ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বাঁচায় নদী, বাঁচাও নদী-৪৩

খনন করলেই কি নদী রক্ষা হবে?

ড. তুহিন ওয়াদুদ
🕐 ৯:১৮ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৭, ২০১৯

বর্তমান সরকার নদীর প্রতি যথেষ্ট আন্তরিকতার পরিচয় দিচ্ছে। অনেক নদী খননের উদ্যোগ নিয়েছে। এরই মধ্যে অনেক নদী খননের কাজ শুরু হয়ে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু খনন করলেই কি নদী রক্ষা হবে?

 

দীর্ঘকাল নদীগুলো অযত্নে বিচিত্র সংকটে পড়েছে। শুধু খনন করেই সংকট থেকে নদী রক্ষা করা সম্ভব নয়। নদীর প্রাণ হচ্ছে এর প্রবাহ। এই প্রবাহ বজায় রাখতে হলে শুধু খননে তা সম্ভব নয়। অনেক নদী আছে যেগুলো বৃষ্টির পানিতে জীবন লাভ করে। বৃষ্টির পানি শুধু নদী বরাবর উপর থেকে যেটুকু আসে সেটুকুতে নদী বাঁচে না, প্রয়োজন নদীসংলগ্ন পাশর্^বতী অঞ্চলের বৃষ্টির পানি। যখন যত্রতত্র সড়ক গড়ে ওঠেনি, তখন নদী থেকে অনেক দূরে বৃষ্টির পানি নেমে আসত নদীর বুকে। এরপর যখন নতুন নতুন সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে, অনেক স্থানে ব্রিজ, কালভার্ট করা হয়েছে। আবার অনেক স্থানে তাও করা হয়নি। পানি নেমে আসার অনেক ছোট ছোট পথে ব্রিজ ছাড়াই সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বৃষ্টির পানি দূরবর্তী স্থান থেকে নদীতে আসার পথে বাধার সৃষ্টি হয়েছে।

এই বাধা শুধু ব্রিজ, কালভার্ট না করে সড়ক নির্মাণের কারণে হয়নি। যে ব্রিজ, কালভার্টগুলো নির্মাণ করা হয়েছে, তার সবকটিতে পানি আসার পথ আর সচল নেই। ছোট ছোট নালাগুলোর মুখে বাধা তৈরি করে মাছ ধরা হয়। আবার প্রচুর অবকাঠামো গড়ে তোলার মাধ্যমেও পানিপ্রবাহের পথ বন্ধ করা হয়েছে।

বৃষ্টির পানি যে স্থানেই পড়ূক না কেন, ভারিবর্ষণে সেই পানি অবশ্যই নদীতে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত রাখতে হবে। নয়তো নদীতে অতীতে যে প্রবাহ ছিল সেই প্রবাহ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না। নদী খনন করা হলে সেই নদীর গভীরতা বৃদ্ধি পাবে। যদি সেখানে প্রবাহ না থাকে তাহলে বর্ষার বৃষ্টিতে দুপাড়ের মাটি ধুয়ে আবারও নদী ভরাট হবে। নদীতে পর্যাপ্ত প্রবাহ থাকলে সেই প্রবাহই নদীর গভীরতা বজায় রাখবে।

যেসব কারণে নদী মারা যাচ্ছে, সেসব কারণ চিহ্নিত করে নদী মৃত্যুর কারণ যদি রোধ করা না যায়, তাহলে নদীকে বাঁচানো যাবে। এ কথা তো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই- অনেক নদীর উৎসমুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যেমন ঘাঘট, বুড়ি তিস্তা (উলিপুর, কুড়িগ্রাম) মানাস, গোদ্ধার, আলাই, চাকিরপশা, পাঁচগাছির ছড়াসহ অনেক নদী আছে যেগুলোর মাঝামাঝি নদীর প্রবাহ বন্ধ করা হয়েছে। এসব নদীর প্রধান প্রবাহই বাধাগ্রস্ত। এ ছাড়াও প্রায় সব নদীই কোনো না কোনোভাবে আগে যেসব অঞ্চলের পানি পেত এখন আর সেই পানি পায় না। ফলে শুধু খনন করে নদীর প্রবাহ আগের অবস্থায় ফেরানো যাবে না।

অনেক নদী আছে যেগুলোতে বর্জ্য ফেলে ফেলে প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। যদি ওই সব নদীতে বর্জ্য ফেলা বন্ধ করা না যায়, তাহলে প্রতি বছর এই নদীগুলো খনন করতে হবে। প্রতি বছর তো নদী খনন করা কোনো সমাধান নয়। এর জন্য নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেলা বন্ধ করাই সমাধান। যেমন রংপুর শহরের বুকের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে শ্যামাসুন্দরী নদী। রংপুর শহরের সমস্ত ময়লা-আবর্জনা ফেলার প্রধানতম স্থান হচ্ছে এই নদী। সিটি করপোরেশন এর পয়োনিষ্কাশনের জন্যও এই নদীকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে এই নদীতে যে পরিমাণ ময়লা আবর্জনা ফেলা হচ্ছে এতে করে নদীটি রক্ষা করা অসম্ভব। শ্যামাসুন্দরী বাঁচাতে হলে শহরের পয়োনিষ্কাশনের জন্য নদী ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। নদীকে ভাগাড় হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। তা না হলে খনন করা হবে কিন্তু এই খননে নদী রক্ষা হবে না। সারা দেশে যত নদীতে এ রকম ময়লা-আবর্জনা ফেলে নদীকে মেরে ফেলা হচ্ছে, সে সব নদীকে রক্ষার জন্য প্রথমত আবর্জনা-ময়লা মুক্ত করতে হবে।

আমাদের নদীগুলো রক্ষা করার জন্য খনন করতে হবে। কিন্তু সেই খননও হওয়া প্রয়োজন বিজ্ঞানসম্মতভাবে। দেশে বর্তমানে যেভাবে নদী খনন করা হচ্ছে তা বিজ্ঞানসম্মতভাবে হচ্ছে না। নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার কোনো ব্যবস্থাও নেই।

সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে নদী খনন করছে। কিন্তু যে কারণে নদীগুলোর অবস্থা করুণ পরিণতির দিকে এগুচ্ছে সেগুলোর প্রতিকার নিয়ে কাজ হচ্ছে না। যে নদীতে প্রতি বছর প্রচুর পলি জমে সেসব নদী খনন করলেই পলি আসা বন্ধ হবে তাও নয়। আবার অনেক নদী খনন করে নদীর পাড়ে মাটি ফেলে পাড় উঁচু করে নদীকে খাল কিংবা নালায় পরিণত করা হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে নদীর পাশর্^বর্তী এলাকা থেকে নদীতে পানি আসা বাধাগ্রস্ত হবে। আবার ওই পাড়ের মাটিতে নদী ভরাট হবে। নদী যখন খনন করে নদীর মাটি নদীতেই ফেলা হচ্ছে তখন নদীর প্রকৃত প্রস্থ কমে নতুন করে সরু রূপ লাভ করছে। অনেক নদীর আবার মাঝখানে সামান্য পরিমাণ খুঁড়ে নদীর মাঝেই মাটি ফেলে এমন অবস্থা তৈরি করা হচ্ছে, যাতে নদীর দুপাশ দখলদাররা ভোগ করতে পারে। এভাবেও নদীর সর্বনাশ করা হচ্ছে। বর্তমানে রংপুর বিভাগে যে নদীগুলো খনন করা হচ্ছে তার অনেকগুলো নদীর অবস্থা এমনই। অন্তত আমি যে কটি নদী সরেজমিন খবর নিয়েছি তার সবকটির অবস্থা অভিন্ন।

অনেক নদী তলদেশ ভরাট হয়ে মানুষের দখলে গেছে। সেসব নদী এখন উদ্ধার করতে হবে। আইনগতভাবে নদীর জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না, নদীর জমি লিজ দেওয়া যাবে না। সেই বিবেচনায় নদীর জমি দখল হলেও উদ্ধার করা সহজ। এর জন্য সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত থাকতে হবে।

আমাদের দেশের নদীগুলোকে বাঁচানোর জন্য যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। শুধু পানি উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন, বরেন্দ্র সেচপ্রকল্প নদী খননের প্রকল্প গ্রহণ করে প্রস্তাবনা দেবে, সরকার সেই প্রকল্প অনুমোদন দিয়ে নদী খনন হবে, এতে নদী রক্ষা হবে না। নদী রক্ষার জন্য সামগ্রিক প্রস্তুতি নেওয়ার সময় এসেছে। সরকার উপলব্ধি করেছে বাংলাদেশকে বাঁচানোর জন্য নদী বাঁচানোর কোনো বিকল্প নেই। সরকারের এত বড় উদ্যোগ প্রকৃত অর্থে বাস্তবায়নের জন্য অবশ্যই নদীর অসুস্থতার কারণগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থাপত্র প্রদান করতে হবে। আবার সব নদীর জন্য সমান ব্যবস্থাপত্র দিলেও হবে না।

নদী প্রযুক্তি কিংবা নদী প্রকৌশল সম্পর্কে জ্ঞাত এমন অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের বস্তুনিষ্ঠ পরামর্শ আমাদের নদীগুলোর জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। যেহেতু আমাদের নদীগুলোর সমস্যা বহুমাত্রিক তাই সমস্ত সমস্যা দূরীকরণের ব্যবস্থাই আমাদের নিতে হবে। যদি শুধু তলদেশ ভরাট হয়েছে বলেই নদীগুলো মৃত্যুপথযাত্রীতে পরিণত হতো তাহলে বিজ্ঞানসম্মত খননই যথেষ্ট হতো। আমাদের নদী এখন বিবিধ সমস্যায় পতিত। তাই প্রকৃত অর্থে নদীর যত্নের জন্য সমস্ত সমস্যা দূর করার কোনো বিকল্প নেই।

ড. তুহিন ওয়াদুদ: সহযোগী অধ্যাপক
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর ও
পরিচালক, রিভারাইন পিপল
[email protected]

 

 
Electronic Paper