ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নারীর মূল্য নিয়ে অমূল্য কথা

আশেক মাহমুদ
🕐 ৮:৫০ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৭, ২০১৯

আদিকাল থেকে নারী জাতি চরম অবহেলা, লাঞ্ছনা, নির্যাতন, নিপীড়ন আর বঞ্চনার শিকার-এ যেন চরম বাস্তবতা। সেই বাস্তবতার নিরিখে নারীর মূল্য কতখানি তা বুঝতে কারও অসুবিধা হয় না। কে নারী জাতিকে এই চরম পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে যেমন বিতর্ক আছে, তেমনি কে নারী জাতির মুক্তির জন্য কাজ করে যাচ্ছে তা নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই।

পুরুষতন্ত্র যে নারী অধিকার অপহরণের প্রধান কারণ এ কথা বহুল আলোচিত ও বহুভাবে বিবৃত, আর এ কারণে পুরুষ হয় বিশদাকারে ধিকৃত। দার্শনিক প্লেটো নিজেই একজন গ্রিক, একজন স্বাধীন মানুষ এমনকি একজন পুরুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছেন বলে অফুরান সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এর মানে এই যে, নারী মানে পরাধীন সত্তা, নারী মানে অধীন আর নারী মানে পুরুষের কাছে আজীবনের বশ্যতা। সেদিকে লক্ষ্য করে কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র প্রচলিত সমাজে নারীর মূল্য কিরূপ তার চিত্রায়ন করেন এভাবে- ‘নারী কি পরিমাণ সেবাপরায়ণ, স্নেহশীলা, সতী ও দুঃখ কষ্টে মৌনা; কি পরিমাণে মানুষের সুখ ও সুবিধা ঘটিবে আর কি পরিমাণে তারা রূপসী! এখানেই নারীর মূল্য!’ তাহলে নারী কি এভাবে অধীনতার নিগড়ে আবদ্ধ থাকবে? এই প্রশ্ন থেকে নারী মুক্তির চর্চা চলতে থাকে।

এ কথা অধিক জনপ্রিয় হয়েছে যে-নারী অধিকার পূরণে সর্বাধিক ভূমিকা রেখেছে আধুনিকায়ন। কিন্তু শিল্পায়ন, নগরায়ন, আধুনিক শিক্ষার সম্প্রসারণ এমনকি মিডিয়া ও পুঁজির বিশ্বায়ন যে নারীর মুক্তির পথে কাজ করছে তা নিয়ে দ্বিধা বাড়ছে বৈ কমছে না। আধুনিকতার তত্ত্ব নির্মাতা সমাজবিজ্ঞানী টেলকট পারসন্স ও ইমাইল ডুরখেইম নারীদের চিত্রিত করেছে অতি আবেগধর্মীরূপে, অন্যদিকে পুরুষদের দেখানো হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক সাধনার পুরোধারূপে। ডুরখেইম বোঝাতে চেয়েছেন, আধুনিক সভ্যতাকে নির্মাণ করে চলছে পুরুষ, নারী নয়। কারণ তার মতে, পুরুষের রয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা আর নারীর রয়েছে ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তি। একদিকে ডুরখেইম ব্যক্তিকে ঈশ্বরের জায়গায় উন্নীত করেন, অন্যদিকে ইন্দ্রিয়প্রবণরূপে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে নারীকে করেন সভ্যতা ও পুরুষের অনুগ্রহভাজন ও আজ্ঞাবহ।

হ্যাঁ, অনেকেই বলেন শিল্পায়ন ও আধুনিক শিক্ষা নারীদের দিয়েছে অনাবিল স্বাধীনতা, মুক্ত করেছে ঘরোয়া বন্দিত্ব থেকে। এদিক থেকে বলা হয় আধুনিকতার সম্প্রসারণে শিক্ষা ক্ষেত্রে, চাকরি ও রাজনৈতিক পদাধিকারে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি প্রমাণ করছে নারীদের আর অবরুদ্ধ করে রাখা যায় না। তখন পাশ্চাত্য দাবি করে বসে-শিল্পায়নই নারীর মুক্তির জন্য অধিক মাত্রায় এগিয়ে আসে। এ কথায় আপত্তি করে প্রাচ্যের দার্শনিক মুর্তজা মোতাহহারী বলেন, শিল্পায়ন নারীদের মুক্তির জন্য এগিয়ে আসেনি, কেননা দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধে লাখ লাখ শ্রমিক মারা যাওয়ায় শিল্পায়ন সংকটে পড়ে যায়। সেই সংকট কাটাতে পুঁজিপতিরা নারীদের স্বল্প মজুরিতে নিয়োগ দেয়। এর মানে, মুনাফার তাড়নায় পুরুষ পুঁজিপতিরা নারী মুক্তির আওয়াজ তোলে। এর ফলে ডুরখেইমের ভাষানুযায়ী পুরুষের বুদ্ধিবৃত্তির জয়ধ্বনি বাড়তে থাকে আর নারী চিত্রিত হয় অনুগ্রহভাজন হিসেবে।

বাংলাদেশ এ থেকে ব্যতিক্রম নয়। এ দেশের অর্ধেকই যেখানে নারী সেখানে সবক্ষেত্রে নারীর সমহারে অংশগ্রহণের সুযোগ সুনিশ্চিত করা সাংবিধানিক অধিকার হয়ে গেছে। শিক্ষা, পেশা এমনকি রাজনৈতিক অংশগ্রহণে নারীর অংশগ্রহণ বেড়ে চলছে-এ কথায় কারও কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু আমরা কি শুধু মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকব, নাকি গুণবিচারকে গুরুত্ব দেব? আমরা জয়োল্লাস করি এই বলে যে, ৮০% নারী শ্রমিক গার্মেন্টসে কাজ করছে। কিন্তু আমরা ভুলে গেছি এর অন্তরালে কি আছে? সমাজ বিজ্ঞানী স্টপার অ্যান্ড ওয়াকার এ বিষয়ে উল্লেখ করেন, তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বে বিনিয়োগের মূল কারণ সবচেয়ে সস্তা মজুরি ও আনুগত্যের সংস্কৃতি। এই নারী শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে মালিক শ্রেণির শোষণ, বঞ্চনা ও অবিচার বেড়ে চলছে দ্রুত গতিতে। এর অর্থ দাঁড়ায়, পুরুষদের কৌশলের কাছে হার মেনে যায় নারীর অস্তিত্ব।

আমরা আরও একধাপ এগিয়ে বলি-বহুজাতিক কোম্পানিগুলোতে এমনকি মিডিয়া জগতে নারী দাপট বেড়ে চলছে। ব্যাপকহারে বেড়ে চলছে নারীর শিল্পচর্চা। কিন্তু প্রাক আধুনিক যুগে নারীর রূপে মুগ্ধ হয়ে নারীকে ঘরোয়া করত যে পুরুষ, সেই পুরুষই কালের আবর্তে নারীদের পেশাক্ষেত্রে নিয়ে এসেছে গণপুরুষদের মোহাচ্ছন্ন করে রাখার জন্য। আর তাই দেশি-বিদেশি মিডিয়াতে নারীকে হাজির করা হয় কামনার মোহনীয় বস্তুরূপে, লালসার সামগ্রীরূপে, যাতে করে পুরুষদের হৃদকম্পনটা বাড়িয়ে দেওয়া যায়, পুরুষদের বহুগামিতা বাড়িয়ে হোটেল ব্যবসা আরও পাকাপোক্ত করা যায়। এ কারণে নারীকে কিভাবে সেরা আবেদনময়ী করা যায় সে চেষ্টায় মুনাফাখোররা মিডিয়াকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। এভাবেই আধুনিককালে প্রভাবিত নারীরা পাবলিক পুরুষতন্ত্রের বলি হয়ে গেছে।

মূলত নারী মুক্তির যে দুটি দেয়াল আছে তা না ভাঙলে অনন্তকাল ধরে বিশ্ব নারী দিবস পালন করা হবে, মুক্তি মিলবে না আদৌ। একটি হলো ‘পুঁজি’ নামক বাহ্যিক দেয়াল। যে পুঁজির নিগড়ে বন্দি করা হচ্ছে শ্রম, মেধা আর ‘রূপ’। অন্যটি আরও বিপজ্জনক, তা হলো ‘লালসা’। মূলত নারীর অগ্রযাত্রার প্রধান বাধা পুরুষের লালসা, যে কারণে পুরুষ নারীকে সর্বদা দাসীও কামনার সামগ্রীরূপে দেখেছে। কিন্তু তাই বলে পুরুষকে মুক্তপ্রজাতি বলা যাবে না। কেননা পুরুষ নিজেই তার অভ্যন্তরীণ কামনা ও লালসার দাস। আর তাই মানুষের মনোবৃত্তির সুস্থ বিকাশ ও সংস্কার না করে নারী মুক্তির গুঞ্জন করে কোনো লাভ নেই।

নারী ও পুরুষ উভয়ের সুস্থ বিকাশের জন্য চাই এই দুই ড্রাগন থেকে মুক্তি। কিন্তু সেই মুক্তির দিশা দেখাতে পাশ্চাত্য ব্যর্থ হয়েছে। জোসেফ ক্যাম্পবেল এ প্রসঙ্গে বলেন-‘পাশ্চাত্যের সবচেয়ে বড় ড্রাগন হলো ‘লালসা’। সেই লালসার হাত থেকে মুক্তির কোনো পথ না দেখিয়ে শুধু ‘পুঁজি’র বিরুদ্ধে স্লোগান তুলে লাভ নেই। কারণ পুঁজির পতন হলেও লালসার দাপটে মানুষ হতে পারে বড় আকারের স্বৈরাচারী। যার হাত থেকে কি নারী কি পুরুষ কারও নিস্তার নেই। নারী মুক্তির শত্রু পুরুষ নয়; লালসাময়ী পুরুষ, অসচেতন নারী ও ক্লিব ধরনের ‘পুঁজি’। নারীর মূল্য যে কত অমূল্য তা বুঝতে যে হৃদয়ের দরকার সে অমূল্য হৃদয়ের আজ বড়ই অভাব।

আশেক মাহমুদ : সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
[email protected]

 
Electronic Paper