রাজধানীর বায়ুদূষণ ও আমাদের দায়
আবু আফজাল সালেহ
🕐 ৯:৫৫ অপরাহ্ণ, মার্চ ১১, ২০১৯
বিভিন্ন দেশের বাতাসের মান নিয়ে গবেষণা করে আসছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার। সম্প্রতি বৈশ্বিক বায়ুমান প্রতিবেদন-২০১৮ প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিবেদন তৈরিতে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের তিন হাজারের বেশি শহরের বাতাসের মান পর্যবেক্ষণ করেছে। মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদানগুলোর অন্যতম বাতাসে বিদ্যমান পিএম২.৫ (পার্টিকুলেট ম্যাটার) বা অতিসূক্ষ্ম বস্তুকণা। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মান অনুযায়ী প্রতি ঘনমিটার বাতাসে এর সহনীয় মাত্রা ১০ মাইক্রোগ্রাম। যদিও ঢাকার বাতাসে পিএম২.৫-এর মাত্রা এ মানের অনেক ওপরে, প্রতি ঘনমিটারে ৯৭ মাইক্রোগ্রামের বেশি। বিভিন্ন দেশের রাজধানীর বায়ুমান বিবেচনায় এটা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। রাজধানীগুলোর মধ্যে এর চেয়ে বেশি পিএম২.৫-এর উপস্থিতি আছে কেবল দিল্লির বাতাসে। এ হিসাবে দিল্লির পর ঢাকা হচ্ছে সবচেয়ে দূষিত বাতাসের রাজধানী।
ঢাকা শহরের ছয়টি বিদ্যালয়ের শিশুদের ফুসফুসের কার্যকারিতা নিয়ে ২০১৬ সালে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছিল বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির আরবান ল্যাব। ফলাফলে দেখা যায়, বিদ্যালয়গুলোর ২৫ শতাংশ শিশুর ফুসফুস পূর্ণমাত্রায় কাজ করছে না। তাদের ফুসফুস ৬৫ থেকে ৮০ শতাংশ কাজ করছে। কয়েক বছর ধরেই ঢাকার বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি সহনীয় মাত্রার ওপরে রয়েছে। ক্ষতিকর বস্তুকণার এ উপস্থিতি না কমে উল্টো বাড়ছে। ২০১৭ ও ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসের তথ্য বিশ্লেষণেও দেখা যায়, ঢাকার বাতাসে অতিসূক্ষ্ম বস্তুকণার পরিমাণ বেড়েছে।
বায়ুদূষণের জন্য দায়ী অনেক কিছু। যানবাহনের ধোঁয়া ও ইটভাটা মূলত রাজধানীর বায়ুদূষণের প্রধান কারণ বলে গবেষণায় জানা যায়। তবে রাজধানীর বা আশপাশের ইটভাটাগুলো দায়ী বেশি। গবেষণায় পাওয়া গেছে ঢাকার বায়ুদূষণের শতকরা ৬২ ভাগ দায়ী এ কারণ দুটো। ইটভাটাগুলো বায়ুদূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা ৩৪ ভাগ এবং মোটরযান ১৮ ভাগ দায়ী বলে এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে। বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণ অনেক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, শুধু ঢাকাতেই এক বছরে ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সারা দেশের শহরাঞ্চলে মারা গেছে ৮০ হাজার। পরিবেশ দূষণের সমন্বিত নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবনের ওপর।
বাংলাদেশে বায়ু, পানি ও পরিবেশ দূষণে বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২.৭ ভাগ। পরিবেশ দূষণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু, রোগী আর বৃদ্ধরা। শুধু বায়ুদূষণে ক্ষতি হয় ২০ হাজার কোটি টাকা। ঢাকা শহরের ৬ লাখ মানুষ এখন সিসা দূষণের কবলে। ঢাকার পরই নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার। ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে বায়ুদূষণ সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
স্বাস্থ্যবিদদের অভিমত হচ্ছে, বায়ুতে থাকা সিসা মস্তিষ্কের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সিসার উপস্থিতির প্রভাবে মানুষ দ্রুত বুড়িয়ে যায়, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যায়। বিশেষ করে শিশুরা দুর্বল বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বেড়ে ওঠে। এ ছাড়া বায়ুতে থাকা ক্ষতিকর বস্তুকণা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করলে ফুসফুস শক্ত হয়ে অক্সিজেন প্রবেশে বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে ক্যান্সারসহ নানা রোগ জন্ম নেয়। বাতাসে সহনীয় মাত্রার অতিরিক্ত অতিসূক্ষ্ম এ বস্তুকণা স্বল্প মেয়াদে মাথাব্যথা, শ্বাসতন্ত্রের রোগসহ নানা ব্যাধির জন্য দায়ী বলে জানান চিকিৎসকরা। এর প্রভাবে দীর্ঘমেয়াদে ফুসফুস ক্যান্সার, কিডনিসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অনেক অঙ্গও ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে মনে করেন তারা। বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি শ্বাসতন্ত্রের রোগ হয়। হাঁপানির রোগী হলে তাদের হাঁপানি বেড়ে যায়। আবার অনেকে নতুন করে হাঁপানি, শ্বাসতন্ত্রের অ্যালার্জি, হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত হয়। যক্ষ্মার মতো রোগগুলো বায়ুদূষণের কারণে বেড়ে যায়। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ বেড়ে যায় নবজাতক ও শিশুদেরও। ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্যও দায়ী বায়ুদূষণ।
ইট প্রস্তুতের ধরন ও আগে-পরের বিষয়/পদ্ধতি নিয়ে পূর্বের ইট প্রস্তুত আইন ২০১৩ সংশোধন করা হয়েছে। ইটের বিকল্প হিসেবে ব্লক পদ্ধতিকে যাতে প্রমোট করা হয়, আইনের বিভিন্ন ধারায় তা সংযোজন করা হয়েছে। মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরির বিকল্প হিসেবে অপোড়ানো পদ্ধতি ব্লকের দিকে যেতে হবে। এ জন্য আইনটি ব্যাপকভাবে আলোচনা ও পর্যালোচনা করে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু বড় চিন্তার জায়গা হলো নির্মাণকাজ। যে যেভাবে পারছে নির্মাণকাজ করছে। এজন্য যুগোপযোগী আইন ও নীতিমালা তৈরি করতে হবে। যত্রতত্র ও ‘যে যেভাবে পারে’ নির্মাণকাজ থেকে বিরত থাকার জন্য প্রশাসনকে বা কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু মুনাফার কথা না ভেবে মালিক/সমিতি/ডেভেলপারদের দেশ ও ভবিষ্যতের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
আইকিউএয়ারের প্রতিবেদনও বলছে, বছরে সাত লাখ অপরিণত মৃত্যুর জন্য দায়ী বায়ুদূষণ। বর্তমান বিশ্বে মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ এটি। বায়ুদূষণের অর্থনৈতিক ক্ষতিও ব্যাপক। ভয়াবহ বায়ুদূষণের কবলে আমাদের প্রিয় রাজধানী ঢাকা। সর্বশেষ নরওয়েভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির সহযোগিতায় পরিবেশ অধিদপ্তরের শুষ্ক মৌসুমের গবেষণায় ঢাকার বায়ুদূষণের ভয়াবহতা উঠে এসেছে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত বায়ুমান যন্ত্রের রিপোর্টেও ভয়াবহতা উঠে এসেছিল।
বায়ুদূষণের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে যানবাহনের ধোঁয়া। ফিটনেসবিহীন লক্কড়-ঝক্কড় যানবাহন থেকে বায়ু দূষণ বেশি হচ্ছে। এ বিষয়ে লেখালেখিও হচ্ছে প্রচুর। এখানেও একই অবস্থা। আইন আছে কিন্তু ঠিকমতো বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না বিভিন্ন কারণে। আমরা এক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন শহরের গৃহীত উদ্যোগ অনুসরণ করতে পারি।
নরওয়ের রাজধানীতে ডিজেল গাড়ি নিষিদ্ধের ব্যবস্থা করা হয়েছে ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি থেকে। অবশ্য অ্যাম্বুলেন্স ও অন্যান্য সরকারি পরিষেবার যানবাহন ডিজেল হলেও চলতে পারে। ২০১৯ সাল থেকে সিটি সেন্টারে সরকারি পার্কিং কমিয়ে দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। ২০২৪ সাল থেকে ফ্রান্সের রাজধানীতে ডিজেল গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ হবে; ২০৩০ সাল থেকে প্যারিসে ডিজেল বা পেট্রোল, কোনো ধরনের খনিজ তেলে চলা গাড়ি নিষিদ্ধ করা হবে।
ভারতের রাজধানী নতুন দিল্লি ধোঁয়ার জন্য আজ বিশ্বসেরা। দিল্লি একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পরিকল্পনা অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে দিল্লিতে যাবতীয় নতুন গাড়ি বিদ্যুৎচালিত হবে। ডিজেল বা পেট্রোলে চলা গাড়ি আস্তে আস্তে কমিয়ে জিরোতে আনতে এ পরিকল্পনা। আমাদের মতো করে আমরাও ভেবে দেখতে পারি দিল্লিকেন্দ্রিক এ পরিকল্পনা।
ঢাকার বাতাস ২৪ ঘণ্টাই বিপজ্জনক অস্বাস্থ্যকর। কিন্তু আগে থেকেই এ ধারা বজায় থাকলেও এর ভয়াবহতা নিয়ে বা জনসচেতনতা নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনা হচ্ছে কম। গণমাধ্যমকে বেশি পরিমাণে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের দুর্দিনে গণমাধ্যমের ইতিবাচক অনেক ভূমিকা থাকে। এ বিষয়েও উচ্চকিত দেশের গণমাধ্যম তা আমরা আশা করি। ভয়াবহতার অবস্থা তুলে ধরে সচেতনতার কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে করণীয় কী কী তা তুলে ধরতে হবে।
আবু আফজাল সালেহ : উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ
পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি), লালমনিরহাট।
[email protected]