ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ওরা টাকা দিয়ে নিজের কবর কিনছে

তৌহিদ-উল ইসলাম
🕐 ৯:৫৩ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৩, ২০১৯

দৈনিক খোলা কাগজে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে অধ্যাপক আশেক মাহমুদের ‘কবর প্লটের দাম সাড়ে তিন লাখ টাকা’ শিরোনামে প্রকাশিত লেখাটা আমার চোখে পড়ে। সম্প্রতি রিহ্যাব মেলার ৩১নং স্টলে এমআইএস হোল্ডিংস পূর্বাচলে ২০০ বিঘা জমির ওপর ৭ ফুট দৈর্ঘ্য ও সাড়ে তিন ফুট প্রস্থের ৮ হাজার কবরের প্রকল্প হাতে নেয়। লেখাটা পড়ে আমার প্রথমেই যাদের কথা মনে পড়েছে তারা হলেন- ড. আহমদ শরীফ, আরজ আলী মাতুব্বর ও বরেণ্য কবি নির্মলেন্দু গুণ।

ড. আহমদ শরীফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রখ্যাত অধ্যাপক ও বাংলা ভাষা-সাহিত্যের অন্যতম গবেষক ছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি তার চোখ দুটি যেমন দান করে গেছেন অন্ধ চোখের আলো জ্বালাবার জন্য, আবার দেহটাও দান করে গেছেন মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের শিক্ষার কাজে ব্যবহারের জন্য। তিনি উইলে স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন, ‘আমার মৃত্যুর পর জানাজার কোনো প্রয়োজন নেই।’

এ প্রসঙ্গে কবি নির্মলেন্দু গুণ তার এক লেখায় এভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘আমি বিস্ময়ে অভিভূত বোধ করেছি, যখন এই বাক্যটি আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে। মনে হচ্ছিল, আমি হাজার বছর ধরে এমন বাক্য উচ্চারিত হতে শুনিনি। না কোনো হিন্দুর মুখে, না কোনো মুসলমানের মুখে, না কোনো খ্রিস্টানের মুখে। ভাবলাম, ভুল শুনিনি তো! আমি আমার কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমাদের বিঘোষিত কমিউনিস্টরা পর্যন্ত যখন ধর্মীয় আচারের হাতে সমর্পণ করে যান নিজেদের, তখন শরীফ স্যার তার অনন্ত যাত্রাপথে উড়াল দেওয়ার আগে আমাদের এ কী শুনিয়ে গেলেন! মেডিকেল কলেজের হাতে তার মরদেহ হস্তান্তরের আগমুহূর্তে শহীদ মিনারে তার সম্পাদিত ঐতিহাসিক উইলটি পাঠ করে শোনান আমার বন্ধু নাট্যকার মামুনুর রশীদ।’

শ্রদ্ধাভাজন কবি জানেন, তার স্যারের ঐতিহাসিক এ উইলটি কোথায় আছে? এবার যদি দয়া করে তিনি নিজেই একবার এ জাতিকে পড়ে তা শোনাতেন, তাহলে মধ্যম আয়ের এ জাতির কাউকে সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়ে কবর কিনতে হতো না। আমার গ্রামে সাড়ে তিন লাখ টাকায় ১ বিঘে জমি হয়। যাতে ৫ গ্রামের মানুষের জন্য একটা কবর স্থান হতে পারে। তা ছাড়া আমাদের সমাজ থেকে এখনো ভিক্ষুক চলে যায়নি। একটা কবর কেনার টাকা হলে আমরা দু’চারটা গ্রাম ভিক্ষুকমুক্ত করতে পারি। আজ আমাদের মূল্যবোধ কোথায়?

আরজ আলী মাতুব্বরের গল্প আমরা জানি। এই দার্শনিক ও কালজয়ী লেখক তার মরদেহ মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের পড়াশোনার সাহায্যের জন্য উইল করে গেছেন, যা এখন বরিশাল মেডিকেল কলেজে সংরক্ষিত আছে। এঙ্গেলসের মরদেহ তার ঘোষণা অনুযায়ী সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। আইনস্টাইন জাতিতে ইহুদি ছিলেন। তিনি তার মরদেহ পুড়ে ছাই করে দেওয়ার কথা বলে গিয়েছিলেন এবং তাই করা হয়েছিল।

অধ্যাপক আশেক মাহমুদ চমৎকার অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন : ‘কবর প্লটের বিস্তারে মুনাফা ও নকল মর্যাদার যে সামাজিক চর্চা হবে, তার পরিণতি লালসালুর নকল মাজার কালচারের চেয়ে আরও বেশি ভয়াবহ হবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়।’

আমার মনে হয়, আমাদের কবর প্লট ক্রেতাসকল মুনীর চৌধুরীর ‘করব’ নাটক দেখেছেন। নাটকে মুরদা ফকির সব সময়ই কবরস্থানে পড়ে থাকত। কারণ মৃত্যুর পর যদি কেউ তাকে কবর না দেয়, তাহলে মৃত্যুর সময়ে হুট করে সে যেন একটা কবরে ঢুকে পড়তে পারে। অবস্থাটা ঠিক যেন তাই। ওরা আশঙ্কা করছে, যে হারে জমিজমা কমছে, তাতে তাদের মৃত্যুর পর ওদের মরদেহ কেউ হয়তো দাফন করতে চাইবে না! তাই আগেভাগেই তা কিনে রাখছে।

কিন্তু তা কী করে হয়? ওটা তো ফরজে কেফায়া-দায়টা ওই সমাজের মানুষের ওপর। দেশ ও সমাজের জন্য একজন জীবিত ব্যক্তির অনেক দায়িত্ব থাকে। কিন্তু মৃতের ওপর তো কোনো দায়িত্ব নেই। এই মরদেহ সৎকারের দায়িত্ব সমাজের ওপর। আর সেটা যদি বেওয়ারিশ লাশও হয়, তাতেও কোনো সমস্যা নেই। কেননা, আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম তো আছেই।
ভয় হচ্ছে, আমি আবার সম্মানিত কবর ক্রেতাদের আত্মসম্মানে আঘাত করলাম না তো! তবে হয়তো রাজধানী ঢাকার ব্যাপারটা আলাদা। কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র মরার জাত নিয়ে যাই বলুক না কেন, কবরের বাসিন্দাদের মধ্যে জীবনমানের একটা পার্থক্য তো আছেই। যার ঢাকায় একটা ফ্ল্যাটবাড়ি আছে, তার ঢাকায় কবর থাকবে না-তা কী করে হয়!

দেশের অন্যতম প্রধান কবি নির্মলেন্দু গুণ তার মৃত্যুর পর ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের আবশ্যিকতা মনে করেন না। এ ব্যাপারে তিনি তার মেয়ে মৃত্তিকাকে বলে যাবেন, এমন কথা জানিয়েছেন। আর একটা চোখ তো তিনি দিয়েই যাবেন দৃষ্টিহীনা কোনো এক নারীর জন্য। তার কবিতা দিয়েই শেষ করছি আমার এ ক্ষুদ্র লেখা-
‘নেই স্বর্গলোভ কিংবা কল্প নরকের ভয়
অলীক সাফল্যমুক্ত কর্মময় পৃথিবী আমার।
চর্মচোখে যা যা দেখি, শারীরিক ইন্দ্রিয় যা ধরে,
তাকেই গ্রহণ করি। জানি নিরাকার অপ্রত্যক্ষ
শুধুই ছলনা, বিশ্বাস করি না ভাগ্যে, দেবতার বরে।

তৌহিদ-উল ইসলাম : শিক্ষক, গীতিকার ও শিশুসাহিত্যিক

 
Electronic Paper