ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মাঠে-ঘাটে-বাটে

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কতকাল পিছিয়ে থাকবে?

ড. তুহিন ওয়াদুদ
🕐 ৮:৫০ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৩, ২০১৯

কেমন আছে রংপুর অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাভুক্ত জনগোষ্ঠী তা আমাদের অনেকেরই অজানা। সমাজে যারা ভালো আছেন বলে প্রতীয়মান হয় তারাও যে অনগ্রসর এই জাতিগোষ্ঠীর জনগণের কোনো খবর রাখেন তা নয়। ফলে তারা অগ্রসরমান জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সমানতালে চলতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এখনো সমাজের অনগ্রসর জাতি। রাষ্ট্রীয়ভাবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে আমরা এগিয়ে নিতে পারিনি। সমাজে এখনো তাদের হরেক রকমের বঞ্চনা সহ্য করতে হয়।

নিজেদের নানান সংস্কারও তাদের পিছিয়ে রেখেছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, তারা তাদের পশ্চাদপদতা থেকে ক্রমে ক্রমে বেরিয়ে আসছে। এই বেরিয়ে আসাটাই আমাদের কাম্য।

আমাদের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে কোটা পেয়ে থাকে। চাকরিতেও তাদের কোটা সংরক্ষণ করা হয়। মধ্যবর্তী একটি ঘোষণায় তাদের কোটা না রাখার বিষয়ে যে প্রসঙ্গটি উঠে এসেছে, আশা করি তাতেও ক্ষুদ্র জাতিসত্তাভুক্তরা বঞ্চিত হবেন না।

আমাদের সমাজে যারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কেউ নন, তাদের চেহারার আকৃতি বিভিন্ন রকম। কারও চুল কোঁকড়ানো, কারও চুল সোজা, কারও নাক খাড়া, কারও নাক বোঁচা, কেউ লম্বা, কেউ খাটো, কারও চোখ কটা, কারও কালো। এ রকম অসংখ্য পার্থক্য লক্ষ করা যায়। এর কারণই হচ্ছে বহু জাতিগোষ্ঠীর রক্ত মেশে আমাদের শরীরে। সেই তুলনায় যারা আমাদের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীভুক্ত তাদের মধ্যে পার্থক্য কম পাওয়া যায়। জাতিগোষ্ঠী বিশেষে তাদের শারীরিক কাঠামো আলাদা কিন্তু একই জাতিগোষ্ঠীতে পার্থক্য কম।

যেমন যারা দেখতে কালো তারা সবাই প্রায় একই রকম কালো। যারা দেখতে ফর্সা, তারা সবাই একই রকম ফর্সা। এ থেকে অনুমান করা যায়, তারা সহজে বদলে যেতে চায়নি। নিজস্বতাকে ধরে রেখেছে। কিন্তু বর্তমানে তারা এগিয়ে যাওয়া জাতিগোষ্ঠীর সমান হতে গিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যকে জলাঞ্জলি দিতেও কুণ্ঠা করছে না। এ প্রসঙ্গে বলা যায় তাদের ধর্মীয় এবং ভাষা সংস্কৃতি। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের ধর্ম এবং ভাষা বিপন্ন হওয়ার পথে। সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষকে রাষ্ট্রীয় পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না দেওয়ার কারণে তারা নিজেদের ঐতিহ্য বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করছে না।

আদিবাসীদের ভাষা সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সম্প্রতি পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বর্ণমালায় প্রাথমিক শ্রেণির পুস্তক রচনা করা হয়েছে। এই পুস্তক পড়ানোর মতো যথেষ্ট শিক্ষক না থাকায় শিশুরা নিজস্ব ভাষার বর্ণমালায় পাঠ গ্রহণ করতে পারছে না। আমাদের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মধ্যে যারা মা-বাবা আছেন, তারাও নিজেদের ভাষায় আর আগের মতো দৈনন্দিন কথা বলেন না। ফলে নতুন প্রজন্ম যে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ঐহিত্যগত ভাষা শিখবে তার কোনো উপায় নেই। উত্তরাঞ্চলের জয়পুরহাট, নওগাঁ, দিনাজপুর-রংপুরের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অনেকের সঙ্গে পরিচয় আছে। অনেক এলাকায় আমি নিজেও গিয়েছি। তাদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি এখন নতুন প্রজন্ম নিজেদের মূল ভাষা আর জানেন না। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগত ভাষা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাষ্ট্রের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীভুক্ত জাতিগুলোর ঐতিহ্যগত ধর্মেও আসছে পরিবর্তন। তারা কেউ ধর্মান্তরিত হচ্ছে সনাতন ধর্মে, কেউ খ্রিস্ট ধর্মে। এর মধ্য দিয়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগণ নিজস্ব ধর্ম হারাতে বসেছে। যে ধর্ম ঐতিহ্যগতভাবে হাজার বছর ধরে বংশ পরম্পরায় বহন করে আসছে, সেই ধর্মকেও তারা জলাঞ্জলি দিচ্ছে। এর নেপথ্যে ব্যর্থতা শুধু স্ব স্ব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের নয়, ব্যর্থতা রাষ্ট্রেরও আছে। বলা চলে, রাষ্ট্র ধর্মগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। ওঁরাও জাতিগোষ্ঠীর অনেকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি তারা এখন দুধর্মের আচার পালন করে। অনেকেই আর পর্বের ধর্ম চর্চাও করে না, ধর্মীয় উৎসবেও যায় না। একইভাবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অন্যরা এই কাজ করছেন।

সাঁওতালরা গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ভীষণ রকম বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। তাদের সহস্রাধিক একর জমি একটি চিনিকলের জন্য নির্দিষ্ট শর্তে নেওয়া হয়েছিল। চিনিকল না থাকলে সেই জমির মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ছিল সাঁওতালদের। কিন্তু সেই জমি ফিরিয়ে না দেওয়ায় জমির ওপর বসতি গড়ে উঠেছিল। সাঁওতালদের সেই বসতি নির্মমভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এতে কয়েকজন সাঁওতালকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। আজ পর্যন্ত তারা ন্যায়বিচার লাভ করেনি। খুবই মানবেতর জীবন যাপন করছে তারা। রাষ্ট্র কোথায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে তা না হয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গেই তাদের বিরোধ।

প্রায় সময়ই গণমাধ্যমে খবর পাওয়া যায়, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জমি দখল হচ্ছে। সম্প্রতি সাঁওতালদের একটি সংগঠনের আলোচনা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে সাঁওতাল জাতিগোষ্ঠীর সারা মারান্ডি বক্তৃতায় দিক-নির্দেশনামূলক বক্তৃতা করেছিলেন। তিনি বর্তমানে তাদের চিত্র কী রকম সেসব অবস্থার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। ইতিপূর্বে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজনের মধ্যে হাড়িয়াসহ বিভিন্ন মদ্যপানের অভ্যাস ছিল। তা অনেকটাই কমে এসেছে। মদ্যপান কমে আসাটা এই জাতিগোষ্ঠীর জন্যই জরুরি।

একটি দেশে বহু জাতিগোষ্ঠীর বাস থাকলে সবাই যাতে সমান উচ্চতায় উঠতে পারে সেই চেষ্টা আমাদের সবার করা প্রয়োজন। আমাদের বাংলাদেশে বহু জাতিগোষ্ঠীর বাস থাকলেও সবাইকে সমান উচ্চতায় এখনো নেওয়া সম্ভব হয়নি। সব জাতিগোষ্ঠী সমান উচ্চতায় উঠলে সবার অংশগ্রহণে দেশ অনেক এগিয়ে যাবে। কাউকে পিছিয়ে রেখে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে না।

বর্তমান অবস্থায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীভুক্তদের এগিয়ে নিতে হলে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা করার প্রয়োজন আছে। তার প্রতিফলন বাজেটেও রাখতে হবে। শুধু শুধু মৌখিক আশ্বাসে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উন্নয়ন হবে না। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সম্প্রদায়ভুক্তদের নিজ নিজ অনেক সংগঠন আছে। এই সংগঠনগুলোকে একটি নির্দিষ্ট ছাতার নিচে আনতে হবে। সবাই ঐক্যবদ্ধ হলে নিজেদের দাবিগুলো সরকারের কাছে শক্তভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হবে। অন্যথায় বৈষম্যপূর্ণ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে আরও অনেক সময় প্রয়োজন হবে।

দেশ যতবার সংকটে পড়েছে ততবারই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীভুক্তরা সমানভাবে এগিয়ে এসেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সব ক্ষেত্রেও তারা সমান ভূমিকা রেখেছে। তাহলে তাদের এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে রাষ্ট্র কিংবা সমাজ কেন পিছিয়ে থাকবে?

ড. তুহিন ওয়াদুদ
সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর ও
পরিচালক, রিভারাইন পিপল
[email protected]

 
Electronic Paper