বঙ্গকন্যার ধ্বনি সফল হোক
জামাল আস-সাবেত
🕐 ৯:৫০ অপরাহ্ণ, মার্চ ১০, ২০১৯
বাংলাদেশ নামক ছোট্ট এই দেশটাতে মানুষ গিজগিজ করছে। কত স্তরের মানুষ যে এখানে বসবাস করে তার কোনো ইয়ত্তা নেই! সমান করে দেখানো হয় সবার মাথাপিছু আয়। রাজধানীর বিভিন্ন বস্তিবাসীর দিকে তাকালে মনে হয় মাথাপিছু এই ডলারের হিসাবটার চেয়ে বড় মিথ্যা আর কিছু নেই। নিম্নআয়ের মানুষের সঙ্গে এটা এক ধরনের তামাশাও বটে!
কয়েকদিন আগে মোহাম্মদপুর থেকে মিরপুর বারো নাম্বারের বাউনিয়া বাঁধ গিয়েছিলাম। সেখানে দশ-বারো দিন থাকার সৌভাগ্যও হয়েছিল। মনের মধ্যে অনেকদিনের একটা ইচ্ছা ছিল, খুব কাছ থেকে বস্তিবাসীদের জীবনযাপন দেখা। মানুষ কতটা অসহায় হতে পারে, কতটা ধৈর্য নিয়ে বাঁচতে পারে-তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
আমরা বস্তিতে ঢুকি নাকে কাপড় দিয়ে, চোখে চশমা পরে। এমনকি আপাদমস্তক ঢাকা আছে কি না তাও দেখে নিই। কোনো দুর্গন্ধ যাতে নাকে না আসে, ময়লা বা ধুলাবালি যাতে চোখে না ঢুকে সেই সুরক্ষা নিশ্চিত করে যাই। অথচ আমাদের মতোই রক্তে-মাংসে গড়া এই মানুষগুলো দিনের পর দিন এই নোংরা পরিবেশে বসবাস করে চলছে!
বিশ্বাস করতে বাধ্য হই, মানুষ সব পারে। সব পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে। অতিকষ্টেও দিন কাটাতে পারে। এই বোধ এদের জীবনযাপন দেখেই অনুভব করতে পারলাম। এসব মানুষগুলোর চিন্তা-চেতনা ধ্যান-জ্ঞান অনেক অনেক ভিন্ন। খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারলেই এরা সুখী। যেদিন পেটপুরে খেতে পারে সেদিন এদের জীবনে সবচেয়ে বড় ঈদ পালন হয়। চোখেমুখে সে যে কী হাসি!
একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যখন সবার শেষে তাদের খাবার দেওয়া হলো তখন তাদের খাবারের দৃশ্যটি ভোলার মতো নয়। নির্জীব হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম। সৃষ্টির সেরা জীবের কী নিদারুণ আর করুণ দৃশ্য! সামান্য খাবারের কাছে একটা মানুষ কতটা অসহায়, যেন হাজার বছরের বুভুক্ষু!
বাংলাদেশে ভেসে আসা রোহিঙ্গাদের জীবনযাপন দেখতে যখন কুতুপালংয়ে গিয়েছিলাম তখন মনে হয়েছিল রোহিঙ্গারাই সবেচেয়ে দুঃখী। কিন্তু তার চেয়ে যে আরও দুঃখী মানুষ থাকতে পারে তা জেনেছি বাউনিয়া বাঁধে এসে। যার দেশ আছে, সমাজ আছে, সরকার আছে, নেতা আছে, ভোট আছে, তবু তার ভাগ্য পরিবর্তন হয় না। এর চেয়ে বড় দুঃখী আর কে হতে পারে? যার থেকেও নেই তার চেয়ে হতভাগা আর কে হতে পারে?
মশার উপদ্রব থেকে শুরু করে নোংরা পরিবেশের সর্বশেষ স্তরে রয়েছে এই বাউনিয়া বাঁধ। যেখানে শোবার জায়গা সেখানেই রান্নাবান্না, তার পাশেই ময়লার ড্রেন, যেখান থেকে মশার জন্ম। পাশেই আবার খোলা টয়লেট। শুধু কয়েকটা কাপড়ের টুকরা দিয়ে প্যাঁচ দিয়ে রাখা। মানুষের গায়ে দুর্গন্ধ। কাপড়-চোপড় ময়লায় ভরপুর। প্রকাশ্যে চলছে গাঁজা, ইয়াবা সেবন। খাবারের মান নিয়ে না হয় নাই বললাম।
মনে মনে কেন জানি বঙ্গবন্ধুর উচ্চারিত ‘সোনার বাংলাদেশ’ কথাটি আওড়াতে লাগলাম। সোনার দেশ কেন স্লোগানেই রয়ে গেল? কেন স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশত বছরেও এই মানুষগুলোর জীবনযাপন পরিবর্তন হলো না?
শুধু বাউনিয়া বাঁধ নয়, রাজধানীর রাস্তায় রাস্তায়ও বেশ চোখে পড়ে এমন চিত্র। বিশেষ করে দরিদ্র শ্রেণির মানুষের খাবার গ্রহণের দৃশ্য কতটা যে মর্মাহত করে তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। এরা রাস্তায় থাকে, রাস্তায় ঘুমোয়, রাস্তায় খায়, রাস্তাতেই মরে। আগাগোড়া রাস্তার জীবন!
এই সমাজ, এই দেশের অত্যন্ত সাধারণ চিত্র এটি। এই সমাজে কেউ থাকে সোনার ঘরে আর কেউ থাকে ময়লার ড্রেনে। কারও জন্ম হয় সোনার ঘরে আর কারও জন্ম হয় ক্ষুধা পেটে। অথচ সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতির একটি হচ্ছে সমাজতন্ত্র। যা ১০নং অনুচ্ছেদে ‘সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তি’ নামে শিরোনাম হয়েছে। যেখানে অর্থনৈতিক মুক্তি ও সমতার কথা বারবার উচ্চারিত হয়েছে। বড় কষ্টের সঙ্গেই বলতে হয়, এসব যেন কাগজে থাকবে, কলমে থাকবে, কথায় থাকবে, ভাষণে থাকবে, মঞ্চে থাকবে কিন্তু বাস্তবে থাকবে না, বাস্তবে হবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন তার কণ্ঠে বারবার উচ্চারিত করেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত এবং সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার কথা তখন শুনতে বেশ ভালোই লাগে। আশা জাগে, কিন্তু সেই আশা যে কবে পূরণ হবে তাই ভাবছি। যদি এই মানুষগুলো মুক্তি পায়, দীনতা থেকে বাঁচতে পারে তবেই এই দেশ এই সমাজ এই স্বাধীনতা এই রক্ত এই শেখ মুজিব এই নেতা এই পিতা এই জাতি সফল হবে।
আমরা আশা করি, বঙ্গকন্যার কণ্ঠ সফল হবে। বঙ্গবন্ধুর আশা কখনো বিফল হবে না। একটি দেশ জন্মের ক্ষেত্রে তার স্বপ্ন যেভাবে বাস্তবায়িত হয়েছিল তেমনি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি দেশও গড়ে উঠবে অচিরেই।
জামাল আস-সাবেত : লেখক ও কলামিস্ট।
[email protected]