বাঁচায় নদী, বাঁচাও নদী
আত্রাইয়ে রাবার ড্যাম কার স্বার্থে
ড. তুহিন ওয়াদুদ
🕐 ১০:১০ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১০, ২০১৯
আমার নিজের তোলা দেড়শ নদীর ছবি নিয়ে দ্বিতীয় প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল ইএসডিও নামের একটি বড় বেসরকারি সংস্থা। প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল গত বছর অক্টোবরে বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ঠাকুরগাঁও জেলা শহরে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বসন্তের প্রথম দিন এই চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
চিত্রপ্রদর্শনীর দিন সকালে রংপুর থেকে সংস্থাটির একটি গাড়িতে ঠাকুরগাঁওয়ের উদ্দেশে রওনা করি। আমার সঙ্গে সংস্থার একজন বড় কর্মকর্তা এবং আমার দুজন শিক্ষার্থী ছিল। গাড়ি যখন দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর পৌঁছায় তখন আমি রাবার ড্যাম দেখতে যাই।
সরেজমিন খবর নিয়ে দেখলাম আত্রাই নদীর একটি শাখা নদী কাঁকড়া। কাঁকড়া নদীর ওপরে আছে রাবার ড্যাম। আত্রাই নদীতে একটি রাবার ড্যাম আছে দিনাজপুর সদর উপজেলা এলাকায়। মার্চে যখন আমি গিয়েছি তখন আত্রাই নদীতেই পানি নেই। সামান্য একটি জলধারা কোনো রকম প্রবাহিত। নদীর তেমন গভীরতাও নেই। পায়ে হেঁটে পার হওয়া যায়। অনেক মেশিনে নদীর বুক থেকে বালু উঠানো হচ্ছে। এই নদীর যে সামান্য পানি কাঁকড়া নদী দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সেটুকুই রাবার ড্যাম দিয়ে আটকানো হয়েছে।
রাবার ড্যামসংলগ্ন বাজারে অনেকের সঙ্গে কথা হয় নদী ও রাবার ড্যাম নিয়ে। রাবার ড্যামের কারণে ড্যামের ভাটিতে একেবারেই শুকিয়ে যায়। স্থানীয়রা বলছেন, আগে এত শুকনো ছিল না নদী। জেলেদের একটি সমিতির কার্যালয় আছে সেখানে। জেলেদের ভাষ্য- আগে যত মাছ ছিল কাঁকড়া নদীতে এখন আর তা নেই। স্থানীয় মুরব্বিদের ভাষ্য অনুযায়ী অতীতে বারো মাস পানি থাকত। নদীর গভীরতাও ছিল অনেক। নদীটি পরিচর্যার অভাবে মরতে বসেছে। তার ওপর যে সামান্য পানি আসে তাও আটকে রাবার ড্যামের পরে যে আরও প্রায় ১৫ কিলোমিটার নদী আছে তাকে মেরে ফেলা হচ্ছে।
আত্রাই নদীর পানি চিরিরবন্দর এলাকায় দুটি খাতে প্রবাহিত হয়। কিছুটা পানি যায় শাখা নদী কাঁকড়ায়, কিছুটা পানি থাকে আত্রাইয়ে। কাঁকড়া নদীর পানি রাবার ড্যামের মাধ্যমে যায় ফসলি জমিতে, আত্রাই নদীর পানিও যায় রাবার ড্যামের মাধ্যমে ফসলি জমিতে। কার্যত নদীকে বাঁচিয়ে রাখার মতো সামান্য পানিও রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই।
রাবার ড্যামে কৃষক যে ব্যাপক লাভবান হচ্ছে তা নয়। রাবার ড্যামে আটকানো পানি একটি খাল খননের মাধ্যমে নেওয়া হয় চিরি নদীতে। চিরি একটি ছোট নদী। এই নদীতে শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকত না। এখন খালের মাধ্যমে আত্রাই নদীর পানি আসে। এই নদী যদি আত্রাই নদীর পানিতে উপচে যেত, তাহলে উপচে যাওয়া নদীর পানিতে চাষাবাদ হতো। চিরি নদী ড্যাম এলাকায় সমতল ভূমির চেয়ে অনেক নিচু। তা ছাড়া আত্রাই নদীতেও এত বেশি পরিমাণ পানি নেই যার দ্বারা চিরি নদী ভরানো যায়। ফলে চিরি নদীর তলানিতে প্রবাহিত হওয়া পানিটুকু কয়েকটি পাম্পের মাধ্যমে উত্তোলন করা হচ্ছে। এই পানিতে জমিতে সেচ দেওয়ার কাজ করছে বরেন্দ্র সেচ প্রকল্প।
বাস্তবতার নিরিখে বলা যায়, আত্রাই নদীর পানিতে যে চাষাবাদ হচ্ছে তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণই বেশি। প্রথমত ক্ষতি হচ্ছে, সামান্য জলপ্রবাহ নিয়ে প্রবাহিত হওয়া একটি নদীর সব পানি যখন উত্তোলন করা হয় তখন নদীটির সর্বনাশ করা হয়। নদী যখন একেবারেই জলশূন্য হয়ে পড়ে তখন বর্ষায় ওই নদীর পাড়ে ভাঙন প্রবণতা বেড়ে যায়। নদীতে যখন পানি থাকে না তখন সংশ্লিষ্ট এলাকার পানির স্তর নিচে নেমে যায়। সারা বছর পানি থাকলে বহু প্রজাতির মাছসহ বিচিত্র প্রাণী বাঁচতে পারে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে জীববৈচিত্র্যের জন্যও হুমকিস্বরূপ হয়ে ওঠে নদী। নদী যখন একেবারেই শুকিয়ে যায় তখন নদীর পাশে যাদের জমি আছে তারা ধীরে ধীরে অনেকেই জমিতে দখলদারি প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে বর্ষায় বৃষ্টিপাত কম হলেও বন্যা ত্বরান্বিত হয়।
আত্রাই নদীতে রাবার ড্যাম দেওয়ার কারণে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষুব্ধ স্বরে বলেছেন- বাংলাদেশ আত্রাই নদীর পানি সরিয়ে নেওয়ার কারণে তাদের লোক পানি পাচ্ছে না। এ কথা ঠিক, আন্তঃসীমান্তীয় নদীতে বাঁধ দিতে হলে ভাটির দেশের সঙ্গে আলোচনা করে নিতে হয়। আত্রাই নদীর প্রশ্নে ভারত কখনো কখনো ভাটির দেশ। বাংলাদেশ সরকার সেই বিবেচনায় যা করছে তা অনুচিত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে তিস্তার পানি একতরফা প্রত্যাহার করার কারণে বাংলাদেশের সামনের দিনগুলোতে ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হতে পারে সেই কথা কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একবারও ভেবেছেন? আর আত্রাই নদীর পানি বাংলাদেশ প্রত্যাহার করে নিয়ে চাষাবাদ করার কারণে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশই বেশি অসুবিধায় পড়ছে। কারণ আত্রাই নদী ভারতে প্রবেশের পর সামান্যতম স্থান অতিক্রম করে আবারও বাংলাদেশেই প্রবেশ করেছে। সেই আত্রাই বাংলাদেশে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছে। ফলে বাংলাদেশ পানি প্রত্যাহার করে চাষাবাদ করার কারণে বালাদেশেরই বেশি অসুবিধা হচ্ছে। বাংলাদেশ যদি পানিটুকু ছেড়ে দেয় তাহলে ভারত সরকার কি এই নিশ্চয়তা দেবে যে তারা আন্তঃনদী সংযাগ প্রকল্পের নামে এই পানি প্রত্যাহার করবে না?
বাংলাদেশ-ভারত যে স্বীকৃত এবং স্বীকৃত ছাড়া মোট শতাধিক আন্তঃসীমান্তীয় নদী আছে তার মধ্যে এক-আধটি বাদ দিলে প্রায় সবগুলোর উৎস ভারত। সুতরাং বাংলাদেশের এমন কোনো দায় পড়েনি প্রায় জলশূন্য একটি নদীর পানি প্রত্যাহার করার মধ্য দিয়ে ভারতের সঙ্গে পানি দখলের প্রতিয়োগিতায় নেমে পড়বে। আর তা ছাড়া বাঙালি জাতিগতভাবে অতীতে কখনই কোনো জাতি কিংবা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি।
বাংলাদেশ-ভারত উভয় সরকার আত্রাই নদী নিয়ে আলোচনায় বসুক, আমরা সেটাই চাই। কথা হোক, বাংলাদেশ পানি ছাড়লে ভারত সেই পানি আটকানোর ব্যবস্থা করবে না। কথা হোক, স্বীকৃত ৫৪টি আন্তঃসীমান্তীয় নদী নিয়ে এবং স্বীকৃতি ছাড়া প্রায় আরও অর্ধশত নদী নিয়ে। বাংলাদেশ-ভারত যে সুসম্পর্ক আছে আমরা সেই সম্পর্কের প্রতিফলন ঘটুক নদী প্রশ্নেও।
শুধু আত্রাই নদী নিয়ে একক কোনো কথা বললে সমস্যার সমাধান হবে না। বাংলাদেশ-ভারত যে যৌথ নদী কমিশন আছে বছরে তাদের ন্যূনতম ৪টি সভা করার কথা থাকলে চার বছরে একটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়না। যৌথ নদী কমিশন নিয়মিত সভা করলেও বাংলাদেশ-ভারত অনেক নদীবিষয়ক সমস্যার সমাধান হতে পারত। সমস্যা ঘনীভূত হোক, মানবতার পরিপন্থী কাজ কোনো সরকার করুক, সেটি আমাদের প্রত্যাশা নয়। উভয় দেশ মানবিক রাষ্ট্র হলে তা উভয় দেশের জন্যই কল্যাণ। নদীর প্রশ্নেও আমরা বাংলাদেশ-ভারতকে মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই।
ড. তুহিন ওয়াদুদ: সহযোগী অধ্যাপক, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর ও
পরিচালক, রিভারাইন পিপল
[email protected]