ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে সভ্যতা
আশেক মাহমুদ
🕐 ১০:১৩ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ০৯, ২০১৯
ব্রেনটন টারান্ট। উগ্রতা, হিংস্রতা, বর্ণবাদী জিঘাংসা ও শ্বেত সন্ত্রাসের এক জঘন্য প্রতীক। গত ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা আধুনিক সভ্যতাকে দাঁড় করিয়েছে কলঙ্কের কাঠগড়ায়। টারান্টের মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণে হতচকিত ৪৯ জন মুসলিম মসজিদে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন, আরও অর্ধশত চরমভাবে আহত হন। এ ঘটনায় আধুনিক সভ্যতা নিঃস্তব্ধ, শোকাহত ও বিমর্ষ হয়ে পড়ে।
এটি কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। ব্রেনটন টারান্ট ঘটনাটি ঘটায় ৭৪ পৃষ্ঠার ইশতেহার প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এই ইশতেহার সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা হয়, এমনকি নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীসহ আরও ৭০ জনের কাছে ই-মেইল করে বার্তা পাঠিয়ে সন্ত্রাসী হামলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্রেনটন টারান্ট। একই প্রকৃতির হামলায় ২০১১ সালে নরওয়েতে নিহত হয় ৭৭ জন। এরপর ২০১৫ সালে সুইডেনে, ২০১৭ সালে কানাডার কুইবেকে, যুক্তরাষ্ট্রের পোর্টল্যান্ডে এমনকি যুক্তরাজ্যের ফিন্সবারি পার্কে একই ধরনের সন্ত্রাসী হামলার মঞ্চায়ন হয়েছিল। কিন্তু এ ধরনের বর্ণবাদী ও উগ্র-জাতীয়তাবাদী হামলার পুনরাবৃত্তি আধুনিক সভ্যতাকে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি করছে।
কেন আধুনিক সভ্যতা এভাবে লোমহর্ষক ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছে? বন্য দশা থেকে বর্বর দশা, সেই বর্বর দশা থেকে আমরা নাকি হাজার বছর ধরে সভ্যতার উৎকর্ষতায় সমাসীন হয়েছি। শুধু তা-ই নয়, আধুনিক সমাজবিজ্ঞানী, দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের তত্ত্বে এ কথা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে, আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতা আমাদের উপহার দিয়ে চলছে এক উন্নত মানবিক বিশ্ব। আধুনিকতাকে এমনই আকর্ষণীয় করে তুলে ধরা হয়েছে যে, সমাজবিজ্ঞানী টেলকট পারসন্স পাশ্চাত্য আমেরিকান সমাজকে দেখিয়েছেন এক উন্নত ভারসাম্যপূর্ণ সমাজরূপে।
জনপ্রিয় দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জ্যাক রুশো জোর দিয়ে বলেছেন, গণমানুষের সাধারণ ইচ্ছা পূরণে পপুলার গণতন্ত্রই হবে একমাত্র আদর্শ। আরও একধাপ এগিয়ে ফ্রান্সিস ফুকোয়ামা লিখেছেন, পাশ্চাত্যের বহুমুখী গণতন্ত্র চর্চা ইতিহাসের পরিসমাপ্তি রচনা করেছে। এর মানে, ফুকোয়ামার দৃষ্টিতে, আধুনিক পাশ্চাত্য এমন এক মানবিক বিশ্ব নির্মাণ করেছে যা পুরো মানবজাতির জন্য সার্বজনীন আদর্শ হয়ে থাকবে। এ ধরনের কথার সঙ্গে বাস্তবতার যে বিরাট ঘাটতি রয়েছে তা চলমান ঘটনাবলিতে স্পষ্ট।
মানবজাতির ইতিহাস যে শুধু অর্থনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডে সীমাবদ্ধ নয় তা স্পষ্ট করে দেয় চলমান ঘটনাগুলো। অ্যান্থনি গ্রামসিও উল্লেখ করেছেন, সমাজের উন্নয়ন বা পরিবর্তন বাধাগ্রস্ত করে দিচ্ছে আধিপত্যশীল ভাবাদর্শ। হিটলার নিজেই জাতীয়তাবাদী উগ্র ভাবাদর্শকে আধিপত্য বিস্তারের অন্যতম হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করতেন। একালে ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই একই ধরনের জাতীয়তাবাদী আদর্শকে সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের অন্যতম অস্ত্র মনে করেন। সে কারণে টারান্টের লেখায় ট্রাম্পের প্রশংসা করা হয়।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে বিশ্বময় প্রতিষ্ঠা করতে মার্কিন ঘরানার শক্তিগুলো সমাজতন্ত্র ও ধর্মকে যখন বাধা হিসেবে দেখেছে তখনই আবির্ভূত হয় হান্টিংটনের মতাদর্শ। হান্টিংটন তার লেখায় তুলে ধরেন, পাশ্চাত্যের দীর্ঘকালের সভ্যতা দিন দিন ক্ষয়িষ্ণু হতে চলেছে; যার মূল কারণ, ইসলামের শক্তিরূপে আবির্ভাব। হান্টিংটন ইসলামকে পাশ্চাত্যের শত্রুরূপে দেখাতে গিয়ে পাশ্চাত্যের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক ক্রোধ, আক্রোশ বাড়িয়ে তোলেন। সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্যের প্রচারমাধ্যমগুলো ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয় অনেক বেশি মিথ্যা প্রপাগান্ডার মধ্য দিয়ে। প্রচার মাধ্যমগুলো ইসলামকে সন্ত্রাস ও বর্বরতার প্রতীকরূপে প্রচার চালায়।
অ্যাডওয়ার্ড সাঈদ তার ‘কাভারিং ইসলাম’ বইয়ে উল্লেখ করেন, ‘ইসলামী’ সন্ত্রাসকে ছবিতে মূর্ত করার উদ্দেশ্য হলো আমেরিকায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বাড়িয়ে তোলা। সাঈদের মতে, ‘ইউরোপ ও আমেরিকায় ইসলাম একটা অশান্তিদায়ক খবর। সরকার, প্রচার-মাধ্যম, বিশেষজ্ঞদল, সবারই এক সুর- ইসলাম পশ্চিমাসভ্যতার প্রতি হুমকি। এর ফলে ইসলামের নেতিবাচক ভাবমূর্তিই প্রচলিত হয়ে যায়, যে ভাবমূর্তি তৈরি করে সমাজের প্রভাবশালী অংশ, অথচ এই ভাবমূর্তি কিন্তু বলে না, ইসলাম আসলে কী।’
পাশ্চাত্যের প্রভাবশালীদের মধ্যে যে বহুত্ববাদিতা ও পরমত সহিষ্ণুতার মুখোশ পরিহিত ছিল তা এখানেই স্পষ্ট হয়। নিজেদের শ্রেষ্ঠ দাবি করার যে মহড়া চালিয়ে আসছে তারা, সেই মহড়ার গর্ভ থেকে এই শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্ভব। যদিও এ কথা সত্য যে, কিছু মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের চর্চা রয়ে গেছে; আর তা করা হচ্ছে তাদের অজ্ঞতা ও নোংরা প্রকৃতির মনোবৃত্তির কারণে। সে কারণে আইএস, আল কায়েদার মতো উগ্রগোষ্ঠীর জন্ম হয়; যদিও এটা সত্য যে, তাদের সার্বিকভাবে সংগঠিত করছে ইঙ্গ-মার্কিন, ইসরায়েলি ও মার্কিন অনুগত সৌদিশক্তি।
অথচ আমরা যদি লক্ষ করি, কোনো ধর্মই মানুষকে উগ্র সহিংস হতে বলে না। যে ধর্মগ্রন্থ বলছে, ধর্মে জোর জবরদস্তি নিষেধ, কাউকে হত্যা করা মানে দুনিয়ার সব মানুষকে হত্যা করা, হত্যার শাস্তি চিরস্থায়ী জাহান্নাম সেই ধর্ম কী করে সন্ত্রাসী ধর্ম হয়? যে ধর্মগ্রন্থ বলছে, কেউ থাপ্পড় দিলেও প্রতিশোধ নেবে না সেই ধর্ম কী প্রতিশোধ পরায়ণ হতে পারে? মূলত মানুষের হৃদয় যখন অজ্ঞতার কারণে অথবা বাহ্যিক প্রচারণার প্রভাবে অসুস্থ হয় তখনই ‘অপর’ ধারণার বংশ বিস্তার হতে থাকে।
এই ‘অপর’ ধারণা থেকে জন্ম নেয় ক্ষোভ, ক্রোধ ও জিঘাংসা। এই সুযোগটা কাজে লাগায় সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তিগুলো। সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারের স্বার্থে জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ এমনকি ধর্মের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য উপযোগী সব ধরনের রসদ সরবরাহ করা হয়। কেননা এগুলো যত বাড়বে ততই প্রতিটি জাতি হারিয়ে ফেলবে নিজেদের ঐক্যের শক্তি। জাতীয় ঐক্যে ফাটল যত বাড়বে ততই সাম্রাজ্য বিস্তারের গুটিচাল সম্ভব হবে বহুবিধভাবে।
এ কথা সত্য, ব্রেনটন টারান্ট আমাদের জন্য যত হুমকি তার চেয়ে হাজার কোটি গুণ হুমকি হলো উগ্র জাতীয়তাবাদী ও বর্ণবাদী প্রচারণা, যা একটা জাতির মনোবৃত্তিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। সে দিন টারান্ট নিজেই লাইভ করতে করতে গুলিবর্ষণ করেছিল, এটা জানিয়ে দেওয়ার জন্য যে, তোমরা যারা শ্বেতাঙ্গ আছ, প্রস্তুত হও। মানুষের মনোজগৎকে পরিশীলিত করার সুষম উদ্যোগ নিতে আমরা যদি ব্যর্থ হই তাহলে আমাদের সামনে জন্ম হবে আরও টারান্টের। সভ্যতাকে এভাবে সাম্রাজ্যবাদীদের কব্জায় যতদিন রাখা হবে ততদিন এই অমানিশা থেকে নিস্তার পাওয়া কঠিন। আসুন, আমরা অন্ধ আনুগত্য ছেড়ে নিজেদের গড়ে তুলি জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও মহত্ত্বের চর্চা দিয়ে।
আশেক মাহমুদ : সহকারী অধ্যাপক, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]