খুলতে পারে জনশক্তি রপ্তানির দুয়ার
আব্দুল হাই রঞ্জু
🕐 ৯:১০ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৮, ২০১৯
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পোশাক খাতের পরের স্থানটি ধরে রেখেছে প্রবাসী আয়। এই দুই খাতের অর্জিত আয়ের ওপর ভিত্তি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ এখন ৩১ বিলিয়ন ডলারের ওপর পৌঁছে গেছে। গোটা দুনিয়ার নানা দেশে এখন এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি কর্মরত আছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশে প্রতিবছরই কর্মক্ষম প্রায় ২০ লাখ শ্রমশক্তি যুক্ত হলেও কর্মসংস্থান সেভাবে হচ্ছে না। ফলে বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে অধিকাংশ কর্মক্ষম হাতগুলোকে বসে বসে অলস সময় পার করতে হয়।
মূলত দেশে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো না থাকায় বিদেশে পাড়ি দিয়ে হলেও কাজের সন্ধানে সকলেই ছুটতে চান। কিন্তু সবার ভাগ্যে কাজ নিয়ে বিদেশে যাওয়াও সম্ভব হয় না। অথচ বিপুল পরিমাণ জনশক্তিই আমাদের মানবসম্পদ। এই মানবশক্তিকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হলে দেশের অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করা সম্ভব ছিল।
কিন্তু বাস্তবে বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় নিরন্তর প্রচেষ্টা চালালেও কাক্সিক্ষত সফলতা অর্জিত হচ্ছে না। ফলে বেকারত্বের সংখ্যা ক্রমান্বয়েই বাড়ছে।
বাংলাদেশি কর্মীদের প্রবাসে কাজের বড় ক্ষেত্র হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। বিশেষ করে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে আমাদের বিপুলসংখ্যক কর্মী কাজ করে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে মোটামুটি প্রতিবছরই কমবেশি কর্মী যেত। কিন্তু গত ২০০৮ সালে বাংলাদেশ থেকে ৪ লাখ ২০ হাজার কর্মী নেয় সংযুক্ত আরব আমিরাত। পরের বছরগুলোতে দুই লাখের বেশি কর্মী যেতে পারেনি।
সর্বশেষ ২০১২ সালে ২ লাখ ১৫ হাজার কর্মী যাওয়ার পর ২০১৩ সালে দেশটিতে কর্মী যাওয়ার সংখ্যা তলানিতে চলে আসে। সে ধারা এখনো অব্যাহত আছে।
গত বছরের ১৭ এপ্রিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে ১৯ খাতে কর্মী নিতে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। কি পরিমাণ কর্মী যাবে দেশটিতে, সমঝোতা স্মারকে তা স্পষ্ট করে উল্লেখ নেই।
তবে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আমিনুল ইসলাম বলেছিলেন, প্রথম পর্যায়ে নারী ও পুরুষ দুই ধরনের কর্মীই যাবে। চাহিদার বিপরীতে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো কর্মী পাঠাতে পারবে বলেও তিনি মন্তব্য করেছিলেন।
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পাশাপাশি মালয়েশিয়ায় আমাদের ব্যাপক পরিমাণ কর্মী কাজ করছেন। প্রতিবছরই কমবেশি বাংলাদেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় যেত। এক পর্যায়ে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে। গত ২০১২ সালে জিটুজি পদ্ধতিতে কর্মী পাঠাতে মালয়েশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে ১০টি বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিকে জিটুজি প্লাসের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাদের মাধ্যমে ২০১৭ সালে ৯৯ হাজার ৭৮৭ জন বাংলাদেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় যান। আর ২০১৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত ১ লাখ ২৫ হাজার ৮১৯ জন কর্মী পাঠিয়েছে ১০ রিক্রুটিং এজেন্সি।
মালয়েশিয়ায় মাহাথির মুহাম্মদের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। নতুন সরকার জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে বেসরকারি যে দশ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় কর্মী নেওয়া হচ্ছিল তা বন্ধ করে সবার জন্য উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কর্মী নিতে আলোচনায় আগ্রহ প্রকাশ করে। এরই অংশ হিসেবে গত বছরের অক্টোবরে দুই দেশের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ স্পষ্টভাবে জানান, কর্মী প্রেরণের ক্ষেত্রে সবার জন্য উন্মুক্ত পদ্ধতিই চালু থাকবে এবং কোনো অদক্ষ কর্মী নেয়াও হবে না।
মালয়েশিয়ার নির্দেশিত পথে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ডাটাবেস তৈরি করেছেন। এখন মালয়েশিয়ার সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় আছে সরকার। কর্মী পাঠানোর চাহিদা পত্র পাঠানো মাত্রই যেন কর্মী পাঠানো সম্ভব হয়, তার যাবতীয় প্রস্তুতিও ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব রৌনক জাহান বলেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর বিষয়টি এখন প্রস্তুতি পর্যায়ে আছে। তবে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, দুর্নীতির কারণে মালয়েশিয়ার সরকার বাংলাদেশ থেকে গত সাড়ে তিন মাস ধরে প্রচলিত নিয়মে কর্মী নেওয়া বন্ধ রেখেছে।
তাদের স্পষ্ট কথা- বাংলাদেশি কর্মীদের কাছ থেকে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করা হয়েছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ায় নতুন সরকার নতুন পদ্ধতি চালু করতে চায়।
সূত্র মতে, কিছুদিন আগে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী সে দেশে বাংলাদেশের কয়েকটি জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, বাংলাদেশি একজন কর্মীকে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে। এ তথ্য জানার পর মন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, শ্রমিকদের কাছ থেকে কোনো অর্থ নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। উল্টো আইএলও বিধিমতে বিমানের টিকিট দিয়ে কোম্পানিগুলোর কর্মী নিয়ে আসার কথা।
মালয়েশিয়া সরকার বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে জানায়। পরে বাংলাদেশের একজন মন্ত্রী মালয়েশিয়া যান এবং বাংলাদেশের কর্মী নিতে মালয়েশিয়া সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করেন। মালয়েশিয়া বাংলাদেশের শ্রমবাজারের মধ্যে অন্যতম একটি দেশ। সে দেশে স্বল্প শিক্ষিত এবং অনভিজ্ঞ শ্রমিকদের ওই দেশে কাজের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
আমরা আশা করছি, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে জনশক্তি রফতানি করা সম্ভব হবে। এমনকি আগে যেখানে একজন কর্মীকে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হতো, এখন হয়তো সে পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হবে না। স্বল্প খরচে বৈধভাবেই নিরাপদে কর্মসংস্থানের দ্বার উন্মোচিত হতে পারে।
উল্লেখ্য, মালয়েশিয়ায় শুধু বাংলাদেশের কর্মীরাই কাজ করেন না, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কর্মী দেশটিতে কাজ করে। মালয়েশিয়ার নতুন সরকার ইতোমধ্যেই অবৈধ কর্মীদের ধরপাকড় করছে।
ফলে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, নেপাল, ফিলিপাইন ও চীনের কর্মীদের আটক করা হচ্ছে। তবে, গ্রেফতার কিংবা হয়রানির শিকার বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যাই বেশি।
গত দুই মাসে বাংলাদেশিসহ প্রায় ৩২ হাজারেরও অধিক অবৈধ অভিবাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিষয়টি বাংলাদেশের কর্মীদের জন্য খুবই উদ্বেগের। আমরা মনে করি, এ বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের তরফে মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে সুরাহার একটা পথ বের করা উচিত।
যেন বাংলাদেশি কর্মীদের দেশে ফেরত আসতে না হয়। অবশ্য মালয়েশিয়া সরকারের আইন অনুযায়ী তারা কাজ করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবুও অনেক সময় বিভিন্ন দেশ অবৈধ অভিবাসীদের বৈধ করার সুযোগ দিয়ে থাকে। মালয়েশিয়া সরকার এ ধরনের কোনো সুযোগ দিলে বাংলাদেশের অবৈধ কর্মীরাই বেশি উপকৃত হবে।
আমাদের দেশে বিপুল পরিমাণ শ্রমশক্তি। যারা চায় শুধু একটু কাজের নিশ্চয়তা। এজন্য বৈধ পথে বিফল হয়ে অনেকেই অবৈধ পথে সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়ায় এখন অবৈধ অভিবাসী হয়েছেন। এমনকি এক কোম্পানির কাজ নিয়ে মালয়েশিয়ায় পৌঁছে অন্য কোম্পানিতে কাজ করছেন। আইনিভাবে এটাও অবৈধ। এ ধরনের কর্মীর সংখ্যাও সে দেশে কম নয়। সে কারণে বাংলাদেশ সরকারের তরফে উদ্যোগ নিয়ে সংকট নিরসনে ত্বরিত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশি কর্মীদের লাভের পাল্লাই বেশি ভারী হতো।
বাস্তবে আমাদের শ্রমবাজারের মধ্যে মালয়েশিয়া যেহেতু অন্যতম, সেহেতু মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের বন্ধ দুয়ার খোলাও অতি আবশ্যক। আমরা মনে করি, একমাত্র সফল কূটনৈতিক তৎপরতাই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের বন্ধ দুয়ার খুলতে পারে।
আব্দুল হাই রঞ্জু : সাবেক ছাত্রনেতা
[email protected]