের সন্তানদের যুদ্ধে যেতে উৎসাহ দিলেন। আমি মায়ের একমাত্র ছেলে উপরন্তু আমার মা বিধবা হয়েছে আমার বয়স যখন পাঁচ বছর। তো এলাকার মায়েরা সন্তানদের বলতেন, ‘ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মায়ের একটা মাত্র ছেলে। সে যদি যুদ্ধে যেতে পারে, তাহলে তোমরা বাড়িতে বসে খাবার ধ্বংস করছো কেন?’ এমন কথা অনেকটা হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো কাজ করেছে।

যুদ্ধের জন্য সবাই বেরিয়ে পড়েছে। বিভিন্ন সময় তাদের অনেকে আহত নিহত হয়েছে। যারা পরবর্তী সময়ে আমার স্বপ্নে আসতো। মজার বিষয় হলো, এই ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়ে গেল ১৯৯২ সালে যখন আমরা গণআদালত করলাম এবং গোলাম আযমের ফাঁসি দিলাম। আমি ছিলাম ওটার সদস্য সচিব অর্থাৎ সেকেন্ড ইন কমান্ড।

ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি?
ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি হচ্ছে জাতীয় সমন্বয় কমিটির একটি কমিটি। একাত্তরটা বডি নিয়ে জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়েছিল। পুরো নাম হচ্ছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’। এত বড় নাম উচ্চারণ করতে সমস্যা, তাই নাম দেওয়া হয়েছে সমন্বয় কমিটি। এখন এটার ফায়দা নিচ্ছে শাহরিয়াররা। ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি বলতে এখন লোকজন, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, রাজনীতিক-অরাজনীতিক, সবাই তাদেরই বোঝে। শাহরিয়াররাও বলে যে ওরাই নাকি সব করেছে। কয়েক দিন আগে দেখলাম শাহরিয়াররা এক বিদেশি রাইটারকে ডিকটেট করছে-ঘাতক-দালাল কমিটির অধীনে নাকি গণআদালত হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা মিথ্যা কথা। পরে অবশ্য শাহরিয়ার তার এ মন্তব্য নিয়ে একটা ব্যাখ্যাও দিয়েছে। সে বলেছে, গণআদালত আসলে করেছে সমন্বয় কমিটি। শাহরিয়ারকে তখন সেখানে যেতেই দিত না ছাত্রলীগের একটি অংশ। তো যাই হোক, ওই গণআদালতের পর দেখা গেল আমি আর দুঃস্বপ্ন দেখছি না। আমার কাছে মনে হলো, যাক একটা তৃপ্তিদায়ক কাজ তো করলাম।

ভারতে গিয়ে পত্রিকা প্রকাশের পর কী করলেন?
রিক্রুটমেন্ট শুরু করলাম। অনেককেই ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠালাম। প্রয়োজন পড়ল অস্ত্রের, অর্থের। বাংলাদেশ সরকার সরাসরি আমাদের কিছু দেয়নি। আমাদের নিজেদের মধ্যে কারও কারও কাছে ছিল, সেটা দিয়েই ম্যানেজ করার চেষ্টা করলাম।

মুজিব বাহিনীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী ছিল?
আমি আমার সাপ্তাহিক বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করছি। এমন সময় এক দিন মনি ভাই বললেন, মুজিব বাহিনীর টাকা-পয়সা তো আমার হাতে রাখতে চাচ্ছি না, এটা তুমি হ্যান্ডেল করো। মুজিব বাহিনীর ট্রেজারার ছিলেন ইলিয়াস চৌধুরী। একসময় সিদ্ধান্ত হলো, তিনি চলে যাবেন। তখন ওই দায়িত্বটা আমাকে দেওয়া হলো। ইলিয়াস চৌধুরী ছিলেন মুজিব বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড। তাই দায়িত্ব নেওয়ার পর অটোমেটিক্যালি আমি ওই অবস্থানে চলে গেলাম। আমাদের সেক্টরে রব ও মাখন ছিল। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর ওরা তখন ছাত্র, সে হিসেবে মনি ভাই আমাকে একটু অন্যরকম মর্যাদা দিতেন।

একসময় মুজিব বাহিনী সিদ্ধান্ত নিল, জায়গা দখল করে এককভাবে তারা সরকার প্রতিষ্ঠা করবেন। সে জন্য মনি ভাই পাবর্ত্য চট্টগ্রামের দিকে অভিযানে রওনা হলেন। আমাকে বানিয়ে দিয়ে গেলেন সেক্টর প্রধান। এটা আমার জন্য একটা সৌভাগ্য। যৌথবাহিনীর সঙ্গে মুজিব বাহিনীর একটা সমন্বয় হয়েছিল, আমি ছিলাম তার সমন্বয়ক।

আপনার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি?
একসময় দেশে ফিরে এলাম। এসে দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার চাকরি নেই। আমাকে কোনোভাবেই চাকরি ফেরত দেবে না। মোজাফফর আহমদ তখন ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব নিলেন। উনি বললেন, আপনি নতুন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিন। আমি বললাম, নতুন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়ার তাৎপর্যটা আপনি বুঝতে পারছেন? তিনি বললেন, না। আমি বললাম, লোকজন ভাববে, আমি বন্দুক ঠেকিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছি, কোনো মস্তিষ্ক বা বিদ্যাযোগ নেই। তো এমন সব ত্যাগের ভেতর দিয়ে গেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ।

এখন তো নতুন নতুন লোক গজাচ্ছে, যাদের কোনোদিন দেখিনি। তারাই এখন বড় বড় যোদ্ধা। সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তারা লুটে খাওয়া শুরু করেছেন। আর এসব দেখে দেখে আমাদের কেবল মন ভাঙছে।

আপনার চাকরি ফিরিয়ে না দেওয়ার যুক্তি কী ছিল?
উনি বললেন, সাজ্জাদ হোসাইন আপনার চাকরি খেয়ে দিয়েছে সুতরাং আমার কিছু করার নেই। আমি বললাম, সাজ্জাদ হোসাইন তো আপনার চাকরিটাও খেয়েছিল, তাহলে আপনি ভাইস চ্যান্সেলর হলেন কীভাবে? এমন কথায় উনি খুব রেগে গেলেন। আমিও কাগজপত্র ছুড়ে দিয়ে চলে আসি। মনি ভাই জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছি। বললাম, বাড়ি চলে যাচ্ছি, আর কোনোদিন ঢাকা শহরে আসব না। তিনি আমাকে বারণ করলেন।

কিছুক্ষণ পরেই মোজাফফর চৌধুরীর কাছ থেকে ডাক পেলাম। তিনি বললেন, আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করলাম আর আপনি বঙ্গবন্ধুর কাছে অভিযোগ করে বসলেন! আমি বললাম, আমি তা করিনি। উনি বললেন, আপনি মিথ্যা বলছেন। আমার তখন মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল। যাই হোক, অবশেষ আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় যোগদান করলাম। আসলে টাকা-পয়সার খুব অভাব ছিল তখন। ’৭৩-এ স্কলারশিপ পেয়ে বিদেশে চলে গেলাম। দেশে এলাম ’৭৫-এ।

’৭৫-এ কোন সময় এলেন?
৩১ জুলাই। দেশে এসে দেখলাম বাকশাল হয়েছে। তো বাকশাল সম্পর্কে আমার তখন যে প্রেডিকশন ছিল, ইনফ্যাক্ট ইট হ্যাজ হ্যাপেন্ড দ্যাট ওয়ে। কারণ বাকশালের ব্যাপারে মনি ভাই প্রভাবান্বিত করেছিলেন সবচেয়ে বেশি। কমিউনিস্ট পার্টির লোকরাও প্রভাবান্বিত করেছিলেন। বঙ্গমাতাও এর স্বপক্ষে ছিলেন না, ছিলেন না পরিবারের অনেকেই।

বাকশাল তাহলে মূলত কার ব্রেনচাইল্ড?
মূলত, সিরাজুল আলম খানই প্রথম উদ্যোগটা নিয়েছিলেন। ’৭২ সালে সিরাজুল আলম খান আমাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলেন একদলীয় শাসন প্রবর্তন করার জন্য। বঙ্গবন্ধু এমন ঠাটানি দিলেন, সিরাজুল আলম খান আর দাঁড়াতে পারলেন না। আমাকে অবশ্য কিছু বললেন না, কারণ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। শিক্ষকদের উনি অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। যাই হোক, সিরাজ ভাই সুবিধা করতে পারেননি। আমার ধারণা, পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন মনি ভাইকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে কনভিন্স করেছে। কারণ বাকশালের ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকাটা পালন করেছেন মনি ভাই।

তত দিনে সিরাজুল আলম খান তো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নেই...
আপাতদৃষ্টিতে দূরে সরে গেছেন দেখা গেলেও তলে তলে সম্পর্ক ছিল। প্রায় সময় উনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতেন। বঙ্গবন্ধুরও নির্দেশ ছিল সিরাজকে অ্যারেস্ট করা যাবে না।

সিরাজুল ইসলাম ও শেখ মনির সম্পর্কটা কেমন ছিল?
সিরাজ ভাই আর মনি ভাইয়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে উইন ওভার করার একটা প্রতিযোগিতা ছিল। ভাগ্নে মামাকে উইন ওভার করবে না সিরাজুল আলম খান বঙ্গবন্ধুকে উইন ওভার করবে? যে করতে পারবেন তিনিই হবেন বঙ্গবন্ধুর সেকেন্ড ইন কমান্ড। এই প্রশ্ন যুদ্ধের সময়ও ছিল। ক্যাম্পগুলোতে এ নিয়ে মারামারিও হয়েছে। বঙ্গবন্ধুও দুজনকেই কাজে লাগিয়েছিলেন। সিরাজুল আলম খানকে দিয়ে গঠন করালেন ‘নিউক্লিয়াস’ এবং ভাগ্নেকে দিয়ে করালেন বিএলএফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট)। শেষ পর্যন্ত দুজনেই বঙ্গবন্ধুর লোক। তাদের মধ্যে কে দুই নম্বরে দাঁড়াবে-এই সংঘাত বাংলাদেশকে অনেক দূর নিয়ে গেছে, বাংলাদেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে।

আপনি কি সরাসরি রাজনীতি করতেন?
ছাত্ররাজনীতি করতাম। খুব অ্যাকটিভ ছিলাম। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন আমাকে একবার পুলিশ গুলি করেছিল। রাজ্জাক ভাই ধাক্কা দিয়ে না ফেলে দিলে তো আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারতাম না। ওইদিনের কথা ভাবলে আমার এখনো শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। আমি পিকেটিং করছিলাম, গাছের গুঁড়ি দিয়ে পুলিশের গাড়ি পিটাচ্ছিলাম, বাস পুড়িয়ে দিয়েছিলাম। সে সময় যে আসুরিক শক্তি ছিল আমাদের, এখন আর তা কল্পনাই করতে পারি না। দোয়েল চত্বরে আমরা হাতেগোনা কয়েকজন মিলে দুটি বাস উল্টে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলাম। এখনো একজন ওই ঘটনার সাক্ষী আছে সে হলো সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম।

দীর্ঘ সময় পরে হলেও রাজাকারদের ফাঁসি দেওয়া হলো-এ বিষয়ে আপনার অনুভূতি কী?
অবশ্যই ভালো অনুভূতি। আমি লিখেছিও। আমি তো আসলে কখনো লিখতাম না। আমাকে একজন জিজ্ঞাসা করল, আপনি কখন লেখেন। আমি বললাম, রেগে গেলে। আমি লেখালেখি শুরু করলাম বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর। যখন দেখলাম, ২১ বছর ধরে বঙ্গবন্ধুকে নিকৃষ্টভাবে ব্যবচ্ছেদ করা হলো, মুক্তিযোদ্ধাদের নাম-গন্ধ মুছে ফেলার পাঁয়তারা চলল, তখন আমি আস্তে আস্তে লেখালেখি শুরু করলাম। কিন্তু আমার মেজর কাজ ছিল গণআদালত করা। এভাবে কাজ করতে গিয়ে বারবার জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে স্টেনগান চেপে ধরা হয়েছিল। শরীরের এমন কোনো জায়গা ছিল না যে আর্মস টাচ করেনি।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?
আমি নেত্রীর খুব কাছাকাছি ছিলাম এবং সম্ভবত এখনো আছি। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি তার কাছে খুব একটা যাই না। স্বাভাবিকভাবেই উনি খুব ব্যস্ত থাকেন সেহেতু তাই ওমুখো হই না। ইদানীং ভাবছি, দুটি বই লিখেছি তো, বই দুটি গিয়ে দিয়ে আসব। নির্বাচিত হওয়ার পরে আমি একবার গিয়েছিলাম। দেখা-সাক্ষাৎ হলো, কথা হলো। শুধু নেত্রীর না, আমি ছাত্রলীগেরও খুব কাছাকাছি ছিলাম। ছাত্রলীগের পুনরুজ্জীবনে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছিলাম প্রক্টর হিসেবে। ছাত্রদল ছাত্রলীগকে জহরুল হক হলে গেট পার হয়ে আসতে দিত না। সেই অবস্থায় আমি ছাত্রলীগকে কার্যক্রম চালাতে ব্যবস্থা করে দিলাম। সুলতান মনসুর যখন ডাকসু ইলেকশন করে আমি তখন প্রক্টর। খুব ভালো ছেলে সুলতান মনসুর। আমি তো মনে করি, আওয়ামী লীগের অ্যাসেট।

আওয়ামী লীগের এমন আরও বহু অ্যাসেট ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। অথচ এখন বড় বড় পদগুলোতে এমন সব লোক বসে আছে, যারা বঙ্গবন্ধুর প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণ করত। একজন শিক্ষাবিদকে চিনি, যিনি বঙ্গবন্ধুর চামড়া তুলে নেওয়ার হুমকি দিতেন। সেসব লোকও এখন খুব ভালো ভালো অবস্থানে চলে এসেছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর সকালবেলা যারা বঙ্গবন্ধুকে বেইমানসহ আরও অনেক কিছু বলেছেন, তারা অনেকে এখন ভালো আছেন। আর আমরা যারা কান্নাকাটি করে রাস্তার নেমে পড়েছিলাম, তারা একই জায়গায় আছি। বিদ্বেষ পোষণকারীরা একেকজন একবার, দুইবার, তিনবার-বারবার হাসিনার কৃপায় ক্ষমতায় এসেছে। এদের চরিত্রের একটা বিশেষ দিক আছে-কনস্ট্যান্টলি খাওয়াতে হয়। না খাওয়ালেই কিন্তু এরা উল্টো কাজ শুরু করবেন। আর আমাদের খাওয়াক আর না খাওয়াক, অভুক্ত রাখুক আর যাই করুক, আমরা যেখানে আছি, সেখানেই আছি।

(আগামীকাল পড়ুন শেষ পর্ব)

 

 
Electronic Paper