ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

গণহত্যার স্বীকৃতি মিলবেই : মোজাম্মেল হক

ড. কাজল রশীদ শাহীন ও আবু বকর সিদ্দীক
🕐 ১০:০৫ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৫, ২০১৯

প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। ১৯ মার্চের প্রতিরোধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের তালিকা, মন্ত্রণালয়ের চ্যালেঞ্জ, জামায়াতের রাজনীতি, গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি সম্পর্কে বলেছেন খোলা কাগজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক আবু বকর সিদ্দীক ও ড. কাজল রশীদ শাহীন

১৯ মার্চের প্রতিরোধ যুদ্ধের শুরুটা একটু বলেন। 
১৭ মার্চ আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। ওইদিন ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। লাখ লাখ মানুষ লাইন ধরে বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন, তিনিও বেলকনিতে দাঁড়িয়ে শুভেচ্ছা নিচ্ছেন। সন্ধ্যার দিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো। জানালাম, আমরা শুনতে পাচ্ছি-জয়দেবপুরে অবস্থিত সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সব অস্ত্র পাকিস্তানিরা ঢাকায় নিয়ে আসবে, ঢাকা কেন্দ্রীয় অস্ত্রাগারে অস্ত্রের ঘাটতি দেখা দিয়েছে-এই অজুহাতে। বঙ্গবন্ধু খুব জোরে ধমক দিলেন, ‘এত দিনে কি শিখলি?’ তারপর পায়চারী করতে করতে বললেন, ইউ হেভ টু রেজিস্ট এট দ্য কস্ট অব অ্যানিথিং। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পেয়ে আমরা চলে যাই। ১৯ মার্চ ব্রিগেডিয়ার জাহানজে যখন বাঙালি অস্ত্রধারীদের নিরস্ত্র করতে উদ্যত হয়, আমরা তাকে প্রতিরোধ করি।

জায়গাটা কি চৌরঙ্গী ছিল?
জয়দেবপুর বাজার। তখন অবশ্য এত জায়গা ছিল না। রাস্তাঘাট লোকে-লোকারণ্য। দা, কুড়াল, সুরকিসহ বিভিন্ন দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জনগণ উপস্থিত হয়। তার আগে আমরা অবশ্য কিছু অত্যাধুনিক রাইফেল সংগ্রহ করেছিলাম। সেগুলো দিয়েই জাহানজের বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। তারা গুলি চালালে আমরাও পাল্টা গুলি চালাই। আমরা অবশ্য বেশিক্ষণ টিকতে পারিনি কারণ তাদের অস্ত্র অনেক বেশি।
জাহানজের বাহিনীর সামনে ছিল বাঙালি সৈন্য, পেছনে পাঞ্জাবিরা, যাতে বাঙালিরা এদিক-ওদিক না করতে পারে। সামনে থাকা বাঙালি সৈন্যরা আমাদের গুলি করেনি, করলে তো হাজার হাজার লোক মারা যেত। তারা মাথার ওপর ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করে মাইকে কারফিউয়ের কথা ঘোষণা দিতে থাকল। সেই যুদ্ধে মনু খলিফা, নিয়ামত শহীদ হন। এরপর চৌরাস্তার মোড়ে যে ব্যারিকেডটা ছিল সেটা অপসারণের সময় কৃতী ফুটবলার হুরমত আলী এক পাঞ্জাবি সৈন্যের কাছ থেকে রাইফেল কেড়ে নিলে অন্য পাঞ্জাবি সৈন্য তার মাথায় গুলি করে। তাৎক্ষণিক শাহাদতবরণ করেন হুরমত। সেখানেই আজকে জাগ্রত চৌরঙ্গী দাঁড়িয়ে আছে।

১৯ মার্চের যে প্রতিরোধের কথা আপনি বললেন, তার আগে তো আপনারা একটা কমিটিও গঠন করেছিলেন?
হ্যাঁ, আমরা ২ মার্চ রাতেই কমিটি গঠন করেছিলাম। কারণ আমি জানতাম, বঙ্গবন্ধু কি বলবে, শুধু আমি কেন, সবাই জানত। তিনি তো আগেই বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঘরে ঘরে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তোলো। শ্রমিক বেল্টে আমাদের প্রভাব তুলনামূলকভাবে একটু কম ছিল, কারণ শ্রমিকরা লেফট রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল বেশি। তাই আমরা শ্রমিকদের বেশি করে যুক্ত করতে চেষ্টা করলাম। আমি যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলাম আর নজরুল ইসলাম খান ছিলেন ট্রেজারার, এখন যিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য। এই কমিটির মাধ্যমে আমরা প্রতিদিন মিছিল করতাম, জনমত তৈরির জন্য হাটে হাটে সভা হতো। আমরা অর্ডন্যান্স (অস্ত্রাগার) আক্রমণ করে তা দখল করে নিলাম। অস্ত্রাগারের চাবিটা নিয়ে সেটা খুলে যুদ্ধের আগেই আমরা সেখান থেকে অস্ত্র বের করে নেই। সারা দেশে তখন বঙ্গবন্ধুর কথা ছাড়া যেমন একটা পাতাও নড়ত না তেমনি গাজীপুরেও আমাদের কথা ছাড়া কিছুই হতো না।

আপনার মধ্যে একটা সাংগঠনিক ক্ষমতা আছে। এটা কি ছোটবেলা থেকেই?
হ্যাঁ, আমি ছোটবেলা থেকেই মানুষ নিয়ে চলতাম, একা একা চলতে পারতাম না। কখনই মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিনি। আই ওয়াজ অলওয়েজ ভেরি পোলাইট। সিদ্ধান্তে অটল থাকতাম কিন্তু সেটা বিনয়ের সঙ্গে।

এই শিক্ষাটা কি পারিবারিকভাবেই?
এটা কীভাবে এসেছে জানি না। কিন্তু এটাই আমার স্টাইল ছিল। আমি সব সময় যুক্তিতে বিশ্বাস করতাম। আমার বিপক্ষে মত দিলেও আমি তা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে শুনি। একজনকে কথা বলার অধিকার দেব না বা তার কথা শুনব না-এমন মানসিকতা আমার কখনো ছিল না, এখনো নেই।

একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। এই অনুভূতিটা কেমন?
এটাই তো স্বাভাবিক। পাঁচ বছর আগে আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে চেয়েই নিয়েছি। আমি বলেছি, প্রধানমন্ত্রী, আমি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিতে চাই। এ বছর অবশ্য বলিনি, প্রধানমন্ত্রী নিজে থেকেই দিয়েছেন। তিনি হয়তো বুঝেছেন, আমি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কিছু করে যেতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে কীভাবে কাজ করবেন?
বিগত দিনগুলো চলে গেছে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরিতেই। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে আমরা বেশি কাজ করতে পারিনি। এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে দেব। ছোট ছোট ছবি তৈরি করে স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে তাদের উপযোগী করে তা দেখাব। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা গণতন্ত্রকে খেলাধুলা বা অন্যান্য চর্চার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে চাই। যেমন প্রাইমারি স্কুলের শিশুরা নির্বাচনের মাধ্যমে এখন নিজেরাই নিজেদের নেতা নির্বাচন করে নিচ্ছে। প্রাইমারি স্কুল থেকেই গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে। অন্যান্য লেভেলেও আমরা বলে দিয়েছি, তোমরা তোমাদের নেতা নির্বাচন কর।

২৬ মার্চের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশের কথা আপনারা বলেছিলেন, সেটার কী অবস্থা?
উচ্চ আদালতের আদেশের কারণে সেটা হচ্ছে না। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ, আমরা দ্রুত এই প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারব।

বীরাঙ্গনাদের তালিকা...?
বীরাঙ্গনা তারা হতে চান না, বলতে চান না। কারণ এত বছর পর, প্রথমত বেশির ভাগ মরে গেছেন। এখন তাদের সন্তান-সন্ততিরা কোনো না কোনো কাজ করে, কোথাও না কোথাও তারা প্রতিষ্ঠিত। এখন তারা মনে করেন, এটা বিগত দিনের ইতিহাস, এটা ধামাচাপা পড়ে গেছে। সামাজিক মূল্যবোধের জন্য তারা এখন আর এটাকে সামনে নিয়ে আসতে চায় না। পশ্চিমা দেশ বিষয়টাকে যেভাবে নেয়, আমাদের দেশ এখনো বিষয়টাকে সেভাবে নেয় না। এখন তারা যদি স্বেচ্ছায় স্বাক্ষর করতে না চায়, তাহলে আমরা কী করতে পারি। আমি ব্যক্তিগতভাবে দু’একজনকে চিনি। আমার জেলায় আমি নিজে তাদের কয়েকজনের বাড়িতে গিয়েছি। বলেছি, খালাম্মা আপনি...? বলে বাবা, মাফ চাই...এটা বলে কেঁদে দেন। তারা এখন আর বিষয়টাকে স্মরণ করতে চান না।

বীরাঙ্গনা মানে যে শুধু সম্ভ্রম হারিয়েছেন তা তো নয়, অনেকে তো সম্মুখ সমরে যুদ্ধও করেছেন...?
সেটা হলে তারা তো মুক্তিযোদ্ধাই, মহিলা মুক্তিযোদ্ধা। তালিকায় তারা আছেন, নিয়মানুযায়ী ভাতা পাচ্ছেন। সব রকম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। মহিলা মুক্তিযোদ্ধা বলছি বোঝার জন্য, মুক্তিযোদ্ধা তো মুক্তিযোদ্ধাই। কাগজে তো মহিলা মুক্তিযোদ্ধা বলে কিছু নেই। মুক্তিযোদ্ধা ব্রাকেটে বীরাঙ্গনা এমনটা আছে অনেক জায়গায়।

দুই বছর পর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কি কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে?
এখনো আমরা পরিকল্পনা করিনি। মিটিংয়ে বসেছি, তবে একটা মিটিংয়েই শেষ নয়। আরও দুই-তিনটা মিটিংয়ের পর আমরা চূড়ান্ত করব-কীভাবে বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করব। এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কী কী কাজ করবে, কীভাবে কাজ করবে, কখন শুরু করবে-এটা এখনো আলোচনার পর্যায় আছে। এখনো কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দেশে কতটা বাস্তবায়িত হলো?
গত নির্বাচনে একটা বিশাল জয়ের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে, মানুষ এই চেতনায় বিশ্বাসী। তবে এটা কতটুকু সঠিক, সেটা আরেকটি নির্বাচন হলে বোঝা যাবে। এটা কি শুধু বিকল্প পায়নি বলে নাকি সত্যি সত্যিই। মানুষ ভোট দেবে কোথায়, বিএনপির প্রার্থী তারা তিন-চারজন করে তারা ডিক্লেয়ার করে রেখেছেন। কে যে প্রার্থী তারা নিজেরাই জানেন না। তাদের নেতা কে হবেন, সেটাও তারা বলতে পারেননি। তা ছাড়া তাদের যে নেতা সে এখন আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত, তাও আবার এতিমের টাকা চুরির অপরাধে। ২০০৮ সালের নির্বাচন নিয়ে তো তারা কোনো কথা বলছেন না। সেখানে তারা মাত্র ২৮টা সিট পেয়েছিলেন। এই দশ বছরে তারা কোনো থানা কমিটি, ইউনিয়ন কমিটি করেননি। মোদ্দাকথা, ওদের কর্মীরা ডেসপারেট ছিল না। যেমন এখন আমাদের কর্মীরা হবে কি না সন্দেহ, কারণ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে আরাম-আয়েশের ভাব চলে আসে। এটা কিন্তু বাস্তবতা।

সে ক্ষেত্রে আপনি তো ৪৫ বছর ধরে ক্ষমতার চেয়ারে?
হ্যাঁ। কিন্তু আমি কখনো রাজপথ ছাড়িনি। আমি কখনোই নিজের জন্য ক্ষমতাকে ব্যবহার করিনি। আমি ক্ষমতা ব্যবহার করেছি জনগণের সেবা দেওয়ার জন্য। আমি যদি আমার জন্য ব্যবহার করতাম তাহলে ক্ষমতায় থাকতে পারতাম না। ক্ষমতায় থাকার জন্য কম্প্রোমাইজ করতে হতো।

আপনি কি এটা এনজয় করেন?
হ্যাঁ। ক্ষমতার অনেক দায়িত্ব আছে, চাপ আছে। তারপরও আমি এটা এনজয় করি। আমি মনে করি, এটা সব মানুষের ভাগ্যে হয় না, যোগ্যতা থাকলেও অনেক সময় হয় না। অনেকেই হয়তো আছেন, আমার চেয়ে অনেক বেশি ক্যাপাবল, আমার চেয়ে অনেক বেশি ভালো, কিন্তু তার ভাগ্যে কুলায়নি। তাই এটাকে আমি সৌভাগ্য মনে করি। এই ক্ষমতা তো কাল নাও থাকতে পারে, কাল তো আমি মরে যেতেও পারি। তাই আমি ক্ষমতাটাকে সম্মান করি। আমার কোনো চাওয়া নেই। একটাই চাওয়া, মানুষের ভালোবাসা নিয়ে মরতে চাই।

৭ মার্চে কি আপনি সোহরাওয়ার্দীতে আসতে পেরেছিলেন?
হ্যাঁ। আমি একা না, হাজার হাজার লোক নিয়ে এসেছি। সেদিন আমরা আসছিলাম অবশ্য ট্রাকে। তার আগে ট্রেনভর্তি করে লোক পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আর ১০০টি ট্রাক, যেগুলো আমরা অবশ্য বিনা পয়সায় পেয়েছিলাম, স্লোগান দিতে দিতে উদ্যানে পৌঁছি। আমাদের সবার মাথায় লাল পট্টি অথবা হাতে বাঁধা লাল কাপড়।

যখন এসেছিলেন তখনকার অনুভূতি আর যখন ফিরে গেলেন তখনকার অনুভূতি কেমন ছিল?
প্রথমত মনে হয়েছে, আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। মানে ফিরে যাওয়ার সময়কার কথা বলছি। সে সময় কিছুটা মন খারাপই হয়েছিল। আমরা চেয়েছিলাম স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ ঘোষণা। কিন্তু পরদিন যখন ভাষণটা রেডিওতে শুনলাম, খেয়াল করলাম, সব বিষয় এসে গেছে। তাৎক্ষণিকভাবে তো এলে অনেক কিছুই বোঝা যায় না। মন খারাপটা তখন কেটে গেল। বঙ্গবন্ধু প্রমাণ করলেন, তিনি শুধু মানুষকে খেপিয়ে তুলতে পারেন, তা নয়, তার দূরদৃষ্টি আছে, কূটকৌশল আছে।
ওইদিন যদি তিনি প্রত্যক্ষ স্বাধীনতার ঘোষণা করতেন তাহলে বাইরের দেশের সমর্থন পেতেন না। বঙ্গবন্ধু চেষ্টা করে গেছেন, আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। মানুষও দেখেছে, সে তো চেষ্টা করে যাচ্ছে। সে সময় অনেকে অনেক সমালোচনা করেছিল কিন্তু পরে দেখা গেল বঙ্গবন্ধুই ঠিক আছেন।

ওই সময় গাজীপুরের অবস্থা কেমন ছিল?
বারুদের মতো মানুষ জ্বলছিল। সারা দেশেই উচ্চারিত হচ্ছে বাংলাদেশ স্বাধীন হোক। এগুলো পাগলামি ছাড়া আর কিছু না। মানুষ উন্মাদ না হলে কোনো কিছু করতে পারে না। স্বাধীনতার সময় আমরা সেটা দেখেছি। যে কোনো কিছুতে লেগে থাকতে হয়, বিশ্বাস রাখতে হয়। আপনাকে পাগল হতে হবে, ধৈর্য হারালে হবে না। বিএনপি এখন মাঠে আসতে পারে না কেন? আমাদের আন্দোলনের সময় রাজপথে থেকে আমাদের নেতারা মার খেয়েছে। আহসান উল্লাহ মাস্টার নিহত হয়েছেন, সোহেল তাজকে পিটিয়েছে পুলিশ। নাসিম ভাই হাঁটতে পারল না, মতিয়া চৌধুরীকে নির্যাতন করা হলো।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাসদের ভূমিকাটা বলবেন?
তারা নিজেরাই স্বীকার করেছেন তাদের রাজনীতি ভুল ছিল। পঁচাত্তর-পূর্ব রাজনীতি তাদের ভুল ছিল। কাজেই মরা ঘোড়ারে আর চাবুক মারতে চাই না।
বঙ্গবন্ধু হত্যার প্লট বা অবস্থাটা তৈরি করে দিয়েছে জাসদ। যদিও হত্যাকাণ্ডের মধ্যে তারা নেই, এটা আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস। কিন্তু অবস্থাটা তাদের হাতে তৈরি। অবস্থা তৈরি না হলে কেউ কাজটা করতে পারে না।

মন্ত্রণালয় চালাতে আপনাকে কেমন চ্যালেঞ্জ নিতে হয়?
মনে রাখবেন, এ দেশের আমলারা কখনই গণমুখী ছিল না। কোনো একটা কিছু শুরুতেই তারা নাকচ করে দিতে চান। না করার জন্য বিভিন্ন যুক্তি খোঁজেন, কিন্তু রাজনীতিবিদ হিসেবে আমি সবসময় হ্যাঁ করার জন্য যুক্তি খুঁজি, ইতিবাচক চিন্তা করি। তারা বলে এই এই কারণে এটা করা যাবে না, আর আমি বলি, এই এই কারণে এটা হবে। তো এটা মোকাবেলা করার চ্যালেঞ্জটা তো আছেই।

আগামী দিনের চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতা, বোনাস, স্পেশাল বোনাস, শতভাগ ফ্রি চিকিৎসা, আর্থিকভাবে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাসহ সব মুক্তিযোদ্ধার বাসগৃহ করে দেওয়া। চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ কোটা ফিরিয়ে আনাসহ অন্য সুবিধাগুলো শতভাগ বাস্তবায়ন করা। ভবিষ্যতে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয়পত্র সরবরাহ করব, যেন তিনি যেখানে যান সেখানেই কিছু বাড়তি সুবিধা পান। যানবাহনে ভাড়া লাগবে না, কোনো অফিস-আদালতে গেলে সঙ্গে সঙ্গে বসার জন্য একটা চেয়ার এগিয়ে দেওয়া হবে, সেটা ডিসি অফিস হোক আর রাষ্ট্রপতির অফিস হোক। মুক্তিযুদ্ধের যত স্মৃতিচিহ্ন, সেগুলো সংরক্ষণ করা হবে। যত জায়গায় বধ্যভূমি আছে সেগুলো সংরক্ষণ করা হবে। যেখানে যেখানে সম্মুখ যুদ্ধ হয়েছে সেগুলো সংরক্ষণ করা হবে। মুক্তিযুদ্ধের ওপর বিসিএসে ১০০ নম্বরের আলাদা পরীক্ষা রাখা, এর মধ্যে ২৩ বছরের সংগ্রামের ওপর ৫০ এবং ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের ওপর ৫০ নম্বর। পাঠ্যপুস্তকে যতটুকু জায়গাজুড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কথা থাকবে ঠিক ততটুকু জায়গাজুড়েই থাকবে পাক হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসরদের কথা।

একাত্তরে যারা বিতর্কিত চরিত্র ছিল, এই প্রজন্মের সামনে তাদের খোলাসা করার কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
রাজাকার, আলবদরদের তালিকা তৈরি করব আমরা, সেটার প্রাথমিক কাজ শুরু হয়ে গেছে। অনেক বিতর্কিত ব্যক্তি অনেক বড় বড় রাজনৈতিক দলে প্রতিষ্ঠিত, তাদের বিষয়টাও আমরা বিবেচনায় রাখছি। মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার ৪৯ বছরের মধ্যে আমরা মাত্র ১৯ বছর ক্ষমতায় ছিলাম, অন্যরা ছিল ৩০ বছর। তো মুক্তিযুদ্ধের এই বিষয়গুলো মীমাংসা করতে একটা সময় তো লাগবেই। আমরা তো আমাদের ছাত্রজীবনে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস শিখেছি। বিষয়গুলো এখন আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে।
আমার ছেলের একটা ঘটনা বলি। তখন ও ক্লাস থ্রিতে পড়ে। একদিন শুনি ও পড়ছে, মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক জিয়াউর রহমান। আমি ধমক দিয়ে বললাম, জিয়া না, এটা হবে বঙ্গবন্ধু। সে আমার সামনে একবার বঙ্গবন্ধু বলল, কিন্তু তারপর আবার বইয়েরটাই পড়তে শুরু করল। সুতরাং এসব মেটাতে একটা সময় তো লাগবেই। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।

২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণার বিষয়ে কিছু বলুন।
কূটনৈতিকভাবে আমরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বের কাছে আমরা তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

এ বিষয়ে আপনি কূটনৈতিক ব্যর্থতার কথা বলেছিলেন...
ঠিক কূটনৈতিক ব্যর্থতা বলিনি। বলেছিলাম, ওই সময় কূটনীতিকরা যদি প্রস্তুত থাকতেন তাহলে তারা অন্তত প্রস্তাব দিতে পারতেন। তারা প্রস্তুত ছিলেন না, তাদের কাছে তথ্য-উপাত্তও ছিল না। তারা একটা সুযোগ হারিয়ে ফেলেছেন। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে দাবিটা উত্থাপন করতে পারলে বিষয়টা আরও জোরালো হতো। এখন তো অনেক সময় অতিবাহিত হয়েছে। তবে এটা ইনশাআল্লাহ হবে। আমি মনে করি, স্বীকৃতিটা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে কী বলবেন?
জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা এবং তার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার জন্য আমি সবসময়ই সোচ্চার ছিলাম। এখনো আমি সেই একই মত পোষণ করি। সংসদেও আমি বলেছি, জামায়াত যুদ্ধাপরাধী দল, রাজনীতি করার তাদের কোনো অধিকার নেই এবং তাদের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত হওয়া উচিত।

একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এই প্রজন্মের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
এই প্রজন্ম ভাগ্যবান, তারা সঠিকভাবে জানতে পারছে, কেন মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, কত ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। এত রক্ত দিয়ে যে স্বাধীনতা আমরা কিনেছি সেই স্বাধীনতার মূল্যবোধ যেন বিনষ্ট না হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রাষ্ট্রীয় যে চার মূলনীতি, তা যেন তারা উচ্চে তুলে ধরে। যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখিয়ে গেছেন, ভাত-কাপড়সহ মৌলিক অধিকারগুলো যেন রাষ্ট্র নিশ্চিত করে সে সম্পর্কে সদা সতর্ক থাকতে হবে এই প্রজন্মকে।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ
খোলা কাগজ পরিবারের জন্য শুভকামনা।

 

 
Electronic Paper