ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নদী বাঁচলে জীবন বাঁচবে

আব্দুল হাই রঞ্জু
🕐 ১০:১৫ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৬, ২০১৯

উত্তরাঞ্চলের প্রমত্ত নদ-নদীগুলো পানির অভাবে এখন মরাখালে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে উজান থেকে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ না থাকায় খরস্রোতা তিস্তা এখন নামেই নদী। এ নদীতে পানি না থাকায় চোখে পড়ে শুধু ধু-ধু বালুচর। এককালের খরস্রোতা তিস্তা নদীটির পানির নাব্য হ্রাস পেতে পেতে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। নদী পারাপারে এখন আর খেয়া নৌকারও প্রয়োজন পড়ে না। অধিকাংশ স্থানে হাঁটু পানি, মানুষ হেঁটেই পাড়ি দিচ্ছেন।

মূলত ভারত উজানে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার গজলবোডায় ব্যারাজ তৈরি করে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় বাংলাদেশ অংশে ১১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদী পানির অভাবে এখন মৃতপ্রায়। ভারত তিস্তা নদীর উজানে ব্যারাজ তৈরি করে সংযোগ খালের মাধ্যমে তিস্তার পানি মহানন্দা নদীতে, জলপাইগুড়ি জেলার দার্জিলিং, পশ্চিম দিনাজপুর, উত্তর দিনাজপুরের মালদহ ও কুচবিহার জেলায় সেচ সুবিধা নিচ্ছে।

যেখানে পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ আটক কিংবা পরিবর্তন করার বৈধতা আন্তর্জাতিক আইনে নেই, সেখানে ভারত আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে একতরফাভাবে তিস্তার পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ আটকে দিয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে মরুভূমির দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা অনৈতিক এবং বাংলাদেশের মানুষের ওপর এক ধরনের অবিচার। বাংলাদেশ সরকার যুগের পর যুগ ধরে তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালালেও আশ্বাস ব্যতীত কার্যকর কোনো সুফল মেলেনি।

তিস্তার পানির হিস্যার দাবিতে প্রতিবছরই দেশের বামদলগুলো লংমার্চের মতো কর্মসূচি পালন করে আসছে। অতি সম্প্রতি বাসদ তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে লংমার্চ কর্মসূচি পালন করেছে। এখন শুষ্ক মৌসুম। এই সময়ে তিস্তা ব্যারাজের উজানের অংশে নদীতে পানি টইটম্বুর থাকলেও ভাটিতে শুধু ধু-ধু বালুচর। অথচ আমাদের দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার অন্যতম নিয়ামক খাদ্যের সিংহভাগ জোগান আসে উত্তরাঞ্চলে সেচভিত্তিক চাষাবাদের ওপর ভিত্তি করে। অথচ পানির অভাবে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের আওতায় এ বছর প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদ হয়নি। অথচ ভারত সরকার তিস্তার উজানে আন্তঃদেশীয় নদী সংযোগ প্রকল্পের জন্য ভারত ও নেপাল যৌথভাবে সমঝোতার ভিত্তিতে ‘পান্সেসপার ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’ গঠন করে মূল নদীর পানি বিভিন্ন প্রকল্পে সরিয়ে নিচ্ছে।

এ প্রকল্পের আওতায় নেপালের সারদা নদী থেকে গুজরাটের সবরমতি নদীতে পানি স্থানান্তর করা হচ্ছে। এর বাইরে নেপালে প্রবাহিত হিমালয় নদী সারদাতে একটি জলাধার নির্মাণ করে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। অর্থাৎ তিস্তা নদীর উজানের পানি ভারত ও নেপাল সরকার তাদের খাদ্য উৎপাদন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেদার ব্যবহার করছে। অথচ আমরা পানির অভাবে তিস্তার ১১৭ কিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে চাষের জমিতে যথাযথভাবে সেচ দিতে পারছি না। বাস্তব এ অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে অত্র অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ কাজ করছে। যা এখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। যারা যে অবস্থান থেকে সুযোগ পাচ্ছেন সেখানেই তিস্তার ন্যায্য পানির হিস্যার জন্য দাবি দাওয়া করে আসছেন।

গত ১৪ মার্চ ছিল আন্তর্জাতিক নদীকৃত দিবস। ওই দিবসটি সর্বত্র পালিত হলেও রংপুরে এ বছর দিবসটি পালিত হয়েছে একটু ব্যতিক্রমভাবে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কলাম লেখক ড. তুহিন ওয়াদুদের নেতৃত্বে ‘বাঁচলে নদী, বাঁচবে জীবন’ স্লোগানে নদীপ্রেমী ও সচেতন মহল মিলিত হয়েছিলেন রংপুরের কাউনিয়া পয়েন্টে রেল এবং সড়ক সেতুর মধ্যবর্তী তিস্তা নদীর ধারে। ওই অনুষ্ঠানে পানি ভর্তি কলসের পানি নদীতে ঢেলে প্রতীকী প্রতিবাদ করা হয়েছে। হয়তো এমন দিন আসছে, যেদিন রিভারাইন পিপলের নেতৃত্বে তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার দাবি আদায়ে আরো বৃহত্তর কর্মসূচি পালিত হবে।

জন্মসূত্রে আমার বেড়ে ওঠা চিলমারী বন্দরে। সেই ছোট্ট বেলায় দেখেছি ব্রহ্মপুত্রের তীরে চিলমারী বন্দরটির কর্মব্যস্ততা। ব্রহ্মপুত্রের ভরা যৌবন খুবই কাছে থেকে দেখেছি। গভীর ও খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্রের ছিল উত্তাল চেহারা। বড় বড় পানশি নৌকা, বড় বড় জাহাজ, লঞ্চ ব্যতীত ভয়েই ছোট ছোট নৌযান চলাচল করত না। ব্রহ্মপুত্রকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল ব্যবসা-বাণিজ্য খ্যাত চিলমারী বন্দরটি। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চিলমারী বন্দরটি ভাঙনের কবলে ব্রহ্মপুত্রের গর্ভেই বিলীন হয়ে যায়। সেই উত্তাল ব্রহ্মপুত্রের এখন আর সেই ঐতিহ্য নেই। শুষ্ক মৌসুম এলেই নদীতে পানি থাকে না। এই ব্রহ্মপুত্রের উজানেও ভারত। ব্রহ্মপুত্র নদীটি চীন থেকে উৎপত্তি হয়ে ভারত হয়ে বাংলাদেশ অংশে কুড়িগ্রাম জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যমুনায় গিয়ে মিলিত হয়েছে। এক সময় ঐতিহ্যবাহী চিলমারী পাটের ব্যবসার জন্য বিখ্যাত ছিল। শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যই নয় ব্রহ্মপুত্রের বড় বড় রুই, পাঙ্গাশ মাছের সরবরাহ ছিল প্রচুর। ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে চিলমারী বন্দরে হাটে পৌঁছিলেই দেখতাম বড় বড় মাছের কী সরবরাহ! আজ সেসব শুধুই স্মৃতি। ব্রহ্মপুত্রের সেই চেহারাও নেই, ব্যবসা ও মাছ কিছুই নেই। এখন ব্রহ্মপুত্রে শুধু চর আর চর। সেসব চরে এখন নদী। চাষিরা দিব্যি ধান, কলাই, সরিষা, শাক সবজির দেদার চাষাবাদ করছে। দেখলে মনে হয়, নদী তো নয়, এ যেন ফসলের সবুজ কোনো মাঠ। এ নদীর উজানেও ভারত বাঁধ নির্মাণ করে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে।

শুধু তিস্তা ব্রহ্মপুত্রই নয়। অভিন্ন ৫৪টি নদীর ৫৩টিতে ভারত বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশকে ন্যায্য পানির হিস্যা থেকে বঞ্চিত করেছে। শুধু তিস্তার উজানেই নয়, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বরাক নদীর ১০০ কিলোমিটার উজানে মণিপুরের টিপাইমুখ নামক স্থানে একটি বিরাট ব্যারাজ নির্মাণ করেছে ভারত। যদিও ভারত বলছে, টিপাইমুখ ব্যারাজের কারণে বাংলাদেশ অংশের কোনো ক্ষতি হবে না। বাস্তবতা হচ্ছে, টিপাইমুখ বাঁধের কারণে সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারাসহ মেঘনা অববাহিকা পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। যার বিরূপ প্রভাবে বৃহত্তর সিলেট, কুমিল্লা, কিশোরগঞ্জ, হাওর অঞ্চল, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও চাঁদপুর জেলার কৃষি চাষাবাদ হুমকির মুখে পড়েছে।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৭ সালে উজানের পানির ঢলে আকস্মিক বন্যার কারণে হাওর অঞ্চল খ্যাত ৪টি জেলার আধাপাকা ধান পানিতে তলিয়ে যায়। ফলে খাদ্য সংকটে পড়তে হয় আমাদের। বেড়ে যায় ধান চালের দাম। বাধ্য হয়ে সরকার শুল্কমুক্ত সুবিধার চাল আমদানির সুযোগ দেয়। ফলে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি হয়। ব্যাপক চাল আমদানির কারণে চালের বাজারদর স্মরণকালের মধ্যে নিম্ন পর্যায়ে চলে আসে। ফলে উৎপাদকের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। অবশ্য পরে সরকার উৎপাদকের স্বার্থ রক্ষায় পুনরায় চাল আমদানিতে ২৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। বাড়তি শুল্ক আরোপ করায় চাল আমদানি তলানিতে চলে আসে। তবুও এখন পর্যন্ত ধান চাষিদের ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। অবশ্য ধানচাষিদের উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারি ভ্রান্ত নীতিমালাও অনেকাংশেই দায়ী।
প্রকৃত অর্থে ধানচাষিদের ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হলে কৃষিভিত্তিক শিল্প হিসেবে গড়ে ওঠা হাজার হাজার হাসকিং মিলকে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে পুনর্জীবিত করতে হবে। তাহলে ধান বেচাকেনায় প্রতিযোগিতা ফিরে আসবে। আর তা করতে না পারলে হাতেগোনা গুটিকতক অটোমেটিক রাইস মিলের অপকৌশলের শিকার হতে হবে ধানচাষিদের।
কৃষি অর্থনীতিকে গতিশীল করে দেশকে সমৃদ্ধ করতে হলে দেশের মরে যাওয়া নদ-নদীগুলোকে বাঁচাতে হবে। কারণ নদী বাঁচলে কৃষি বাঁচবে, আর কৃষি বাঁচলে দেশের মানুষ বাঁচবে। সঙ্গত কারণেই তিস্তাসহ অভিন্ন সব নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি।

আব্দুল হাই রঞ্জু : সাবেক ছাত্রনেতা
[email protected]

 
Electronic Paper