ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বঙ্গবন্ধুর জন্ম এবং স্বাধীন বাংলাদেশ

রিয়াজুল হক
🕐 ৯:১০ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৭, ২০১৯

একটা গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। অনেক অনেক দিন আগের কথা। জনৈক রাজা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলেন যে, নতুন একজন রাজা নির্বাচন করার সময় চলে এসেছে। নতুন রাজা নির্বাচন করার জন্য রাজ্যের সব যুবককে একসঙ্গে ডেকে পাঠালেন। সবাই একসঙ্গে জড়ো হওয়ার পর রাজা বললেন, আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে এবং অন্য কারো হাতে যাবতীয় দায়িত্ব সমর্পণ করার সময় এসেছে। আমি তোমাদের মধ্যে কেউ একজনের হাতে রাজ্যের সব দায়িত্ব সমর্পণ করতে চাই।

যুবকদের মধ্যে এক ধরনের ভয় এবং উত্তেজনা বিরাজ করতে লাগল। রাজা বলতে থাকলেন-আমি তোমাদের সবাইকে একটি করে বীজ দেব, আমি চাই তোমরা তা রোপণ করবে, যত্ন নেবে এবং ঠিক এক বছর পর তোমরা গাছটি নিয়ে ফিরে আসবে। লিং নামের এক যুবকও ওইদিন উপস্থিত ছিল এবং যথারীতি সেও একখানা বীজ পেল। বাসায় ফিরে সে তার মাকে বীজটি দেখালো এবং সব খুলে বলল। সবকিছু শুনে তার মা বীজ রোপণ এবং যত্নে সাহায্য করতে লাগল।

কয়েক সপ্তাহ পর অন্য সব যুবক বলতে লাগল, তাদের বীজ থেকে চারা বের হচ্ছে। কিন্তু লিং তার বীজ থেকে তেমন কিছুই বের হতে দেখল না। তবুও সে আশা ছাড়ল না এবং নিয়মিত গাছের পরীক্ষা করতে লাগল যদি কোনো চারা বের হওয়ার আভাস দেখা যায়! ছয় মাস পার হয়ে যাওয়ার পর সকলে তাদের গাছ নিয়ে আলোচনা করতে লাগল কিন্তু লিং এখন পর্যন্ত কোনো আশার আলো দেখতে পেল না। দেখতে দেখতে এক বছর অতিবাহিত হলো এবং সবাই রাজ দরবারে রাজার সামনে তাদের চারা গাছ নিয়ে হাজির হলো। অনেকেই লিং কে উপহাস করতে লাগল। হঠাৎ করেই রাজার চোখ পড়ল লিং এর খালি টবের ওপর এবং ঘোষণা করল, তোমাদের পরবর্তী রাজা হচ্ছে লিং। এই কথা শুনে সবাই অবাক।

রাজা বলতে থাকলেন-আমি তোমাদের সবাইকে সিদ্ধ বীজ দিয়েছিলাম যা থেকে চারা বের হওয়া অসম্ভব। আর তোমরা লোভের বশবর্তী হয়ে আমাকে খুশি করার জন্য অন্য বীজ রোপণ করে আজ আমাকে গাছ উপহার দিয়েছো। শুধু লিং তার সততা দেখিয়েছে। আর তাই তাকেই পরবর্তী রাজা নির্বাচিত করা হলো। বঙ্গবন্ধু তার পিতার কাছ থেকে পাওয়া উপদেশ ‘সিনসিয়রিটি অব পারপাস এবং অনেস্টি অব পারপাস’ জীবনে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করেছিলেন, তাই কখনো তিনি কোনো অবস্থায় পরাজিত হননি। বঙ্গবন্ধু সেই ব্যক্তিত্ব যিনি মিথ্যাকে চরমভাবে ঘৃণা করতেন, কঠোর পরিশ্রম করতেন এবং আমৃত্যু মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন। মহান আল্লাহ তাকে দুনিয়ায় করেছেন সম্মানিত এবং মৃত্যুর পর দিয়েছেন অমরত্বের মর্যাদা।

ইতিহাসের অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন ১৭ মার্চ, ১৯২০। মহান পুরুষের জন্মদিন, যার নামের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির আত্মপরিচয়। তিনি সেই মহান পুরুষ, যাকে নিয়ে বাঙালির অহঙ্কার কোনো দিন ফুরোবে না। এমনই বিশাল ব্যক্তিত্ব তিনি, মৃত্যুর চার দশক পরও তাকে আবিষ্কার করতে হয় নতুন করে। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাঙালি জাতিকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন অসম্ভবের পথ। আমাদের দিয়ে গেছেন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। গতকাল ছিল ইতিহাসের অমর মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন।

বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা সায়রা খাতুন আদর করে ডাকতেন খোকা। পিতা-মাতার চার কন্যা এবং দুই পুত্রের সংসারে খোকা ছিলেন তৃতীয়। খোকা নামের সেই শিশুটি পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালির মুক্তির দিশারী। গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আত্মত্যাগ এবং জনগণের প্রতি মমত্ববোধের কারণে পরিণত বয়সে হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। এক রাজনৈতিক সংগ্রামবহুল জীবনের অধিকারী এই নেতা বিশ্ব ইতিহাসে ঠাঁই করে নেন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার হিসেবে। খুব ছোট থাকতেই বঙ্গবন্ধুর মা একদিন দেখেন, ‘তার খোকা চাদর জড়িয়ে হেঁটে আসছে। পরনে পায়জামা, পাঞ্জাবি নেই, কি ব্যাপার? এক গরিব ছেলেকে পরিহিত তার শতচ্ছিন্ন কাপড় দেখে সব দিয়ে এসেছে।’ কোনোদিন দেখলেন, কোনো ছেলে টাকার অভাবে ছাতা কিনতে পারে না, রোদ-বৃষ্টিতে ভারি কষ্ট পায়, অমনি তার ছাতাটা দিয়ে দিতেন। কিংবা টাকার অভাবে কোনো ছেলে বইপত্র কিনতে পারছে না, দিয়ে দিলেন তার নিজের বইপত্র। বঙ্গবন্ধু আজ বাহ্যিক শরীরে আমাদের সামনে নেই তবুও তার দেখানো আদর্শগুলো আমাদের সামনে সর্বদা বিরাজমান।

গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। এরপর থেকে শুরু হয় তার বিপ্লবের জীবন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় গ্রাম থেকে লাখ লাখ লোক শহরের দিকে ছুটেছে স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে। খাবার নেই, কাপড় নেই। ইংরেজরা যুদ্ধের জন্য সব নৌকা বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছে এবং সৈন্যদের খাওয়ানোর জন্য গুদাম জব্দ করেছে। সেই অল্প বয়সেই বঙ্গবন্ধু দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় দিন-রাত এক করে কাজ করেছেন। মানুষের সেবার জন্য বিশ্রাম নেওয়া ভুলে গিয়েছিলেন। অনেক রাত তিনি লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন। একটি জাতির আত্মানুসন্ধান তিনি হয়তো যুবক বয়স থেকেই শুরু করেছিলেন।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য বঙ্গবন্ধুর অবদানকে আমরা অনেকেই এড়িয়ে যাই কিংবা জানার চেষ্টা করি না। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ যখন জিন্নাহ ঢাকার ঘোড়দৌড় মাঠে ঘোষণা করলেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, তখন তরুণ শেখ মুজিবসহ অনেক ছাত্র চিৎকার করে জানিয়ে দিয়েছিল, ‘মানি না’। এরপর আমৃত্যু জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্র্র্রভাষা করার কথা আর বলেননি। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি বিকালে পল্টন ময়দানে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন জানাল, উর্দুই হবে এক মাত্র রাষ্ট্রভাষা। সেই সময় বঙ্গবন্ধু কারাবন্দি হিসেবে হাসপাতালে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রাত একটার পর তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহবুবসহ আরও অনেকে। সেই রাতেই বঙ্গবন্ধু সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের হুকুম দিয়েছিলেন এবং পরের রাতে তাদের আবার আসতে বললেন। সেখানেই ঠিক হয়েছিল ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে। আজ আমরা একটি বারও বলি না ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস কে (কাদের বৈঠকে) নির্ধারণ করেছিলেন?

পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটায় হক, ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট। বঙ্গবন্ধু যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালির এই বিজয়কে মেনে নিতে না পেরে ৯২-ক ধারা জারি করে সরকার অপসারণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন সংগঠনে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলের একটি কনভেনশনে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফা ঘোষণা করেন। ওই ৬ দফা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভিত কাঁপিয়ে দেয়। শেখ মুজিবের কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে জেনারেল আইয়ুব খান একটার পর একটা মামলা দিয়ে তাকে গ্রেফতার করতে থাকেন। পূর্ব পাকিস্তানে ৬ দফার পক্ষে ব্যাপক গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। সেই সময় রাজনীতির প্রধান আলোচিত বিষয় হয় ৬ দফা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সঙ্গীদের নামে আইয়ুব খান তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করেন। বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় গোটা বাঙালি জাতি। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাঙালি তাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে মুক্ত করে আনে। বাঙালি জাতি তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করে। এর পর যে ইতিহাস রচিত হলো, সে ইতিহাস সবারই জানা।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে বাঙালির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ হয়ে যায়। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ শুরু করলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাসভবন থেকে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বীর বাঙালি ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে নেয়। জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর জন্মদিনটি সেদেশে শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। আর একটি স্বাধীন দেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটিও আমাদের দেশে শিশু দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।

পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান চিত্রায়িত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর কারণেই। বিশ্বসভায় বাঙালি জাতির সগর্ব উপস্থিতিই স্মরণ করিয়ে দেয় বঙ্গবন্ধুকে। এ অবিভাজ্য অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি নেই। সংগ্রামী জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে তার অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। আর এই দেশের ভূখণ্ড থেকে শুরু করে তাপক্লিষ্ট, কুলি-কামিন, মজুর, কৃষাণ-কৃষাণী, জেলে-বাওয়ালী, বঞ্চিত শ্রেণির মানুষ ছিল তার রাজনীতির অবলম্বন। এদের জন্যই তিনি লড়েছেন। শৈশব থেকে আমৃত্যু দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে কাজ করেছেন তিনি। জাতি-বর্ণ, বিভেদ বৈষম্য তার কাছে ছিল না। বঙ্গবন্ধু ৭ কোটি ৫০ লাখ মানুষের জীবনকে দিয়েছেন নতুন পথের দিশা। বঙ্গবন্ধু আমাদের কাছে কোনো পুরস্কার চাননি। তার জন্মই হয়েছিল মানুষের কল্যাণের জন্য, নির্যাতিত মানুষের মুক্তির জন্য।

রিয়াজুল হক : উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।
[email protected]

 
Electronic Paper