ডাকসু আন্দোলনের সেই দিনগুলো
নূর বাহাদুর
🕐 ৮:১০ অপরাহ্ণ, মার্চ ০৯, ২০১৯
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির শুরু থেকেই বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত ছিলাম। মিছিলে গিয়ে চিনেছি আদর্শিক বন্ধু-শত্রু, মিটিং করতে গিয়ে শিখেছি শব্দের রাজনীতি-বাক্যের রাজনীতি, আরও কত কি! ২০-২২ আগস্ট জরুরি অবস্থার সময় ছাত্র-শিক্ষক মুক্তি আন্দোলনে আমার তৎকালীন সংগঠন-প্রগতির পরিব্রাজক দল (প্রপদ) এর হয়ে ‘নির্যাতন বিরোধী ছাত্র ছাত্রীবৃন্দ’র ব্যানার লুকিয়ে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে গিয়ে বিভিন্ন বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে হঠাৎ কয়েকজন মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে যাওয়া (ভয় ছিল, আমাদের সঙ্গে যদি সাধারণ শিক্ষার্থী যোগ না দেয় তাহলে নিশ্চিত ঠিকানা লাল দালান, তারপর-ইতিহাস।
আন্দোলন-সংগ্রামের গতিপ্রকৃতি-ইতিহাস, সংগঠনের চরিত্র, বৃহত্তর ঐক্য গড়ার কৌশল ইত্যাদি যাই শিখেছি সবই প্রপদ থেকে। মনোজ দা, শুভ্রা দি, রাসেল ভাই, মিলন দা, মাসুদ ভাই, এহতেশাম ভাই এই মানুষগুলো হাতে ধরে ধরে শিখিয়েছেন কীভাবে ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ’ তাড়াতে হয়। তখন ক্যাম্পাসে যত মোষ দেখেছি সমমনাদের সঙ্গে থেকে রুখে দাঁড়িয়েছি তার সামনে, কোনোটাকে তাড়িয়েছি কোনোটা পারিনি। প্রপদ থেকে নিষ্ক্রিয় হই ২০১০ এর দিকে।
২০১১, ছাত্রত্ব প্রায় শেষ, কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নই, কোনো আন্দোলনও নেই। কিছুটা হতাশা জেঁকে ধরেছে। IELTS-কোর্সে ভর্তি হলাম, বিদেশ চলে যাবো! মাথায় চিন্তা আসে বিশ্ববিদ্যালয়ে হরেক সমস্যা, কিছুদিন পরপর সামনে আসে এক একটা, অমনি ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ’ তাড়ুয়া কিছু শিক্ষার্থী মাঠে নেমে পড়ে। এতে আসলে খুব কম সমস্যারই সমাধান এসেছে। তাহলে এর ভালো সমাধান কী? শিক্ষকের সুবিধা-অসুবিধা দেখভাল করার জন্য শিক্ষকদের সংগঠন আছে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও সংগঠন আছে। এই সংগঠগুলোর নির্বাচনও নিয়মিত এবং যথেষ্ট উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। তাহলে শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধা দেখভাল করার সংগঠন কোথায়? সেটাওতো আছে ‘ছাত্রসংসদ’, তবে নিষ্ক্রিয়। ছাত্রসংসদ যদি সক্রিয় করা যায় তাহলে হয়তো কিছুটা সমাধান আসবে! অন্তত শিক্ষার্থীদের কথা বলার একটা জায়গা তৈরি হবে।
সহকর্মী ও ছোটভাই তৌফিকের সঙ্গে একদিন কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে ডাকসু বিষয়টা নিয়ে আলাপ করি। তৌফিক বিষয়টার সঙ্গে একমত পোষণ করল। সিদ্ধান্ত হলো অন্য সমমনাদের সঙ্গে আলাপ করা এবং সংগঠিত হওয়া। পরের দিন তৌফিক জানাল, আরো কয়েকজন এই বিষয়টা নিয়ে কিছু করার জন্য তৎপর। তারা কারা? নূরে আলম দুর্জয়, মওদুদ মিষ্ট প্রমুখ। তারাও পরিচিত সহযোদ্ধা। ওদের সঙ্গে বসলাম। ডাকসুর গঠনতন্ত্র, ক্ষমতাকাঠামোসহ কিছু মৌলিক বিষয়ে দুর্জয়ের জোর দ্বিমত থাকা সত্ত্বেও আমরা একমত হই, একসঙ্গে ডাকসু সচল করার আন্দোলন করব এবং কাজে নেমে পড়ি। প্রথমে প্রগতিশীল আন্দোলনকর্মী ও ক্রিয়াশীল সকল (প্রতিক্রিয়াশীল ও বিতর্কিত সংগঠন বাদে) সংগঠনের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত হয়। আলোচনা এগিয়ে যায় এবং প্রগতিশীল সংগঠনগুলো, বেশ কয়েকজন বন্ধু ও ছোটভাই সম্মত হয়।
আইবিএ-এর লনে সবাই মিলে বসি, কর্মপদ্ধতি ও প্ল্যাটফর্মের নাম ঠিক করাসহ বিবিধ বিষয়ে আলোচনার জন্য। নাম ঠিক হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চ’।
এর কাঠামোতে কোনো প্রচলিত পদ-পদবি থাকবে না, থাকবে না কোনো একক নেতা, সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে সবার মতামতের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, তবে মঞ্চের পক্ষে গণমাধ্যম কিংবা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার জন্য তিনজন মুখপাত্র নির্দিষ্ট করা হয়। প্রথম মুখপাত্র তিনজন হলেন- কাজল আব্দুল্লাহ, মওদুদ মিষ্ট ও নূরে আলম দুর্জয়।
কাজের সুবিধার জন্য গবেষণা, প্রচার, যোগাযোগ, অর্থ, আইন ও মিডিয়া সেল গঠন করা হয়, সেলগুলোর দায়িত্ব বণ্টন করা হয় ওই বৈঠকে। প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার সাধারণ সভা হবে, সেখানে পরবর্তী সপ্তাহের কর্মসূচি নির্ধারণ হবে। কী কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবো তাও প্রাথমিকভাবে ঠিক করা হয়। কর্মসূচিকে কয়েকটি ধাপে ভাগ করা হয়। হারিয়ে যাওয়া ডাকসু বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মনোভাব জানা এবং তাদের ডাকসু বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার মতো কর্মসূচি ঠিক করা হয়, কারণ আমরা সবাই একমত ছিলাম যে, তৎকালীন শিক্ষার্থীরা গুটিকয়েক বাদে কেহই ডাকসু বিষয়ে ধারণা রাখেন না। আরও সিদ্ধান্ত হয় একটা সংবাদ সম্মেলন করে মঞ্চের আত্মপ্রকাশ করা।
সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যের খসড়া তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় দুর্জয়, সংসদসহ কয়েকজনকে। পরবর্তী বৈঠকে বক্তব্য এবং সংবাদ সম্মেলনের তারিখ নির্ধারিত হবে। পরবর্তী মিটিংয়ে কাজল আব্দুল্লাহ জানালেন, তিনি ব্যক্তিগত কারণে দায়িত্বে থাকতে পারবেন না। তাহলে আরেকজন মুখপাত্র নির্দিষ্ট করতে হবে। এমতাবস্থায় আমাকে মুখপাত্র হিসেবে যুক্ত করা হলো। সংবাদ সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হলো এবং স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানকে প্রথম কর্মসূচি হিসেবে হাতে নেওয়া হলো। ইতোমধ্যে সাংবাদিকতা বিভাগের বেশ কিছু ছোট ভাইসহ অন্যান্য বিভাগের বেশ কিছু অনুজ যুক্ত হলো আমাদের সঙ্গে। সংবাদ সম্মেলন হলো, স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান, লিফলেট বিতরণ শুরু হলো। স্বাক্ষর সংগ্রহের অভিজ্ঞতা বেশ মজার, ‘ডাকসুতে আমি খাই না’, ‘ডাকসু আবার কী’, ‘ওটাতো একটা ক্যান্টিন’, ‘না না বাবা! ‘আব্বু আমাকে নিষেধ করছে রাজনীতি করতে’ ... ইত্যাদি মন্তব্য এসেছে শিক্ষার্থীদের দিক থেকে। কেহ পাগলামি বলেছে, কেহ টিপ্পনী কেটেছে, কেহ উপহাস করেছে, আবার কেহ সমর্থন করেছে, পরিচিত অনেকে হেসে উড়িয়ে দিয়েছে, আমাদের সহকর্মী ছোটভাইরা হতাশ হতো না কারণ আমরা জানতাম মাঠে নামলে এমনটাই হবে। আমাদের লক্ষ্য ছিল ডাকসুকে আলোচনায় আনা, হোক পক্ষে কিংবা বিপক্ষে, তাই হলো। এই রকম পরিস্থিতিতেও প্রায় পনেরো হাজার স্বাক্ষর সংগৃহীত হলো। কয়েকজন যুক্তও হয় আন্দোলনের কর্মী হিসেবে। আলোচনা সমালোচনা শুরু হলো। আমাদেরও শুরু হলো ধারাবাহিক কর্মসূচি। এরপর হাইকোর্টে রিট, জরিপ চালানো, বিক্ষোভ মিছিল, ক্লাস ক্যাম্পেইন, মানববন্ধন, হল ক্যাম্পেইন, শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে মানববন্ধন, সিনেট-সিন্ডিকেট নির্বাচনে বিক্ষোভ, উপাচার্যের অফিস অবরোধ, মশাল মিছিল, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী সংহতি সমাবেশ, প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ, প্রতিবাদী অঙ্কন, সংহতি সমাবেশ, যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তুলতে জাবি-জবিসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সফর ও যোগাযোগ, আচার্য বরাবর খোলা চিঠি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বরাবর স্মারকলিপি, আল্টিমেটাম, অবরোধসহ নানা আন্দোলনের পরও তৎকালীন প্রশাসন কোনো ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। এই আন্দোলনে একটা বিষয়ে বেশি ব্যথিত হয়েছি; শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী সংহতি সমাবেশে একজন শিক্ষকও আসেননি। তারপরও আমরা হাল ছাড়িনি।
ইতোমধ্যে অনেকের ছাত্রত্ব প্রায় শেষ হয়ে আসে, আন্দোলন স্থবির হতে শুরু করে। কয়েকবার চেষ্টা করা হয়েছে নতুনদের দায়িত্ব দিয়ে আন্দোলন চলমান রাখার কিন্তু তা সম্ভব হয়নি কারণ গ্রহণযোগ্য কাউকে পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে হাইকোর্টে মামলা চলতে থাকে, দীর্ঘকাল মামলা চলার পর এই মামলার সূত্র ধরে নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হলো। এই নির্বাচন যে শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চের সফলতা, কোনোভাবে সেটা দাবি করছি না। তবে শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চ স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া ডাকসুকে খুব যত্ন করে সংশ্লিষ্ট সকলের চোখের সামনে এনে হাজির করেছে, এই দাবিটুকু করতেই পারি।
আমরা কী করেছিলাম তা আজ প্রাসঙ্গিক না, কী চেয়েছিলাম তার কিছুটা প্রাসঙ্গিকতা আছে বৈকি। আমাদের প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো দখলদারিত্ব থাকবে না, প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র থাকবে না, শিক্ষক দলবাজ প্রশাসক হবেন না, শিক্ষক হবেন সিনিয়র স্কলার ও শিক্ষার্থী জুনিয়র স্কলার। সিট সংকট থাকবে না। লাইব্রেরি ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে, মেয়েদের হলে সান্ধ্য আইন থাকবে না, ক্লাসে অনুপস্থিতির জন্য জরিমানা হবে না। জরিমানা কেন? ক্লাসে তো আসবেই শিক্ষকের রুমে গিয়েও ভিড় করবে শিক্ষার্থীরা, এমনটাই হওয়ার কথা। টি.এস.সি হবে সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র, এখান থেকে গড়ে উঠবে আগামীর কবি, সাহিত্যিক। ক্রীড়া, সংস্কৃতিসহ সকল ক্ষেত্রে থাকবে আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ। গবেষণার পর্যাপ্ত সুযোগ থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয় হবে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকেন্দ্র। নতুন জ্ঞানের সৃষ্টিই হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্য। এই স্বপ্ন পূরণ হবে তখনই হবে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ গণতান্ত্রিক চর্চা হবে, সকল নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সুষম প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
নূর বাহাদুর : ডাকসু চাই আন্দোলনের
প্রধান সমন্বয়ক