ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কিডনি ফাউন্ডেশন গরিবের জন্য : ডা. হারুন অর রশিদ

ছাইফুল ইসলাম মাছুম
🕐 ১০:১০ অপরাহ্ণ, মার্চ ১২, ২০১৯

কিডনি চিকিৎসায় বাংলাদেশের অন্যতম পথিকৃৎ অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশিদ। তার হাতে শুরু হয় দেশের প্রথম কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন এবং কিডনিবিষয়ক প্রথম সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস। বর্তমানে কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করছেন। খোলা কাগজের পক্ষ থেকে তার মুখোমুখি হয়েছেন- ছাইফুল ইসলাম মাছুম

বাংলাদেশে কিডনি চিকিৎসায় কিডনি ফাউন্ডেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এর শুরুর গল্প জানতে চাই...
আমার কর্মজীবন শুরু হয়েছে ১৯৮২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজে। তখন থেকে আমি সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক হিসেবে কাজ করে গেছি। পরে ১৯৯৯ সালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেসের প্রথম প্রজেক্ট পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলাম। প্রতিষ্ঠানটি অনেকটা আমার নিজের উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল। যখন অবসরে যাচ্ছি তখন তিন বন্ধু পরিকল্পনা করলাম, গরিব এবং মধ্যবিত্তের জন্য নিজেরা স্বাধীনভাবে কিছু করব। ২০০৩ সালে তিন বন্ধুর জমানো ৭৫ হাজার টাকা দিয়েই শুরু হয় কিডনি ফাউন্ডেশনের পথচলা। ধানমন্ডিতে ভাড়া বাসায় ধার করা ছয়টা ডায়ালাইসিস মেশিন নিয়েই বেড়ে ওঠে এই অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। কম খরচে চিকিৎসাসেবা প্রদান করায় আস্তে আস্তে এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠল। পরে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, ব্যাংকসহ বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান সহযোগিতায় এগিয়ে আসে।

২০০৬ সাল থেকে আপনারা কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন সার্জারি শুরু করেছেন। সফলতা কেমন পাচ্ছেন?
তিন বছরের মাথায় কিডনি ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম আরও প্রসারিত হয়। আমরা কম খরচে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন সার্জারি শুরু করি। বেশ সফলতাও আসে। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০০ কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন এখানে হয়েছে। কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন সার্জারিতে আমাদের সফলতার হার ৯৮ ভাগ।

কিডনি চিকিৎসার পাশাপাশি সংস্থাটি আর কী কাজ করছে?
কিডনি চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা করছি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় করছি। চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে আমরা গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিকের কাজ করার উদ্যোগ নিচ্ছি।

সংস্থার বর্তমান অবকাঠামোর অবস্থা ও স্টাফ কেমন রয়েছে?
২০০৮ সালে আমরা সরকার থেকে মিরপুরে দুই বিঘা জমি লিজ পাই। ওই জমিতে এখন কিডনি ফাউন্ডেশনের এই আটতলা ভবন। শুরুটা ৭ জন দিয়ে হলেও এখন ২১৫ জন স্টাফ কাজ করছে। কার্যক্রম বাড়াতে আমরা হাসপাতাল ভবনকে আরও ঊর্ধ্বমুখী করার পরিকল্পনা করেছি। ঢাকাতে রোগীর চাপ বেশি হওয়ায় আমাদের কার্যক্রম বিভাগীয় পর্যায়েও ছড়িয়ে দিচ্ছি। এখন পাবনায় ১৬ বেড, সিলেটে ৮ বেডসহ সিরাজগঞ্জ ও রাজশাহীতে আমাদের শাখা রয়েছে। মিরপুর কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালের ইনডোর ইউনিটে ১৫০টি বেড রয়েছে। তন্মধ্যে ১৬টি বেড আইসিইউ ট্রান্সপ্লান্টেশন সুবিধাযুক্ত, অপারেশন পরবর্তী ব্যবহারের জন্য রয়েছে ১৬টি বেড, নেফ্রোলজি আইসিইউয়ের জন্য রয়েছে ৪টি বেড এবং ডায়ালাইসিস ইউনিটের জন্য আছে ৪০টি বেড। এছাড়া এখানে ১৪টি কেবিন রয়েছে। এখানে রয়েছে ইন্টারভেনশনাল নেফ্লোলজী ইউনিট এবং রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং ইউনিট। ইমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্টে রয়েছে সার্বক্ষণিক কর্তব্যরত ডাক্তার।

অন্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে আপনাদের এখানে রোগীরা কী বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে?
প্রতিষ্ঠানটি শুরুর পর থেকে গরিব ও মধ্যবিত্তের কথা ভেবে আমরা কম খরচে চিকিৎসাসেবা প্রদানের চেষ্টা করে আসছি। তখন ডায়ালাইসিস করাতে বাইরে যেখানে ২৫০০ টাকায় হতো, সে সময় আমরা নিতাম মাত্র ৯০০ টাকা। দেশে আমরা প্রথম ব্লাড গ্রুপ মিল না থাকা সত্ত্বেও কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন করিয়েছি। আমাদের এখানে সব টেস্টে ৩০% ডিসকাউন্ট রয়েছে। বিশেষ করে ডায়ালাইসিস এবং ট্রান্সপ্লান্টেশন রোগীদের জন্য ৫০% ছাড় রয়েছে। অন্য প্রতিষ্ঠানে অনেক বেশি ভিজিট দিয়ে রোগী দেখাতে হয়, সেখানে আমরা রোগী দেখানোতে চার্জ নিচ্ছি মাত্র ১০০ টাকা। আমরা হিসাব করেছি, গত ১৫ বছরে অন্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় যে মূল্য ছাড় দিয়েছি। এতে রোগীরা যে আর্থিক লাভবান হয়েছে, তার পরিমাণ ৯৯ কোটি টাকা।

বাংলাদেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা এখন কত?
আমরা হিসাব করেছি, বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ থেকে ২ কোটি লোক কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে আক্রান্ত। সে হিসাবে ১৭ থেকে ১৮ ভাগ মানুষ কিডনি রোগী। মানুষের ডায়াবেটিস, হাইপ্রেসার বেড়ে যাচ্ছে। এগুলোর সঙ্গে কিডনি রোগের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।

কিডনি রোগ প্রতিরোধে আমাদের কী করণীয়?
শিশু যেন ফাস্টফুড খাবার না খায়, মোটা যাতে না হয়, সেদিকে মায়েদের খেয়াল রাখতে হবে। শরীরে কোনোভাবে চর্বি বাড়ানো যাবে না। ৪০/৫০ বছরের পর থেকে আপনাকে চিনি খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে। লবণ কম খেতে হবে। তেল খাওয়া কমিয়ে আনতে হবে। প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ মিনিট হাঁটাহাঁটির অভ্যাস রাখতে হবে। প্রতিদিন অনন্ত ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। ভাত খাওয়া কমিয়ে অন্য খাবারের ওপর নজর দিতে হবে। ফলমূল শাক-সবজি বেশি খেতে হবে। এতে শরীর সুস্থ থাকবে, স্বাভাবিক থাকবে। ডায়াবেটিস হবে না, হাইপ্রেসার হবে না, কিডনিও ভালো থাকবে।

কিডনি রোগ নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে কোনো ভুল ধারণা কাজ করে কি?
অসংখ্য ভুল ধারণা রয়েছে। অনেকে মনে করেন, কিডনি রোগ মানে কিডনি শেষ। শরীরে একটু পানি এসেছে ধরে নেয় কিডনি রোগ হয়ে গেছে। তারা খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। এমন অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। ভুল ধারণা সাধারণত মানুষের সচেতনতার অভাবে হয়। সচেতনতা বাড়িয়ে মানুষের ভুল ধারণা দূর করতে আমরা কাজ করব।

কিডনি রোগের শতভাগ চিকিৎসা কি বাংলাদেশে সম্ভব?
অবশ্যই শতভাগ চিকিৎসা সম্ভব। তবে মৃত ব্যক্তির কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন এখনো করা হচ্ছে না। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি।

এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কত মানুষ উপকৃত হয়েছে?
আমরা হিসাব করে দেখেছি, সারা বছরে ৫৫ হাজার রোগী আউটডোরে সেবা নেয়। প্রতিবছর এক লাখ ল্যাবরেটরি টেস্ট হয় এখানে। যাত্রার শুরু থেকে হিসাব করলে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ উপকারভোগীর সংখ্যা অনেক।

কিডনি ফাউন্ডেশন কিডনি চিকিৎসা ও গবেষণার জন্য সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। সে সম্পর্কে জানতে চাই...
কিডনি চিকিৎসার জন্য আমরা ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটির সর্বোচ্চ স্বীকৃতি পেয়েছি। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব কিডনি ফাউন্ডেশন ২০১৩ সালে বাংলাদেশে রেফারেল সেন্টার হিসেবে আমাদের কিডনি ফাউন্ডেশনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সারা পৃথিবীর কিডনি চিকিৎসার ১০টি রেফারেল সেন্টারের মধ্যে আমাদের প্রতিষ্ঠান একটি। এছাড়া রিসার্চের জন্য কোরিয়া আনাম ইউনিভার্সিটিসহ অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের চুক্তি রয়েছে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাই...
আমাদের সেবা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে কাজ করতে চাই। যাতে গরিব ও মধ্যবিত্ত রোগীরা উপকৃত হতে পারে।

অন্য পেশায় না গিয়ে আপনি চিকিৎসা পেশায় এসেছেন-এর পেছনে বিশেষ কোনো কারণ রয়েছে?
আমার পড়াশোনা বেড়ে ওঠা পাবনায়। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছিলাম, প্রায় মৃত অবস্থা থেকে স্থানীয় এক চিকিৎসকের চিকিৎসাসেবায় সুস্থ হয়ে উঠি। তখন ভাবলাম চিকিৎসা পেশায় যাওয়া যেতে পারে। এই পেশার মাধ্যমে মানুষের উপকার করা যাবে। ছোটবেলার ভাবনার কারণেই পাবনা জেলা স্কুল, পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ শেষ করে রাজশাহী মেডিকেলে পড়াশোনা করি। রাজশাহী মেডিকেলে প্রথম হই।
পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ থেকে এফসিপিএস। ১৯৭৭ সালে স্কলারশিপে ইংল্যান্ডে যাই, ওখানে পিএসডি করি। ওখানে কিডনি রোগের ওপর হায়ার ট্রেনিং নিই। পরে ১৯৮২ সালে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজে। তখন দেশে প্রথম কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের উদ্যোগ গ্রহণ করি এবং সফলভাবে সম্পন্ন করি।

 
Electronic Paper